“অস্থির একটা সময়, থানা আক্রান্ত হয়েছে, পুলিশ হয়ে গিয়েছিল সাধারণ জনগণের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু; সে অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর যে প্রক্রিয়া, তার অংশীদার হতে পেরে আমি গর্বিত”, বলেন তিনি।
Published : 12 Sep 2024, 08:59 AM
পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে গিয়ে সংকট তৈরি হয়েছিল মন্তব্য করে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের নতুন কমিশনার হাসিব আজিজ বলেছেন, তিনি এই বৃত্ত থেকে বের হতে চান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে নগর পুলিশের প্রধান বলেছেন, “কোনো রকম রাজনৈতিক ও কোটারি স্বার্থে সিএমপির কোনো সদস্য কাজ করবে না। তারা কাজ করবে চট্টগ্রামের সকল নাগরিকের জন্য।”
ছাত্র জনতার তুমুল আন্দোলনে গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থানায় থানায় হামলার পর নতুন এক বাস্তবতা দেখছে দেশ। পুলিশের অস্ত্র খোয়া গেছে, তাদের যানবাহন নেই; এতে টহল বা অভিযানের ক্ষমতা কমেছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ।
গত ৮ অগাস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রশাসনের পাশাপাশি পুলিশেও ব্যাপক রদবদল শুরু হয়, পাল্টানো হয় চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কমিশনারকেও। গত ৪ সেপ্টেম্বর সিএমপির ৩৩ তম কমিশনার হিসেবে যোগ দেন হাসিব আজিজ।
একদিকে অভ্যন্তরীণ সংস্কারের দাবি, অন্যদিকে সাধারণ জনগণের সাথে পুলিশের দূরত্ব সব মিলিয়ে অস্থির এক পরিস্থিতিতে সিএমপির মত একটা বড় ইউনিটের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া বিসিএস ১৫ তম ব্যাচের ক্যাডারের কর্মকর্তা হাসিব আজিজের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি এর আগে দায়িত্ব পালন করেছিলেন সিআইডি ট্রেনিং স্কুলে। বড় কোনো অপারেশনাল ইউনিটের দায়িত্বে ছিলেন না।
নিজ ইউনিটের সদস্যদের সঙ্গে জনগণের ‘দূরত্ব’ কমিয়ে জনমুখী করে তোলা এবং নতুন দায়িত্বের চ্যালেঞ্জ নিয়ে কী ভাবছেন, এসব বিষয়ে বুধবার বিকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কথা বলেন নবাগত সিএমপি কমিশনার।
হাসিব আজিজ বলেন, “সিএমপি কমিশনারের দায়িত্ব নেওয়াটা আমি চ্যালেঞ্জ না, আমার ‘সুবর্ণ সুযোগ’ হিসেবে দেখছি। ক্রান্তিকালের একটা নেতৃত্ব আমি পেয়েছি, এ সুযোগটা আমি সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করব।
“অস্থির একটা সময়, থানা আক্রান্ত হয়েছে, পুলিশ হয়ে গিয়েছিল সাধারণ জনগণের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু; সে অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর যে প্রক্রিয়া, তার অংশীদার হতে পেরে আমি গর্বিত।”
সরকার পতনের পর সিএমপিতেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কনস্টেবল থেকে পরিদর্শক পদমর্যাদার সদস্যরা বিক্ষোভ করেছেন। কাজে যোগ দিলেও বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে ভীতি ও নিস্ক্রিয়তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে কীভাবে নিজ ইউনিটের সদস্যদের সক্রিয় করবেন?
এ দূরত্বটা সাময়িক ছিল। আমরা আনন্দের সাথে বলতে চাই আমাদের সকল ফোর্স ও সিনিয়র অফিসাররা কাজে যোগ দিয়েছে।
দায়িত্ব নিয়েই সিনিয়র অফিসারদের পাশাপাশি আমি কনস্টেবলদের সঙ্গে বসেছি। তাদের যে কল্যাণের বিষয় আছে, তাদের আমি ওয়াদা দিয়েছি। তাদের দাবি দাওয়া, ছুটিছাটা, খাওয়া দাওয়া, কল্যাণ ফান্ডের সাহায্য, ইত্যাদি যা চায়, আমার সাধ্যের মধ্যে তার চেয়ে বেশি দেব। কিন্তু দায়িত্ব পালন করতে হবে, তারাও আমাকে কথা দিয়েছে।”
বিক্ষোভের কারণ কী ছিল?
লোয়ার র্যাংকে আমার সহকর্মীদের একটা অভিযোগ ছিল, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পুলিশকে ব্যবহার করা হয়েছে। সিনিয়র কমান্ড পোস্টে ব্যাপকভাবে রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছিল। তারা রাজনৈতিক নেতাদের মত অধস্তনদের হুকুম দিয়েছিল। নিচের দিকে সেই হুকুম মানতে বাধ্য করেছে, যে কারণে থানা ও ফাঁড়িগুলো আক্রমণের শিকার হয়েছে।
আমি সিএমপি কমিশনার হিসেবে বলতে চাই, কোনো রকম রাজনৈতিক ও কোটারি স্বার্থের পক্ষে আমার ইউনিট কাজ করবে না। এ ইউনিট চট্টগ্রামের সকল নাগরিকের জন্য কাজ করবে।
আশা করি সিএমপির সিনিয়র মোস্ট হিসেবে যদি এ রকম একটা কমান্ড আমার ফোর্সকে দিই, তাহলে আমার প্রতি তাদের আস্থাটা ফিরে আসবে।
সরকার পতনের ব্যাপক ধ্বংস যজ্ঞ চালানো হয় থানাগুলোতে। পুড়িয়ে দেয়া হয় যানবাহন। এটি কাজের একটা বাধা সৃষ্টি করেছে। কীভাবে নিরসন করা হচ্ছে?
সাময়িকভাবে হলেও এটা একটা বাধা। চট্টগ্রামে ২৮টা পুরোপুরি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে গাড়ির জন্য সদরদপ্তরে বলেছি, চলে আসবে। আমি বলেছি, গাড়ি না থাকলেও টহল বন্ধ করা যাবে না। ফুট পেট্রোল বা হোন্ডা পেট্রোল কর।
পরিকল্পনা আছে, পুরো শহরকে আমরা পুলিশি টহলের আওতায় নিয়ে আসব। থানা পুলিশকে সহায়তা করা এবং মেট্রোপলিটন অর্ডিন্যান্সের অধীনে জন উপদ্রব জাতীয় যে সমস্যাগুলো হয়, সেগুলো নিরসন করা, থানা পুলিশকে সহযোগিতা করা এবং কুইক রেসপন্স করার কাজগুলো তো করতে হবে।
ফোর্সের সঙ্গে অফিসার এবং জনগণের সঙ্গে পুলিশের বিচ্ছিন্নতা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। কমিশনার হিসেবে আমার কনস্টেবলকে বুকে জড়িয়ে ধরতে হবে, আবার কমিউনিটি বেইসড পুলিশিং করতে হবে।
আপনি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ৩৩ তম কমিশনার। এই ইউনিটের তৃতীয় কমিশনার ছিলেন আপনার বাবা পুলিশের সাবেক আইজি এম আজিজুল হক। বাবা-ছেলে, দুই জনই একই ইউনিটের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার ঘটনা অনেকটাই বিরল। আপনি পুলিশকে জনমুখী করতে কী করতে চান?
বাবা-ছেলের নাম একই অনার বোর্ডে এটা আমার জন্য সৌভাগ্য। এ চট্টগ্রামের প্রতি আমার আলাদা একটা ভালোবাসাও আছে। ২০০২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত এ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপারেরও দায়িত্ব পালন করেছি।
কমিউনিটি পুলিশ সিস্টেম চালু করা হবে নতুন করে। আগামী সপ্তাহ থেকে ওপেন ডে হাউজ হবে। চারটি ক্রাইম জোনের ডিসিরা প্রতি রোববার জনগণের কথা শুনবে। থানায় যদি জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারে, তারা সেগুলো ডিসিদের জানাবে। পাশাপাশি প্রতি মঙ্গলবার জনগণ কার্যালয়ে এসে আমার সঙ্গে কথা বলবে। আমার দুয়ার সবসময় খোলা।
দেশের বিভিন্ন স্থানে গোষ্ঠীগত ও সাম্প্রদায়িক হামলার মত ঘটনা ঘটছে। আগামী অক্টোবরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা শুরু হবে। পূজা উদ্যাপন নিয়েও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে ভীতি ও শঙ্কার সৃষ্টি হচ্ছে। আপনারা কী পদক্ষেপ নেবেন?
রাষ্ট্র সবার, ধর্মটা ব্যক্তির। ঈদ যেভাবে পালন করা হয়, সেভাবে নিরাপত্তা ও স্বস্তির সঙ্গে পূজা করবে। সব ধরনের পুলিশি নিরাপত্তা থাকবে। আশা করি, যে যার যার অবস্থানে থেকে নিজের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো পালন করবেন।
সিলেটসহ দেশের কয়েকটি জেলায় বিভিন্ন মাজারে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রামে আপনারা কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
এ বিষয়ে আমরা সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিচ্ছি। আগাম গোয়েন্দা তথ্য জোগাড় করা, ঝুঁকি থাকলে আগাম পুলিশি ব্যবস্থা, সেগুলো আমরা করছি পরশু থেকে।
ইসলাম ধর্মে কিছু তরিকা আছে, যারা মাজারকে বেদাত মনে করে, আবার যারা মাজারের পক্ষে তারা বলেন সুফি। এই যে ওয়াহাবিজম, সুফিজম এই দ্বন্দ্বটা যাতে প্রকাশ্যে না আসে।
ধর্ম বিশ্বাস ব্যক্তিগত। যার যার ধর্ম বিশ্বাস ব্যক্তিগত ও কমিউনিটি হিসেবে পালন করবে একটা আনন্দ উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে। কিন্তু একজনের ধর্মবিশ্বাস আরেক জনের উপর চাপিয়ে দিতে গেলেই সমস্যা। ওটা যাতে কেউ না করে সে লক্ষ্যে আমরা উদ্বুদ্ধমূলক প্রচার চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করি সবাই যার যার অবস্থানে থেকে ধর্ম উৎসবগুলো সুন্দরভাবে পালন করবে, সেখানে আমাদের নিরাপত্তা থাকবে।