বাঁচার তাগিদে অনেকেই ব্যবসায় ঝাঁপ নামিয়ে চলে গেছেন অন্য পেশায়; নতুন করে কেউ যুক্তও হচ্ছেন না এই কাজে।
Published : 28 Mar 2024, 07:23 AM
পোশাকে জারদৌসি-কারচুপির কাজের জন্য পরিচিত চট্টগ্রামের খুলশীর ঝাউতলা বিহারী কলোনি এলাকা।
কাপড়ে সুঁই-সুতায় হাতের নিপুণ কারুকাজে জরি, সুতা, চুরি, চুমকি বসিয়ে মোহনীয় নকশা ফুটিয়ে তোলেন এখানকার কারিগররা। যদিও এখন কাজটি করেন গুটিকয়েকজন কারিগর।
যত দিন যাচ্ছে, ততই যেন ছোট হয়ে আসছে শৈল্পিক এই পেশাটি। যন্ত্রে তৈরি নকশাদার পোশাকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকতে পারছে না হাতের কাজের পোশাক।
বছরে দুই ঈদের সময় কিছুটা ব্যস্ততা থাকলেও অন্য সময়ে কাজই থাকে না তাদের কারচুপি কারিগরদের। বাধ্য হয়ে বাঁচার তাগিদে অনেকেই ব্যবসায় ঝাঁপ নামিয়ে চলে গেছেন অন্য পেশায়; নতুন করে কেউ যুক্তও হচ্ছেন না এই কাজে।
এ পেশার সাথে জড়িতদের ভাষ্য, স্বাধীনতার পরপরই বন্দর নগরীর ঝাউতলা, জালালাবাদ, ফিরোজ শাহ ওয়্যারলেস এলাকায় মূলত বিহারী সম্প্রদায়ের লোকজন এ কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়।
সেখানকার বুটিক হাউসের মালিক ও কারিগরদের ভাষ্য, এক সময়ে ঝাউতলা বিহারী কলোনি এলাকায় শতাধিক কারখানা ছিল; কাজ করতেন কয়েক হাজার কারিগর।
এখন ঈদের মৌসুমে কাজ চলে ২০/২৫টি কারখানায়, বছরের অন্য সময়ে সচল থাকে তার অর্ধেক।
বাজারে কমদামি ভারতীয় পোশাকের দাপটের কারণেই মূলত এই পেশা হারাতে বসেছে বলে মনে করেন এর সঙ্গে জড়িতরা।
ঝাউতলা স্টেশনের ‘পাপ্পু বুটিকস হাউস’ এর মালিক খালিদ জাফর পাপ্পু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাজারে অনেক ইন্ডিয়ান পোশাক আসছে। সেগুলো মেশিনে তৈরি, আর আমাদের কাজ হাতের। যার কারণে সেগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে পেরে উঠা সম্ভব হচ্ছে না।”
তিনি আরও বলেন, “ভারতে কাঁচামাল ও কাপড়ের দাম কম, শ্রমিকদের বেতনও কম দিতে হয়। কিন্তু সেটা আমাদের এখানে সম্ভব হবে না। হাতের কাজের অনেক পরিশ্রম।
“সব মানুষতো আর কাজের গুণগত মান বোঝে না। ইন্ডিয়ান পোশাকগুলোর দাম কম হওয়ায় বেশিরভাগ মানুষ সেগুলোর দিকে ছুটছে। কিন্তু মালামালের দাম, মজুরিসহ সব মিলিয়ে আমাদের কাপড়গুলোর দাম পড়ে বেশি।”
তবে মানের কদর বোঝে, এমন অনেকে এখনো কাপড় নিয়ে আসেন বলে জানান পাপ্পু।
চল্লিশোর্ধ্ব পাপ্পু জানান, ১৪/১৫ বছর বয়সে তিনি এ কাজে আসেন বন্ধুর সঙ্গে। কয়েক বছর কাজ শিখে নিজেই কারখানা চালু করেন। প্রায় ২৫ বছর ধরেই নিজের কারখানায় কাজ করছেন। তবে আগের মত করে কাজের জৌলুস নেই বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, “নিজের কারখানা ১৪/১৫ বছর আগে বড় ছিল, এখন ছোট করে ফেলেছি। ঈদের পরে তো কাজ কম, আর লোকজনও পাওয়া যায়না। অনেকেই এ কাজে আসে, আবার কাজ কমে গেলে অন্য কাজে চলে যায়। তখন আর সেই পেশা থেকে ফিরে আসতে পারে না। এ কারণে অনেকেই এখন এ কাজে আসছে না।”
পাপ্পুর কারখানায় ১০ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন আসিফ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি জানান, আগে এখানে ২০ জনের মত কারিগর কাজ করত। এখন আছে তিনজন।
“আমার বয়স যখন ১৪ বছর তখন বাবা-মা আমাকে এখানে কাজে দিয়েছিল। অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের জোর করে কাজে পাঠাত শেখার জন্য। কিন্তু এখন এ কাজ করে চলা দায়, তাই কেউ একাজের দিকে পাঠায় না, অন্য কাজে পাঠিয়ে দিচ্ছে।”
আসিফ আরও জানান, অনেকেই কাজ শিখে নতুন কারখানা চালু করছে, কিন্তু কাজের অভাবে বেশিদিন চালু রাখতে না পেরে বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে।
“আমাদের কারখানায়ও অনেক কাজ কমে গেছে। তবে কয়েক বছর ধরে কিছু বোরকার কাজ হচ্ছে,” বলেন কারিগর আসিফ।
ঈদে শাড়ি, থ্রি-পিস, পাঞ্জাবির কাজ হলেও অন্যসময়গুলোতে এসব কারখানায় শুধু বোরকার কাজ হয়।
একই কারখানায় কাজ করেন শাকিল নামে আরেকজন কারিগর।
তিনি বলেন, “সাত আট বছর কাজ শিখেছিলাম। কিন্তু আয় রোজগার কম হওয়ায় মাঝখানে ওয়ার্কশপে কাজ করতাম। পাঁচ বছর সেখানে কাজ করে আবার এখানে আসলাম। সব কারখানায় তো কাজ নাই। তাই নতুন কেউ এ কাজে আসতে চায় না।”
বিহারী কলোনির চয়েস বুটিকস হাউসের মালিক জালাল উদ্দিন বলেন, কয়েকটি কারখানায় সারাবছর কাজ থাকলেও অনেক কারখানায় থাকে না। ঈদের সময় বেশি কাজ থাকে।
“যেসব কারখানায় বছরের অন্য সময়ে কাজ থাকে না তারা কারিগরদের বেতন দিতে পারে না। ওই কারণে অনেকেই এখন এ কাজে না এসে গার্মেন্টেসের দিকে চলে যায়।”
ঝাউতলা সর্দার বাহাদুর লেইনের আনুশা বুটিকস হাউসে কাজ করেন মো. রুবেল। তিনিও কথা বলেছেন পাপ্পু ও আসিফের সুরে।
তিনি বলেন, ভারতীয় কাপড়ের মধ্যে আমাদের এ কাজ টিকে থাকতে পারছে না। আগে অনেকেই এ কাজ করলেও এখন তেমন কেউ এ পেশায় আসতে চান না। কিছু কিছু ঘরে নারীরা অল্প কাজ করলেও আগের মতো কারো আগ্রহ নেই।”