“শ্রেণিকক্ষে বাধ্যতামূলক উপস্থিতির বিষয়টি না থাকায় শিক্ষার্থীরা ক্লাস চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে,” বলেন উপ-কমিশনার মঞ্জুর মোর্শেদ।
Published : 24 Mar 2024, 07:55 PM
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ‘বাধ্যতামূলক না হওয়ায়’ কিশোর অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে বলে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের এক জরিপে উঠে এসেছে।
নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিতি না থাকার কারণে শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে অনীহা সৃষ্টিসহ ৯ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার চিত্র তুলে আনা হয়েছে প্রতিবেদনে। পাশাপাশি বাধ্যতামূলক উপস্থিতি নিশ্চিত করার গুরুত্ব এবং পাশের দেশের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
কিশোর অপরাধ থেকে শিক্ষার্থীদের দূরে রাখতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ন্যূনতম ৭০ শতাংশ উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা এবং উপস্থিতি নিশ্চিতের জন্য অভিভাবকদের কাছে ক্ষুদে বার্তা পাঠানোর পদ্ধতি চালুসহ পাঁচটি সুপারিশও করা হয়েছে এ প্রতিবেদনে।
কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিচালিত জরিপে পুলিশ দেখেছে, ৭০ শতাংশ ক্লাসে উপস্থিত- এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুবই কম।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের বিশেষ শাখার উপ-কমিশনার মুহাম্মদ মঞ্জুর মোর্শেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে দেখে গেছে কিশোররা বিভিন্ন ধরনের অপরাধের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। কেন শিক্ষার্থীরা অপরাধে দিকে ঝুঁকছে তার কারণে খুঁজতে গিয়ে মূলত এ জরিপ পরিচালনা করা হয়।
“যাদের পড়ালেখা করার কথা, তারা অপরাধে জড়ানোর মত সময়টা কোথায় পাচ্ছে-সেটা খুঁজতে গিয়ে পেলাম, অনেকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন না। শ্রেণিকক্ষে বাধ্যতামূলক উপস্থিতির বিষয়টি না থাকায় শিক্ষার্থীরা ক্লাস চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে।”
জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালের ৩ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা পরিপত্রে এসএসসি পরীক্ষার জন্য নির্বাচনি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ন্যূনতম ৭০ শতাংশ উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা হয়। নির্বাচনি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলেও ৭০ শতাংশ ক্লাসে উপস্থিত থাকলে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ রাখা হয়েছিল এই নিয়মে। পরবর্তীতে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে ওই বছরের ৩ অগাস্ট আদেশটি বাতিল করা হয়।
শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতি বাধ্যবাধকতা না থাকার প্রভাব হিসেবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ক্লাসে উপস্থিত না থেকে শিক্ষার্থীরা কথিত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হয়ে কেউ যখন অন্য সহপাঠীর ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে, তখন স্বাভাবিক ভাবেই অন্যান্য শিক্ষার্থীও ‘গ্যাং সদস্য’ হতে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
কথিত বড় ভাইদের প্ররোচনায় প্রভাবিত হয়ে কিশোর বয়সের ‘হিরোইজম’ দেখানোর জন্য এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা পর্নোগ্রাফি ও যৌন কর্মকাণ্ডের মত অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
এও বলা হয়েছে, পারিবারিক বিশৃঙ্খলাজনিত এবং ‘ব্রোকেন ফ্যামিলির’ সন্তানদের মানসিক বিকাশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতির বাধ্যবাধকতা না থাকায় তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
ক্লাস না করে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন পার্ক, বিনোদন কেন্দ্র, রেস্টুরেন্ট, ডার্ক রেস্টুরেন্ট, মার্কেটে এবং রাজনৈতিক বিভিন্ন কর্মসুচিতে স্কুল কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
কথিত কিশোর গ্যাং লিডার এবং রাজনৈতিক নেতার সংস্পর্শে আসায় শিক্ষার্থীদের আচরণ ও চিন্তার জগতে নেতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যেটি শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রভাব পড়ছে।
শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত না থেকে শিক্ষার্থীদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ সাইবার জগতে বেশি সময় দেওয়ায় অনলাইন গেইম, জুয়া, হরর মুভি এবং পশ্চিমা সংস্কৃতিতে আসক্ত হচ্ছে; সিগারেট ও মাদকাসক্ত হয়ে টাকা জোগারের জন্য চুরি, ছিনতাই, মাদক বিক্রিতেও জড়িয়ে পড়ছে।
এছাড়াও শ্রেণিকক্ষে অনুপস্থিতির কারণে শিক্ষার্থীরা স্কাউটিং, চিত্রাঙ্কন, সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে আগ্রহ হারাচ্ছে এবং কোচিং ও প্রাইভেটের প্রতি বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বাধ্যতামূলক উপস্থিতি নিশ্চিতের গুরুত্ব তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, বাধ্যতামূলক ন্যূনতম ৭০ শতাংশ উপস্থিতি নিশ্চিত করা গেলে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে শিক্ষার্থীদের যেখানে-সেখানে ঘোরাফেরা এবং সময় কাটানোর প্রবণতা তৈরির সুযোগ কমে যাবে।
শিক্ষার্থীরা দৈনিক ৫-৬ ঘণ্টা শিক্ষা ও আনুষাঙ্গিক কাজে সম্পৃক্ত থাকতে বাধ্য হলে তা মানসিক বিকাশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। কিছু শিক্ষার্থী ক্লাসে উপস্থিত না থেকেও পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেলে অন্যরাও ক্লাসের প্রতি আগ্রহ হারাবে বলে পুলিশের মূল্যায়ন।
এছাড়াও ক্লাসে উপস্থিতি নিশ্চিত করা গেলে শিক্ষার্থীরা খেলাধূলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বেশি সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পাবে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
৭০ শতাংশ ক্লাসে উপস্থিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা নগণ্য
সমন্বিত, বালক এবং বালিকা বিভাগের তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর পরিচালনা করা এ জরিপে দেখা গেছে শ্রেণিকক্ষে ৭০ শতাংশ উপস্থিতির সংখ্যা খুবই কম।
সমন্বিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির দ্বাদশ শ্রেণির ৩৮৯ জন শিক্ষার্থীর ওপর করা জরিপে দেখা যায়, ৭০ শতাংশ থেকে তার উপরে উপস্থিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮১ জন, যা শতকরা হিসেবে ২১ শতাংশ।
বালিকা বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ১১৬ জন শিক্ষার্থীর ওপর করা জরিপে দেখা গেছে ৭০ শতাংশের উপরে উপস্থিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৩ জন, যা শতকরা হিসেবে ২৮ শতাংশ।
বালক বিভাগের একটি স্কুলে দশম শ্রেণির ২৭৬ শিক্ষার্থীর ওপর করা জরিপে দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ উপস্থিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৫ জন, যা মোট শিক্ষার্থীর ১৩ শতাংশ।
শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক ক্লাসে উপস্থিত রাখতে পুলিশের এ প্রতিবেদনে পাঁচটি সুপারিশও করা হয়। যার মধ্যে একটি ৭০ শতাংশ উপস্থিতি না থাকলে শিক্ষার্থীদের নির্বাচনি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ না রাখা।
৭০ শতাংশের নিচে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের বিষয়ে শিক্ষা বোর্ডের সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা রাখা। ধারাবাহিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা এবং উপস্থিত শিক্ষার্থীদের বিষয়ে অভিভাবকের কাছে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো।
পুরানো খবর: