ইয়াসের জোয়ারে লবণ বেড়ে হালদায় ডিম সংগ্রহে হতাশা

কামাল সওদাগর হালদা থেকে মাছের ডিম সংগ্রহ করেন বহু বছর ধরে। গত দুই দিনে ছয়টি নৌকা নিয়ে তিনি মাত্র আট বালতি ডিম পেয়েছেন। অথচ গতবারও তিনি এর চেয়ে চারগুণ বেশি ডিম পেয়েছিলেন।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 May 2021, 07:41 AM
Updated : 27 May 2021, 07:41 AM

চট্টগ্রামের রাউজান ও হাটহাজারী এলাকায় দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে বুধবার রাতে ডিম ছেড়েছে কার্প জাতীয় মা মাছ। তবে নদীতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় এবার ডিমের পরিমাণ কমে গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৃষ্টি কম হওয়ার পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে জোয়ারে বেশি পরিমাণে লোনা পানি হালদায় ঢুকে পড়েছে এবার, যার প্রভাব পড়েছে ডিম ছাড়ার ক্ষেত্রে। 

প্রতি বছর বর্ষা শুরুর আগে আগে অনুকূল পরিবেশ তৈরি হলে মা মাছ হালদায় ডিম ছাড়ে। তবে পুরোদমে ডিম ছাড়ার আগে নমুনা ডিম ছেড়ে দেখে নেয় পানির পরিস্থিতি অনুকূল কি না।

মঙ্গলবার রাত ১২টার পর সেই নমুনা ডিম ছাড়ে কিছু মাছ। কিন্তু বুধবার সারাদিন নদীর বিভিন্ন অংশে নৌকা নিয়ে অবস্থান করেও হতাশ হতে হয় ডিম সংগ্রহকারীদের। বুধবার দুপুরের দিকেও কিছু নমুনা ডিম মেলে। পরে রাত সাড়ে ১২টার দিকে কার্প জাতীয় মা মাছ হালদায় ডিম ছাড়া শুরু করে।

ওই সময় থেকে প্রায় ৩৫০টি নৌকা নিয়ে দেড় হাজারের মত সংগ্রহকারী হালদায় মাছের ডিম সংগ্রহ শুরু করেন। বৃহস্পতিবার সকাল ৭টার মধ্যেই ডিম সংগ্রহ শেষ হয়ে যায়।

বর্ষীয়ান ডিম সংগ্রহকারী কামাল সওদাগর বলেন, নদীর গড়দুয়ারা, নয়াহাট, আজিমের ঘাট ও পোড়াকপালি স্লুইসসহ উজানের দিকের অংশে ডিম মিলেছে। কিন্তু ভাটির দিকে তেমন পাওয়া যায়নি।

“গতরাতে শেষ ভাটায় মা মাছ ডিম ছাড়ে। পানিতে লবণ খুব বেশি। তাই ডিম দিলেও পরিমাণে কম। আজ যদি ঝড়বৃষ্টি হয় তাহলে আবার ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা আছে।” 

নদীর হাটহাজারী ও রাউজান অংশের আজিমের ঘাট, অংকুরি ঘোনা, কাগতিয়ার মুখ, গড়দুয়ারা নয়াহাট, রাম দাশ মুন্সির ঘাট, মাছুয়া ঘোনা ও সত্তার ঘাট অংশেও ডিম আহরণ করেছেন সংগ্রহকারীরা।

কামাল সওদাগর জানান, এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে জুনের শুরু পর্যন্ত সময়ে বজ্রসহ বৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢল নামলে উপযুক্ত তাপমাত্রা ও লবণাক্ততায় অমাবস্যা বা পূর্ণিমা তিথিতে নদীতে জোয়ার ও ভাটার সময়ে নিষিক্ত ডিম ছাড়ে কার্প জাতীয় মাছ।

চলতি মৌসুমে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বৃষ্টি হয়নি বলে পাহাড়ি ঢল ছিল না। কাপ্তাই বাঁধ থেকে পানি ছাড়ার পরিমাণও ছিল কম। পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে জোয়ারের সময় কর্ণফুলী নদী হয়ে অতিরিক্ত পরিমাণে লবণাক্ত পানি হালদা নদীতে ঢুকেছে। তাতে লবণাক্ততা ছিল স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি।

হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা ঠিক স্বাভাবিক প্রজনন নয়। ইয়াসের প্রভাবে লবণাক্ততা স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ৭২ গুণ বেশি ছিল।”

এবারের ডিম সংগ্রহের পরিমাণকে ‘মোটামুটি’ বলছেন এই বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, “আজিমের ঘাট, গড়দুয়ারা, মাছুয়াঘোনার দিকে ডিম তুলনামূলক ভালো পাওয়া গেছে। তথ্য সংগ্রহ চলছে। পরে জানাতে পারব কী পরিমাণ ডিম এবার পাওয়া গেছে।”

হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রুহুল আমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওয়াসা এবং হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির তথ্য অনুযায়ী এবার অনেক বেশি লবণাক্ততা ছিল নদীতে।

“পারিপার্শ্বিকতার কারণে এটা অনেকটা জোর করে ডিম ছাড়া বলা যায়। ডিম কাঙ্ক্ষিত মানের ধারে কাছেও নেই। সংগ্রহকারীরা হতাশ হয়েছেন। সংগ্রহ করা ডিম হ্যাচারিতে নেওয়া হয়েছে। সেখানে ডিম ফুটতেও শুরু করেছে।” 

চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এবার ঘূর্ণিঝড়ের সময় ছিল পূর্ণিমা তিথি। ফলে জোয়ারের সময় হালদায় লবণ পানি বেশি ঢুকেছে। আবার এ মৌসুমে বৃষ্টি হয়নি, কাপ্তাই বাঁধ থেকে পানি ছেড়েছে খুব কম। ফলে হালদার পানিকে লবণের ভারসাম্য ছিল না।

তিনি জানান, লবণাক্ততা বেড়ে প্রতি লিটারে ৩১০০ মিলিগ্রামে উঠেছে এবার। অথচ উপকূলীয় এলাকায় এই মান প্রতি লিটারে ৬০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য। পরিশোধনের পর খাবার পানিতে এর পরিমাণ লিটারে ১০ মিলিগ্রামে রাখতে হয়। লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় চট্টগ্রাম ওয়াসার দৈনিক পরিশোধন ৪৬ কোটি লিটার থেকে ৪০ কোটি লিটারে নামিয়ে আনতে হয়েছে।

আরিফুল ইসলাম বলেন, “কাপ্তাই থেকে পানি ছাড়া না হলে হালদায় লবণাক্ততা আরও বাড়বে। নদীতে লবণ পানি ঢুকছে সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। শুধু একদিন ভাবলে হবে না। কর্ণফুলীকে সাথে নিয়ে ভাবতে হবে। হালদার ভাটিতে যে অংশ থেকে ওয়াসা পানি উত্তোলন করে, সেখানে মূলত কর্ণফুলীর পানিই থাকে। কাপ্তাই লেক ড্রেজিং করা জরুরি।”

গতবছর এ মৌসুমে হালদা থেকে সাড়ে ২৫ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করার কথা জানিয়েছিল জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়, যা ছিল ২০০৬ সালের পর সর্বোচ্চ। ২০০৬ সালে ৩২ হাজার ৭২৪ কেজি ডিম পাওয়া যায়।

২০১৯ সালের ২৫ মে রাতে মা মাছ ডিম ছাড়ার পর প্রায় ১০ হাজার কেজি ডিম থেকে ২০০ কেজি রেণু মিলেছিল। ৮০ হাজার টাকা কেজি দরে ওই রেণুর বাজার মূল্য ছিল প্রায় এক কোটি ৬০ লাখ টাকা।

এর আগে ২০১৮ সালের ২০ এপ্রিল ২২ হাজার ৬৮০ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়, যা থেকে রেণু মিলেছিল ৩৭৮ কেজি।

হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ২২ এপ্রিল ১৬৮০ কেজি ডিম পাওয়া যায় হালদায়। তার আগের বছর ২ মে নমুনা ডিম মেলে ৭৩৫ কেজি। ওই বছর তিনবার নমুনা ডিম দিলেও আর ডিম ছাড়েনি মা মাছ।

২০১৫ সালের ২০ এপ্রিল ও ১২ জুন দুই দফায় মোট ২৮০০ কেজি; ২০১৪ সালের ১৯ এপ্রিল ১৬৫০০ কেজি, ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল ৪২০০ কেজি এবং ২০১২ সালে ২১২৪০ কেজি ডিম মিলেছিল হালদায়।