নিজে বের হয়ে নেভানোর চেষ্টা করলেও পারেননি; আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়েছেন দুই শিশু সন্তানসহ পাঁচ প্রিয়জন।
Published : 13 Jan 2023, 06:08 PM
দুই শিশু সন্তানের ডাকে ঘুম ভাঙলে দেখেন ঘর জ্বলছে আগুনে। এরপর তাদেরসহ বাবা-মা ও স্ত্রীকে নিয়ে জড়ো হন বারান্দায়। সেখান থেকে বের হওয়ার পথটিতে তখন ভয়াবহ আগুনের লেলিহান শিখা। আগুনে পুড়ছে তখন অন্য কক্ষগুলোও। আর কোনো উপায় না দেখে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন খোকন বসাক।
তার পিছুপিছু দুই সন্তান ও অন্যদের আসতে বলে খোকন আগুনের ভেতর দিয়ে দরজা পার হন। তবে আগুনের ভয়াবহতা এতটাই বেশি ছিল যে বারান্দায় থাকা বাকি পাঁচজন দরজার কাছে ভিড়তেই পারেননি। বাইরে থেকে নলকূপের পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেও কূলিয়ে উঠতে পারেননি।
পাগলের মত ডেকেছেন প্রতিবেশীদের। মধ্যরাতে তাদের সাড়া পেতেও লেগেছে কিছুটা সময়। ততক্ষণে চোখের সামনেই ঘরের বারান্দায় আগুনে পুড়তে দেখেছেন প্রিয়জনদের।
বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে আগুন লাগার সময় ঘুমিয়ে ছিলেন রাঙ্গুনিয়ার পারুয়া গ্রামের সিএনজি অটোরিকশা চালক খোকন বসাক। দাদীর সঙ্গে অন্য কক্ষে ঘুমাচ্ছিলেন তার ১২ বছরের ছেলে সৌরভ ও পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে শয়ন্তী। হঠাৎ ‘বাবা আগুন, বের হও ...‘ তাদের এমন চিৎকারে ঘুম ভাঙে খোকনের। এরপরই ঘর থেকে বের হওয়ার উপায় খুঁজছিলেন তিনি। পরে নিজে বের হতে পারলেও বাঁচাতে পারেননি আর কাউকে।
সেই থেকে সন্তানদের ডাক পোড়াচ্ছে তাকে। ঘুরে ফিরে কানে বাজছে তাদের কণ্ঠ, ‘বাবা আগুন’।
অগ্নিদগ্ধ ৪২ বছর বয়সী খোকন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপডাতালের বার্ন ইউনিটের মেঝেতে আধশোয়া অবস্থায় আহাজারি করছিলেন এ নিয়ে। আফসোস করছিলেন নিজের দুই শিশু সন্তান, বাবা-মা ও স্ত্রীকে বাঁচাতে না পারায়।
কেন তিনি তার দুই ছেলে মেয়েকে নিজে টেনে বের করলেন না। দুই সন্তানের ‘বাবা আগুন’ ডাক যেন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাকে।
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পারুয়া ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডের মহাজন পাড়ার খোকন বসাকের বাড়িতে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে আগুন লেগে তার দুই ছেলেমেয়ে সপ্তম শ্রেণির সৌরভ বসাক (১২) ও প্রথম শ্রেণি পড়ুয়া শয়ন্তী বসাক (৫) ঘরের মধ্যেই মারা যান। তাদের সঙ্গে হারিয়েছেন পিতা কাঙাল বসাক (৭০), মা ললিতা বসাক (৬০) ও স্ত্রী লাকী বসাককে (৩২)।
ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের মত খোকনেরও ধারণা রান্নাঘরের চুলা থেকে আগুন লাগতে পারে।
আগুনের মধ্য দিয়ে ছুটে বেরিয়ে আসা খোকনেরও শরীরের ২০ শতাংশ পুড়ে গেছে। তার বাম হাত, বুক ও পিঠ ব্যান্ডেজে মোড়া। মাথা মুখেও পোড়া চিহ্ন রয়েছে। সন্তানসহ নিকটজনদের হারানোর বেদনায় মুষড়ে পড়া খোকন এখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন। সেখানেই তার সঙ্গে কথা হয়।
শরীরের পোড়া যন্ত্রণার চাইতেও খোকন সেখানে সবচেয়ে বেশি পুড়ছেন মনের যন্ত্রণায়। নিজের চোখের সামনেই পরিবারের পাঁচ সদস্যকে আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যেতে দেখেছেন। সেই যন্ত্রণা এখনও পোড়াচ্ছে তাকে।
কান্না জড়িত কণ্ঠে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, আগের দিন রাত সাড়ে দশটার দিকে আমরা শুয়ে পড়ি। চার কক্ষের সেমি পাকা বাড়ি তাদের। এক কক্ষে তিনি তার স্ত্রীসহ, পাশের কক্ষে দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে মা এবং অপর কক্ষে তার বাবা একাই ঘুমাতেন।
‘‘রাত পৌনে দুইটার দিকে আগুন লাগার পর আমার মা, বাবা ও দুই ছেলে মেয়ে আমাদের কক্ষের দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাক দেয়। ছেলেমেয়ে বাবা আগুন, দরজা খোল বলে চিৎকার করে ডাক দেয়। ঘর থেকে বেরিয়ে স্ত্রীসহ আমরা ছয়জন বারান্দায় দাঁড়াই। এসময় আমি বারান্দার দরজা খুলে বাইরে যাবার কথা চিন্তা করি।’’
রাঙ্গুনিয়ায় চুলা থেকে ঘরে আগুন, এক বাড়ির ৫ জন পুড়ে অঙ্গার
রাতের সেই বিভীষিকার বর্ণনা দিচ্ছিলেন তিনি। তিনি বলেন, “আমি দুই সন্তান ও বাবা মাকে আমার পেছন পেছন আসতে বলে দরজা খুলে বাইরে যাবার চেষ্টা করি। এসময় আগুনের প্রচণ্ড হলকা ঘরে প্রবেশ করলেও আমি বাইরে বের হয়ে গেলেও বাকিরা আর বের হতে পারেনি।“
খোকন আফসোস করে বলেন, তাদের যদি আমি জোর করে বের করে নিয়ে আসতাম তাহলে হয়ত এতবড় ঘটনা ঘটত না।
চার কক্ষের সেমিপাকা বাড়িটির বারান্দার সঙ্গে লাগোয়া বেড়ার রান্নাঘর। সেখানে কুড়ানো পাতার সঙ্গে কাঠের লাকড়িও ছিল বলে গৃহকর্তা খোকন, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় পুলিশ জানায়। রান্নাঘরের সঙ্গে লাগানো ছিল খোকনের সিএনজি অটোরিকশাটি। সেটিও আগুনে পুড়ে গেছে। লাকড়ি ও পাতার কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বলে ফায়ার সার্ভিস বলেছে।
তিন ভাই, দুই বোনের মধ্যে তৃতীয় খোকন তার মা-বাবা, স্ত্রী-দুই সন্তান নিয়ে পারুয়ার বাড়িতে থাকতেন। দুই ভাই অন্যত্র বসবাস করেন।
হাসপাতালের বেডে শুয়ে কান্না জড়ানো গলায় খোকন বলেন, আমার ছোট মেয়ে নাচ করতে পছন্দ করত। ছেলেটা তবলাও শিখত। কিন্তু তাদের হারিয়ে ফেললাম।
তিনি জানান, তাদের বাড়ির রান্নাঘরে ‘বন্ধু চুলা’ ছাড়াও গ্যাসের চুলা ছিল। আগের দিন রাতে চুলা নিভিয়েও রাখা হয়েছিল দাবি করে তিনি বলেন, কীভাবে আগুন লাগল সে সম্পর্কে ধারণা নেই।
হাসপাতালের মেঝের বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় অগ্নিদগ্ধ খোকন বসাক কথা বলার সময় মাঝে মাঝে সন্তানদের কথা বলতে গিয়ে আনমনা হয়ে পড়ছিলেন, চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল।
“আমরা তো আর কেউ রইল না। কানের মধ্যে যেন বাজছে... বাবা আগুন…।“
বার্ন ইউনিটে খোকনের সঙ্গে আছেন তার খালাতো ভাই সাগর চৌধুরী। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, খোকন একটু ধর্মপ্রাণ মানুষ। বাড়ির সঙ্গে লাগানো মন্দিরে রাতে কীর্তন করেছেন। পরে ভাত খেয়ে ঘুমোতে যান।
তিনি বলেন, ঘর থেকে বাইরে এসে পানি নিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছেন। পাশের লোকজনকে ডেকেছেন। তখনো তার পিঠের গেঞ্জিতে আগুন লেগেছিল।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের প্রধান ডা. রফিক উদ্দিন আহমেদ বলেন, খোকনের শরীরের ২০ শতাংশ পুড়ে গেছে। শ্বাসনালীর ইনজুরিও আছে। তাকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের উপ সহকারী পরিচালক আবদুল হামিদ মিয়া বলেন, রান্নাঘরের চুলা থেকে আগুন লেগেছে বলে আমাদের ধারণা। আমাদের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে ভোর চারটার দিকে আগুন নেভাতে সক্ষম হয়। তার আগেই ঘরের ভেতরে দগ্ধ হয়ে প্রাণ গেছে পাঁচজনের।
বসতঘর লাগোয়া রান্নাঘরে বিপুল পরিমাণে লাকড়ি থাকায় দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে বলে তার ধারণা।