ইংল্যান্ডের জয়ের হাসির অপেক্ষায় অস্ট্রেলিয়ার মাইক হাসি

‘মি. ক্রিকেট’ নামে পরিচিত সাবেক অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান এবার বিশ্বকাপে কাজ করছেন ইংল্যান্ডের কোচিং স্টাফে।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিঅ্যাডিলেইড থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Nov 2022, 05:06 PM
Updated : 9 Nov 2022, 05:06 PM

ক্রিকেটারদের অনুশীলন ও অধিনায়কের সংবাদ সম্মেলন তখন শেষ। অ্যাডিলেইড ওভালের ড্রেসিং রুম থেকে বেরিয়ে হনহন করে হেঁটে যাচ্ছিলেন মাইক হাসি। তার কাছে গিয়ে পরিচয় দিয়ে কথা বলার একটু সময় চাওয়ার পর সাবেক অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান বললেন, “খুব ব্যস্ত আছি, এক্ষুনি একটি মিটিং আছে…।” আরেকটু অনুরোধের পর অবশ্য একটু সময় দিলেন, “ঠিক আছে, কয়েক মিনিটে সেরে ফেলুন…।” 

তিনি বের হলেন ইংল্যান্ডের ড্রেসিং রুম থেকে। গায়ে ইংল্যান্ডের ট্রেনিং জার্সি। তার তাড়া ইংল্যান্ডের টিম মিটিং নিয়ে। অথচ তিনি অস্ট্রেলিয়ান গ্রেট। কিন্তু ক্রিকেটে পেশাদার জগতে পরিচয়ও পাল্টায় দ্রুত। অস্ট্রেলিয়ার হাসি যেমন অস্ট্রেলিয়ার মাঠ থেকে মাঠে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যান্ডকে সহায়তা করছেন বিশ্বজয় করতে। এই আসরে তিনি ইংল্যান্ডের কোচিং স্টাফের অংশ। 

নিজ দেশের বিশ্বকাপ থেকে অস্ট্রেলিয়া বিদায় নিয়েছে বেশ আগেই। তবে অনেক অস্ট্রেলিয়ানের বিশ্বকাপ অভিযান এখনও শেষ হয়নি। ফাইনালে জায়গা করে নেওয়া পাকিস্তানের ‘মেন্টর’ সাবেক অস্ট্রেলিয়ান ওপেনার ম্যাথু হেইডেন। সেমি-ফাইনালে উঠে যাওয়া ইংল্যান্ডের কোচিং স্টাফে আছেন মাইক হাসি। 

ইংল্যান্ডের সীমিত ওভারের দলের প্রধান কোচও একজন অস্ট্রেলিয়ান, ম্যাথু মট। মূলত তার চাওয়া ও উদ্যোগেই এই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের কোচিং স্টাফে যুক্ত করা হয় আরও দুই অস্ট্রেলিয়ান হাসি ও বোলিং কোচ ডেভিড সেকারকে। 

ইংল্যান্ড সেমি-ফাইনালে উঠেছে, মট-হাসি-সেকার ত্রয়ীকে এখনও পর্যন্ত সফল বলতেই হবে। তবে শিরোপা জয় ছাড়া অন্য যে কোনো ফলই যে দলের জন্য ব্যর্থতা, সেই দলের সাফল্যের বিচার করতে হবে তো আরও পরে। আপাতত হাসির ইংল্যান্ড শিবিরে থাকাই দারুণ এক গল্প। অস্ট্রেলিয়ান এক গ্রেট অস্ট্রেলিয়ার মাঠেই চেষ্টা করছেন চিরপ্রতিদন্দ্বী ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপ জেতাতে। 

সেকার-মটরাও আছেন এই দলে। তবে তারা কেউ তো হাসির মতো ‘হাই-প্রোফাইল’ নন! 

অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ৭৯ টেস্টে ১৯ সেঞ্চুরি তার। শেফিল্ড শিল্ড ও কাউন্টি ক্রিকেটে রানের জোয়ার বইয়ে দিলেও টেস্ট ক্যাপ পেতে সময় লেগে যায় তার ৩০ বছর। হারানো সময়টা পুষিয়ে দিতে সময় নেননি একদম। মাত্র ১৬৬ দিনে টেস্টে হাজার রান হয়ে যায় তার। টেস্ট আঙিনায় দুই বছর বিচরণের পরও তার ব্যাটিং গড় ছিল ৮৬। ওয়ানডেতে ২৯ ম্যাচ পর তার গড় নেমে আসে একশর নিচে। 

অমন অবিশ্বাস্য পরিসংখ্যান শেষ পর্যন্ত থাকেনি অবশ্যই। তারপরও ক্যারিয়ার শেষে ৭৯ টেস্টে তার সেঞ্চুরি ১৯টি। ৫১.৫২ গড়ে ৬ হাজারের বেশি রান। ওয়ানডেতেও দারুণ সমৃদ্ধ ক্যারিয়ার। ১৮৫ ম্যাচে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার রান ৪৮ গড়ে। টি-টোয়েন্টি খেলতে পেরেছেন কেবল ৩৮টি। গড় প্রায় ১৩৮, স্ট্রাইক রেট ১৩৬। বলা যায় প্রায় পরিপূর্ণ ব্যাটসম্যান। 

স্বপ্নের মতো এক ডাকনাম পেয়েছিলেন তিনি। এখনও তাকে অনেকে ওই নামেই চেনে, ‘মি. ক্রিকেট।’ অস্ট্রেলিয়ান মট-সেকারদের চেয়ে তাই এই হাসিকে ঘিরে বাড়তি আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। 

খেলোয়াড়ি জীবনে যারা ছিলেন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী, তাদেরকে কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা দারুণ বলেই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানালেন হাসি। 

“আমি দারুণ উপভোগ করেছি। দারুণ এক দল ছেলে, খুব ভালো আবহ ড্রেসিং রুমে, কঠোর পরিশ্রম করে। কালকে অ্যাডিলেইড ওভালে ভারতের বিপক্ষে বড় ম্যাচ, দারুণ এক উপলক্ষ। বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনাল বলে কথা, ছেলেরা সবাই মুখিয়ে আছে।” 

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালের উপলক্ষ কেমন, হাসির জানা ভালো করেই। ২০১০ বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে যে ইনিংস তিনি খেলেছিলেন, বিশ্বকাপ তো বটেই, টি-টোয়েন্টি ইতিহাসের সেরা ইনিংসগুলির একটি তা। ২৪ বলে অপরাজিত ৬০ রানের ইনিংস খেলেছিলেন সেদিন। তবে সেই ম্যাচ আর ইনিংসটি স্মরণীয় হয়ে আছে তার শেষ ওভারের বীরত্বের জন্য। 

সেন্ট লুসিয়ায় সেদিন জয়ের জন্য শেষ ওভারে ১৮ রান দরকার ছিল অস্ট্রেলিয়ার। সেই সময়ের ভয়ঙ্কর অফ স্পিনার সাঈদ আজমলকে তিন ছক্কা ও এক চার মেরে হাসি অস্ট্রেলিয়াকে ফাইনালে তুলেছিলেন ১ বল বাকি রেখেই। 

সেবার অস্ট্রেলিয়া ফাইনালে হেরে যায় ইংল্যান্ডের কাছে। অনেক অপেক্ষার প্রহর পেরিয়ে অবশেষে গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে প্রথম শিরোপার স্বাদ পায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সফলতম দল। কিন্তু সেই শিরোপা তারা ধরে রাখতে ব্যর্থ দেশের মাঠে। 

প্রতিপক্ষ শিবিরে থেকে যতুটুকু পারা যায়, অস্ট্রেলিয়ার না পারার কারণ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলেন হাসি। 

“প্রথম ম্যাচে নিউ জিল্যান্ডের কাছে এত বাজেভাবে হারার পর ঘুরে দাঁড়ানোর কাজটি কঠিন ছিল। নেট রান রেট অনেক কমে গিয়েছিল। আমি নিশ্চিত, দলের আত্মবিশ্বাসেও চোট লেগেছিল। পরের ম্যাচগুলিতে লড়াই করে তারা ফেরার চেষ্টা করেছে বটে। তবে কঠিন লড়াইয়ের টুর্নামেন্ট এটি, অনেক ভালো দল এখানে। বড় ব্যবধানে জেতাটা এখানে সহজ নয়। অস্ট্রেলিয়াও পারেনি।” 

“তারা হতাশ হবে অবশ্যই। তবে অস্থির হওয়ার কিছু নেই। কঠিন একটি গ্রুপে তারা তৃতীয় হয়েছে। হতাশাজনক, তবে ওরা সামলে নেবে।” 

পেশাদার ভুবনে আসলে আবেগে ভেসে যাওয়া বা কাতর হওয়ার উপায় নেই। নিজ দেশের বিদায়ে হাসির হৃদয়ে মোচড় দেওয়ারই কথা। কিন্তু তিনি রোমাঞ্চিত তার পেশার জায়গার হাতছানিতে। পরদিনই ইংল্যান্ডের সেমি-ফাইনাল, সেটিও ভারতের মতো দলের বিপক্ষে। এই ম্যাচ জিততে পারলে সেটির ওজন ও বিশালত্ব কেমন, হাসির জানা আছে। আপাতত এই ম্যাচ ঘিরেই তার ভাবনা। 

“এই বিশ্বকাপে আমি ইংল্যান্ড দলের অংশ, এটা উপভোগ করছি। ইংল্যান্ড ভালো করছে, আমার চাওয়া থাকবে কালকেও ভারতকে হারাব আমরা। আশা করব, এরপর আরেক ধাপ এগিয়ে যাব। কালকের দিকে তাকিয়ে আছি। গ্যালারি ঠাসা থাকবে, বিলিয়ন বিলিয়ন দর্শক টিভিতে খেলা দেখবে। স্বপ্নের মতো উপলক্ষ, সবাই এসবের অংশ হতে চায়।”