চট্টগ্রামের এই ব্যবসাকেন্দ্র থেকে যৌথ বাহিনীর অভিযানে ৮০ জনকে আটক করা হয়েছে।
Published : 06 Nov 2024, 05:02 PM
ফেইসবুকে একটি ধর্মীয় সংগঠনের নামে এক ব্যক্তির দেওয়া ফেইসবুক পোস্টকে কেন্দ্রে করে নগরীর হিন্দু অধ্যুষিত হাজারী গলিতে উত্তেজনা ও বিক্ষোভের ঘটনায় পাঁচ সেনা ও সাত পুলিশ সদস্যসহ ১২ জন আহত হয়েছেন ।
যৌথ বাহিনীর ট্রাস্কফোর্স-৪ এর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ জানিয়েছেন, অভিযানে নেমে যৌথ বাহিনী ৮০ জনকে আটক করেছে।
বুধবার দামপাড়ায় সংবাদ সম্মেলনে এসে এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, “ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ভিডিও ও গোয়েন্দা তথ্য যাচাই বাছাই করে জড়িতদের চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া চলছে। আটকদের থানায় জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আদালতে পাঠানো হবে।”
মঙ্গলবার রাতের তুলকালাম কাণ্ড এবং যৌথ বাহিনীর অভিযানের পর সকালে শহরের পাইকারি ওষুধ ও স্বর্ণের বাজার হাজারী গলির সব দোকানপাট ‘সিলগালা’ করে বন্ধ দিয়েছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। পুরো এলাকা জুড়ে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয়রা বলেন, হাজারী গলি মিয়া শপিং সেন্টার নামের একটি মার্কেটের একটি দোকানের মালিক ওসমান মোল্লা ফেইসবুকে হিন্দুদের ধর্মীয় একটি সংগঠন ইসকনকে নিয়ে ‘ব্যাঙ্গাত্মক’ পোস্ট করেন।
সেটা নিয়ে স্থানীয় সনাতনী সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পরে বিক্ষুব্ধরা দল বেঁধে মার্কেটের সামনে জড়ো হয়। তারা দোকানটি ঘিরে রাখে।
পরে পুলিশ গিয়ে পোস্টদাতা ওসমানকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে সনাতনী সম্প্রদায়ের লোকজন উত্তেজিত হয়ে পড়েন। এ সময় পুলিশকে ধাওয়া করেন স্থানীয় লোকজন। বিক্ষুব্ধরা বাহিনীর সদস্যদের দিকে ইটপাটকেল ছুড়ে মারে। উপর থেকে অ্যাসিডও নিক্ষেপ করার ঘটনাও ঘটে।
রাত সাড়ে নয়টার পর পুলিশের সঙ্গে সেনাবাহিনী যৌথভাবে হাজারী গলিতে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বেশ কয়েকজনকে আটক করে নিয়ে যায়।
রাতের ঘটনার নিয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফেরদৌস বলেন, “৫০০/৬০০ জনের মত ‘দুষ্কৃতিকারী’ ওসমান আলী ও তার ভাইকে হত্যা এবং দোকান জ্বালিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে জড়ো হয়।
“খবর পেয়ে সেনা, পুলিশ ও বিজিবির ছয়টি টহল টিম ঘটনাস্থলে যায় এবং জানমাল রক্ষা ও ‘মব জাস্টিস’ রোধে ওসমান ও তার ভাইকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। তখন উত্তেজিত জনতাকে যথাযথ আইনের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানে আশ্বস্ত করার পরও তারা উত্তেজিত হয়ে উঠে।”
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলার ঘটনা নিয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফেরদৌস বলেন, “ওই সময় বিশৃঙ্খলাকারীরা যৌথ বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য করে জুয়েলারির কাজে ব্যবহৃত অ্যাসিড ও ইটপাটকেলসহ ভাঙা কাঁচের বোতল নিক্ষেপ শুরু করে। এতে পুলিশ ও সেনা সদস্যরা আহত হয়েছেন।”
সেনা কর্মকর্তা বলেছেন, রাত সাড়ে ৯টার দিকে যৌথ বাহিনীর ১০টি টহল দল হাজারি গলিতে ঢোকার পর ‘দুষ্কৃতিকারীরা’ ফের হামলা চালায়।
থমথমে পরিস্থিতি
চট্টগ্রাম নগরীর হাজারী গলি পাইকারি ওষুধ বাজার ও স্বর্ণ পট্টি হিসেবে খ্যাত। নগরী ছাড়াও বিভিন্ন উপজেলার বিক্রেতারা ওষুধ এই গলি থেকেই সংগ্রহ করে থাকেন।
সকালে গলিতে গিয়ে দেখা যায়, টেরি বাজার সংলগ্ন গেইটটি বন্ধ, দোকান, মার্কেটগুলোর দরজার তালা সিলগালা কর। দোকানি ও কর্মচারীদের কর্মস্থল গিয়ে ফিরে আসছেন।
স্বর্ণের দোকান কর্মচারী প্রদীপ কুণ্ড জানিয়েছেন, রাতের ঝামেলা শুরুর পর তিনি বাসায় চলে গিয়েছিলেন।
“সকালে এসে দেখি দোকানে তালা। দোকান খোলা যাবে না।তাই চলে যাচ্ছি।“
ওষুধ ও স্বর্ণের দোকানিরা জানিয়েছেন, রাতে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা গিয়ে লাঠিপেটা করেছে। এতে অনেকেই আহত হয়েছে। অনেক দোকান মালিক ও কর্মচারীকে আটক করা হয়েছে।
স্থানীয়রা দায়ী করছে ‘বহিরাগত’দের
গলির স্থানীয় কিছু বাসিন্দা এবং দোকান মালিক জানিয়েছেন, মিয়া শপিং কমপ্লেক্সে ফেইসবুক পোস্টদাতা ওসমানের দোকান ঘিরে বিকাল থেকে উত্তেজনা শুরু হয়।
পরে সআশেপাশের এলাকা থেকে অনেক বহিরাগত এসে ওই ঝামেলায় যোড় দেয় এবং দোকানপাট ভাঙচুরের চেষ্টা চালায় বলে ভাষ্য তাদের।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, উত্তেজনা শুরুর পর পর ঘটনাস্থলে প্রথমে পুলিশ আসে।
সেনা সদস্যরা এসে যখন ওসমানকে উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন বহিরাগতরা ওসমানকে তাদের হাতে তুলে দিতে স্লোগান দিতে থাকেন।
এরা অনেক বেশি ‘উত্তেজিত’ ছিলেন মন্তব্য করে স্থানীয় কয়েকজন বলেছেন তারাই (বহিরাগত) ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। তাদের বার বার শান্ত হওয়ার অনুরোধ জানালেও তাতে কাজ হয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দা ও দোকানিরা অভিযোগ করে বলেছেন, ‘বহিরাগতরা ‘ঘটনা ঘটিয়ে’ চলে যাওয়ার পর যৌথ বাহিনীর সদস্যরা অভিযানে আসেন এবং অনেককেই ‘লাঠিপেটা করে আটক করে নিয়ে যান’।
লাঠিপেটায় শতাধিক আহত হয়েছে বলেও দাবি করেছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও দোকানিরা।
স্বজনদের খোঁজ নিতে ছুটাছুটি
সকালে হাজারী গলিতে ভাইয়ের খোঁজে আসা জয়া দেবী শর্মা নামের এক নারীকে কান্নাকাটি করতে দেখা যায়।
সাংবাদিক শুনে তিনি এগিয়ে এসে বলেন সন্ধ্যায় হাটহাজারী থেকে তার ছোট ভাই বিপ্লব লোধ ডাক্তার দেখাতে শহরে আসেন।
“টেরি বাজারে আমার বাসায় যাওয়ার পথে সিনেমা প্যালেস এলাকায় বিপ্লবকে রিকশা থেকে নামিয়ে দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা একটি বাস কাউন্টারে বসিয়ে রাখেন। রাত থেকে ওর কোনো খোঁজ নাই।“
রাত থেকেই থানা এবং সেনাবাহিনীর কাছে বিপ্লবের খোঁজ পেতে ছোটাছুটি করছেন বলে জানিয়েছেন জয়া দেবী।
তিনি বলেন, “বিপ্লবকে যখন বাস কাউন্টারের সামনে বসিয়ে রেখেছিল, তখন ওর সাথে মোবাইলে কথা হয়েছে।পরে আর যোগাযোগ করতে না পারায় আমরা রাত সাড়ে ১১টার দিকে বাস কাউন্টারে খোঁজ নিতে যাই। সেখান থেকে আমাদের বলা হয়, যাদের বসিয়ে রাখা হয়েছিল তাদের সবাইকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ে গেছে।“
ভাইয়ের খোঁজে জয়া দেবী প্রথমে যান নগরীর কোতয়ালি থানায়।
“সেখানে তাকে পাইনি। পরে পাঁচলাইশ থানায় গিয়েও না পেয়ে ক্যান্টনমেন্টের সামনে যাই। কিন্তু আমাদের ভেতরে ঢুকতে দেয়নি।“
সন্তানের খবর না পেয়ে বান্দরবান থেকে ছুটে আসেন প্রসেনজিৎ দাশ ও তার স্ত্রী প্রিয়াংকা বিশ্বাস। এই দম্পতির ছেলে হাজারী গলিতে একটি ওষুধের দোকানে কাজ করতেন।
তারা বলেছেন, রাতে গলিতে ঝামেলার সময়ে ছেলের সঙ্গে মোবাইলে কথা হয়েছে। পরে তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। দোকান মালিকও তার কর্মচারীর বিষয়ে কোনো তথ্য জানাতে পারেননি।
আরও পড়ুন-
ফেইসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে তুলকালাম, যৌথ বাহিনীর অভিযান