বাংলাদেশের পারফরম্যান্স গড়পড়তা মানের নিচে: গিলক্রিস্ট

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি ক্রিকেটার কথা বললেন বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স, অস্ট্রেলিয়ার ব্যর্থতা ও প্রাসঙ্গিক আরও কিছু নিয়ে।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিঅ্যাডিলেইড থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Nov 2022, 03:09 PM
Updated : 7 Nov 2022, 03:09 PM

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের জন্মের বেশ আগে থেকেই অ্যাডাম গিলক্রিস্টের ব্যাটিংয়ে ছিল টি-টোয়েন্টি ঘরানার ছাপ। ক্যারিয়ারের শেষভাগে অবশ্য অস্ট্রেলিয়ার হয়ে টি-টোয়েন্টি ১৩টি খেলতে পারেন তিনি। পরে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষে ওই বয়সেও বেশ সফল হন আইপিএলে। আগ্রাসী ব্যাটিং দিয়ে ক্রিকেটের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার নায়ক এবারের বিশ্বকাপে আছেন ধারাভাষ্যকার হিসেবে। অ্যাডিলেইড ওভালে রোববার বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচে ধারাভাষ্য দেওয়ার ফাঁকে ও ম্যাচের পর মিলিয়ে অস্ট্রেলিয়ান এই কিংবদন্তি কিছুটা সময় দিলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে, কথা বললেন বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স, অস্ট্রেলিয়ার ব্যর্থতা ও আরও কিছু প্রসঙ্গে। 

বাংলাদেশের পারফরম্যান্স কেমন দেখলেন? 

অ্যাডাম গিলক্রিস্ট: আমার মনে হয়, তারা গড়পড়তা মানের চেয়ে একটু নিচেই ছিল। হয়তো তারাও তা উপলব্ধি করবে। লড়াইয়ের সুযোগ তারা নিজেদের দিয়েছিল। এই ম্যাচে (পাকিস্তানের বিপক্ষে) আসার সময় তারা হয়তো আশা করতে পারেনি যে সেমি-ফাইনালে ওঠার সুযোগ আসবে। তাদের জন্য এটা ইমোশনাল দিন। তবে মৌলিক কিছু ভুল তারা করেছে (খেলায়), যা নিয়ে তারা হয়তো হতাশই হবে। 

ভুলগুলো কি কি? বলা যায় কয়েকটি? 

গিলক্রিস্ট: এই ম্যাচের কথা বললে (পাকিস্তানের বিপক্ষে), ব্যাটিংয়ের প্রথম ভাগে তারা ভালো ভিত গড়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় ভাগে ঝাঁক ধরে উইকেট হারিয়েছে। ব্যাটিংয়ে এভাবে জোড়ায় জোড়ায় উইকেট হারালে চলবে না। জুটি গড়তে হবে, গুছিয়ে নিতে হবে। তারা তা করতে পারেনি। পাকিস্তানের বোলিং দুর্দান্ত ছিল অবশ্য। 

বোলিংয়ে বাংলাদেশ খুব খারাপ করেনি। তবে ফিল্ডিংয়ে কিছু ভুল করেছে। ক্যাচিং, থ্রোয়িংয়ে কিছু ঘাটতি ছিল, মিস ফিল্ডিং হয়েছে। হয়তো একটু বেশিই মরিয়া আর ব্যগ্র ছিল তারা। অতি উত্তেজনায় ভুল করে ফেলেছে। 

গোটা টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের পারফরম্যান্সকে যদি মূল্যায়ন করতে বলা হয়? 

গিলক্রিস্ট: শুধু বাংলাদেশ নয়, বেশ কিছু দলের জন্যই এই টুর্নামেন্ট আসলে চ্যালেঞ্জিং ছিল। ব্যস্ত সূচি, বৃষ্টির হানা, একেক শহরে কন্ডিশনের এতটা ভিন্নতা, মাঠের ডাইমেনশন, সব মিলিয়েই। এতে অবশ্য টুর্নামেন্ট ইন্টারেস্টিং হয়ে উঠছে। তবে অনেকের জন্যই মানিয়ে নেওয়া কঠিন হয়েছে, বাংলাদেশের জন্যও। 

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শেষভাগে ভাগ্যকে পাশে পেয়েছে বাংলাদেশ। ভারতের বিপক্ষে শেষ দিকে অবশ্য আবার উল্টো, ভাগ্যকে সঙ্গে পায়নি। তাদের বিশ্বকাপ এরকমই ছিল, ভালো-মন্দের মিশেল। নিজেদের দিনে বিশ্বের সেরা দলগুলোকে হয়তো হারাতে পারে তারা। তবে সেটিকে ধারাবাহিকতায় রূপ দিতে হবে। সেই আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে যেন নিয়মিতভাবে সেটি করতে পারে। 

অস্ট্রেলিয়ার জন্য এই বিশ্বকাপ কতটা হতাশার? 

গিলক্রিস্ট: খুবই হতাশাজনক। নিশ্চিতভাবেই প্রচণ্ড হতাশ তারা এবং আমার তা বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই, ওরাই অনুভব করবে। একদম শুরু থেকেই মোমেন্টাম পায়নি ওরা। ছন্দ খুঁজে ফিরেছে। আবহাওয়ার বাধাও এসেছে পরে। প্রথম ম্যাচের পর আর অবশ্য হারেনি, সেদিক থেকে ভালোই করেছে। তবে যা ক্ষতি হওয়ার, আগেই হয়ে গেছে। 

অবশ্যই ওরা খুবই হতাশ হবে এবং সামনে তাকিয়ে, দল নিয়ে কিছু সিদ্ধান্ত তাদেরকে নিতে হবে। 

কেন তাদের এই অবস্থা হলো এবার? 

গিলক্রিস্ট: বেশ কিছু কারণ আছে। একটা কারণ, বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটার জ্বলে উঠতে পারেনি। অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চ বিশ্বকাপের আগে থেকেই ছন্দ হারায়। বিশ্বকাপেও নিজেকে আর ফিরে পায়নি সেভাবে। গ্লেন ম্যাক্সওয়েলও প্রত্যাশা অনুযায়ী খেলতে পারেনি। 

অস্ট্রেলিয়ার খেলায় সাধারণ যে আগ্রাসন, মসৃণতা ও গতি দেখা যায়, তা পাওয়া যায়নি এবার। ফিঞ্চ টুর্নামেন্টের আগে বলেছিল, তারা বেশ ক্লান্ত হয়ে বিশ্বকাপে আসছে। এটাও বেশ কৌতূহল জাগানিয়া ব্যাপার। সব মিলিয়ে টুর্নামেন্টের আগে আবহ আর প্রস্তুতি হয়তো খুব আদর্শ ছিল না। 

আপনি দল নিয়ে সিদ্ধান্তের কথা বলছিলেন। ফিঞ্চকে কি সামনেও অধিনায়ক হিসেবে দেখছেন? ডেভিড ওয়ার্নারও খুব ভালো খেলেননি বিশ্বকাপে। তাকেও কি সামনে টি-টোয়েন্টি দলে দেখছেন? 

গিলক্রিস্ট: অ্যারন (ফিঞ্চ) তো ওয়ানডে ছেড়েই দিয়েছে। টি-টোয়েন্টিতেও নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে হয়তো সিদ্ধান্ত সে-ই নেবে। আমার বলার কিছু নেই। নিজেই ভালো বুঝবে। 

ওয়ার্নার আরও খেলতে পারে বলেই আমার ধারণা। তার নেতৃত্বের যে নিষেধাজ্ঞা আছে, তা তুলে না নেওয়া হলে আমি অবাক হব। আমার ধারণা, তুলে নেওয়া হবে। অবশ্যই বলছি না যে তাকেই অধিনায়ক করা হবে বা করা উচিত। তবে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে বলেই আমার ধারণা। যদিও, তার ক্যারিয়ার শেষ ভাগে আছে। সেক্ষেত্রে অন্য কাউকেও অধিনায়ক করা হতে পারে, যাকে লম্বা সময় পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। 

একটা বিশ্বকাপ শেষে যা হয়, অনেক কিছু বদলে যেতে পারে। অভিজ্ঞ ও সিনিয়র কজন ক্রিকেটার নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তরুণ অনেকেই আসতে পারে। পরের বিশ্বকাপ দুই বছর পর। অনেক কিছু হতে পারে। অনেকে নিজে থেকে সরে যেতে পারে। নির্বাচকরাও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আমিও কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করব, কী হয় সামনে। 

সেমি-ফাইনাল লাইন-আপ হয়ে গেছে। ফাইনালে কোন দুই দলকে দেখছেন? 

গিলক্রিস্ট: আমি জানি না… এখানে যে কোনো দল যে কাউকে হারাতে পারে। এই পর্যায়ে এসে আসলে ফেভারিট বলে কিছু থাকে না। দক্ষিণ আফ্রিকার কথাই ধরুন। ওদেরকে দেখে মনে হচ্ছিল, এই দলকে হারানো কঠিন। মনে হচ্ছিল ওরাই শিরোপা জিততে পারে। কিন্তু তাজম্যানিয়ায় একটি ম্যাচে বৃষ্টির কারণে জিততে পারল না, আজকে হেরে গেল…। 

কাজেই কিছু অনুমান করা কঠিন। সেমি-ফাইনালে ওঠা চার দলেরই সম্ভাবনা আছে। পাকিস্তান দুই ম্যাচ হারার পর সবাই মনে করেছিল, ওরা বাদ পড়ে যাবে। কিন্তু ঠিকই টিকে গেছে। নেদারল্যান্ডসের জয়ের সুযোগ নিয়ে আজকে সেমি-ফাইনালে উঠে গেছে। এটাই পাকিস্তান! 

সব দলের জন্যই শুভ কামনা। আমি জানি না কে জিতবে, আমিও কৌতূহলী হয়ে অপেক্ষা করব। 

আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শেষ ভাগে আপনি টি-টোয়েন্টি খেলেছেন। কিন্তু আপনার ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে যদি টি-টোয়েন্টি পেতেন, আপনার খেলার যে ধরন, নিশ্চয়ই রাজত্ব করতেন এই সংস্করণে! 

গিলক্রিস্ট: আমি জানি না… তবে আমার জন্য তো টি-টোয়েন্টি হোক বা টেস্ট কিংবা ওয়ানডে, খেলার ধরন প্রায় একইরকম। ইতিবাচক, আগ্রাসী… একটা পথই জানা। কাজে লেগে গেলে এটা দারুণ, কাজে না লাগলে দৃষ্টিকটূ। তবে ওই সময় টি-টোয়েন্টি পেয়ে নিশ্চয়ই আমি আরও কিছু নতুন স্কিল শেখার চেষ্টা করতাম। 

আমার ক্যারিয়ার যখন শেষের পথে, তখন নতুন কিছু উদ্ভাবনী শট আসতে শুরু করল। আমার সময় এসব পেলে… ইন্টারেস্টিং হতো। 

টি-টোয়েন্টি খেলতে আমি উপভোগ করতাম। দারুণ মজা পেয়েছি। টি-টোয়েন্টি দিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করতে পারাও ছিল দারুণ। 

টানা তিনটি ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিতেছেন। টি-টোয়েন্টিতে একটি বিশ্বকাপ খেলতে পেরেছেন আপনার ক্যারিয়ারের শেষ দিকে। কী মনে হয়, সেরা সময়ে টি-টোয়েন্টি পেলে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে পারতেন? 

গিলক্রিস্ট: একটা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলেছি, খুব ভালো করিনি আমরা। তখন ক্যারিয়ার শেষের পথে…তবে সেরা সময়ে পেলেও যে কী হতো, বলা কঠিন। কারণ, ইটস আ গেম অব চান্সেস। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট লটারির মতো। যে কোনো কিছু হতে পারে। এ কারণেই এই সংস্করণ ইন্টারেস্টিং। 

প্রথম আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচটায় আপনি খেলেছেন… 

গিলক্রিস্ট: খুব একটা ভালো করিনি সেই ম্যাচে… (হাসি)। 

কিন্তু অস্ট্রেলিয়া জিতেছিল। তখন এটা অনেকটা মজার ক্রিকেট ছিল। ভাবতে পেরেছিলেন, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট এরকম বিশাল কিছু হয়ে উঠবে? 

গিলক্রিস্ট: তখন এটা নিয়ে নিশ্চিত ছিলাম না। তবে এখন বুঝতে পারি, কেন এটা এত বড় হয়ে উঠেছে। ক্রিকেটীয় অনিশ্চয়তা এই সংস্করণে আরও বেশি। দলগুলির ব্যবধান এখানে অনেক কমে আসে। বিনোদনের খোরাকও এখানে অনেক বেশি। 

অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের জন্য এই বছরটা খুবই কষ্টের। রডনি মার্শ, শেন ওয়ার্ন, অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসের বিদায়ে শোকের রেশ এখনও রয়ে গেছে। আপনি কতটা সামলে উঠতে পেরেছেন? 

গিলক্রিস্ট: এখনও কিছুটা শকড। এখনও যেন বিশ্বাস হতে চায় না, ওরা সবাই চলে গেছে। এবারের গ্রীষ্ম খুব আবেগময় হবে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট সমাজের জন্য। কারণ, ওদের নাম বারবার ঘুরেফিরে আসবে। আসতে বাধ্য। এবং আমার মনে হয়, ওদের কথা বারবার মনে করায় কোনো সমস্যাও নেই। কারণ, ওদের স্পিরিট সবসময়ই জীবন্ত থাকবে। 

আপনি তো তিনজনেরই বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন…

গিলক্রিস্ট: আমি ছিলাম, আরও অনেকেই ওদের ঘনিষ্ঠ ছিল। পরস্পরের কষ্ট ভাগাভাগি করব আমরা, ওদের স্পিরিটকে তুলে ধরব বারবার এবং ওদের স্মৃতি হৃদয়ে লালন করব সবসময়।