আত্মহত্যা, না হত্যা- এ প্রশ্ন ওঠায় আদালতের নির্দেশে কবর থেকে ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর লাশ তুলে আবারও ময়নাতদন্ত করেছেন চিকিৎসকরা।
Published : 11 Dec 2016, 02:57 PM
রোববার বিকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, তারা ‘আঘাতের চিহ্ন’ পেয়েছেন, তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাবেন ঘটনাস্থল পরিদর্শন এবং ভিসেরা প্রতিবেদন পাওয়ার পর।
দিয়াজের মা জাহেদা আমিন চৌধুরী ঢাকা মেডিকেলে সাংবাদিকদের বলেছেন, চট্টগ্রামে প্রথম ময়নাতদন্তে আঘাতের কোনো চিহ্নের কথা ছিল না। এবার প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে বলে তিনি আশা করছেন।
প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে দিয়াজের আত্মহত্যার কথা এলেও তা প্রত্যাখ্যান করে ইতোমধ্যে একটি মামলা করেছেন দিয়াজের মা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি দিয়াজ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক ছিলেন। গত ২০ নভেম্বর রাতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বাসায় ঝুলন্ত অবস্থায় তার লাশ পাওয়া যায়।
ঢাকা মেডিকেলে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্তের পর ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, “আমরা তিন সদস্যের মেডিকেল বোর্ড ময়নাতদন্ত শেষে করেছি। যা পেয়েছি তা পর্যালোচনা করব এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শন করব। যারা প্রথম ময়নাতদন্ত করেছেন এবং ওই ঘটনায় যারা সাক্ষী আছেন, তাদের সাথে কথা বলে আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেব।”
তিনি জানান, দিয়াজের ভিসেরা, দাঁত ও গলার টিস্যুর হিস্টোপ্যাথলজি পরীক্ষা হবে। ওই প্রতিবেদন আসার আগেই তারা চট্টগ্রামে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাবেন।
প্রথম ময়নাতদন্তে আত্মহত্যার কথা বলা হলেও পরিবারের দাবি এটা হত্যাকাণ্ড- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সোহেল মাহমুদ বলেন, “আমরা আঘাতের চিহ্ন পেয়েছি। তবে এখন আমরা কিছুই বলব না। ঘটনাস্থল দেখে আসার পর প্রতিবেদন দেব।”
মর্গের বাইরে উপস্থিত দিয়াজের মা বলেন, “এবার ডাক্তার আঘাতের চিহ্ন পাওয়ার কথা বলেছেন। আমি আশাবাদী, এবার ময়নাতদন্তে সঠিক তথ্য আসবে, প্রমাণিত হবে যে আমার ছেলেক হত্যা করা হয়েছে।”
দিয়াজের বড় বোন ও ভগ্নিপতিও এ সময় ঢাকা মেডিকেলের মর্গের বাইরে উপস্থিত ছিলেন।
দিয়াজের মা অভিযোগ করেন, তার করা মামলার আসামি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর টিপু তাদের হুমকি দিচ্ছেন।
তিনি দিয়াজের মৃত্যুর পর তোলা বিভিন্ন ছবি দেখিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “দেখুন তার হাত পায়ে জখমের চিহ্ন, অথচ (চট্টগ্রামে) ময়নাতদন্তে আসছিল কোনো জখমের চিহ্ন নাই।”
দিয়াজের ভগ্নিপতি সারোয়ার আলম বলেন, “এই জখমের কথা প্রথম ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকদের বলেছিলাম। তারা আমাদের জানায়, তারা নাকি ময়নাতদন্ত করেনি, শুধু স্বাক্ষর করেছেন।
“আলমগীর টিপু, জামসেদ ও তার দলবল জোর করেই এসব কিছু করেছে।”
দিয়াজের বড় বোন জুবাইদা ছরওয়ার চৌধুরী নিপা বলেন, “শুরু থেকে আমরা বলে আসছি যে দিয়াজ আত্মহত্যা করেনি। তাকে হত্যা করা হয়েছে। যে ১০ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করা হয়েছে, তারা ও তাদের দলবলই দিয়াজকে হত্যা করেছে।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নির্মাণ কাজের জন্য ৯৫ কোটি টাকার টেন্ডার নিয়ে দিয়াজের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর টিপুর বিরোধ চলছিল।
সেই বিরোধ, চাঁদা দাবিসহ নানা কারণে ‘ষড়যন্ত্র’ করে দিয়াজকে হত্যার পর লাশ ঘরে ঝুলিয়ে রাখা হয় বলে দাবি তার পরিবারের।
দিয়াজের মৃত্যুর পর তার লাশের যে সুরতহাল প্রতিবেদন হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফছানা বিলকিস তৈরি করেন, তাতে গলায় দাগ ছাড়াও দুই হাতের কনুইয়ের আশপাশে লালচে দাগ এবং বাঁ পায়ে ‘সামান্য আঘাতের চিহ্ন’ থাকার কথা বলা হয়েছিল।
কিন্তু মৃত্যুর তিন দিন পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবুল কাশেম, সুমন মুৎসুদ্দি ও জাহিদুল হাসান ময়নাতদন্তের যে প্রতিবেদন দেন, তাতে বলা হয়, দিয়াজ আত্মহত্যা করেছেন। ‘ঝুলন্ত অবস্থায় থাকার কারণে শ্বাস বন্ধ হয়ে’ তার মৃত্যু হয়েছে। আর সুরতহাল প্রতিবেদনে থাকা হাতের ‘কনুইয়ের দাগ’ কারও ‘নখের নয়’।
ওই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে দিয়াজের মা ২৪ নভেম্বর আদালতে হত্যা মামলা দায়ের করেন। তাতে ছাত্রলীগ নেতা টিপু ছাড়াও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেন চৌধুরী ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর টিপুসহ ১০ জনকে আসামি করা হয়।
দিয়াজের অনুসারী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের আন্দোলনের মুখে গত ২৮ নভেম্বর সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেন চৌধুরীকে অপসারণ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আদালত পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দিলে পুনঃময়নাতদন্তের আবেদন করেন দিয়াজের মা।
এরপর চট্টগ্রামের বিচারিক হাকিম আদালত পুনঃময়নাতদন্তের নির্দেশ দিলে গত ১০ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন কবর থেকে দিয়াজের লাশ তুলে ঢাকায় পাঠানো হয়।