রোমাঞ্চ ছড়ানো ম্যাচে রংপুরকে বিদায় করে ফাইনালে মাশরাফির সিলেট

প্রথমবারের মতো সিলেটের কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি উঠল বিপিএলের ফাইনালে।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Feb 2023, 04:38 PM
Updated : 14 Feb 2023, 04:38 PM

মোহাম্মদ আমির চলে যাওয়ার একজন কার্যকর একজন পেসার হন্যে হয়ে খুঁজছিল সিলেট। ইসুরু উদানাকে এনে আগের ম্যাচে লাভ হয়নি। দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ারের আগে তারা খুঁজে পায় লুক উডকে। দুবাইয়ে আইএল টি-টোয়েন্টি খেলা ইংলিশ পেসার মঙ্গলবার সকালে পা রাখেন ঢাকায়। সন্ধ্যায় ম্যাচ খেলতে নেমে সেই তিনিই সিলেটের জয়ে নায়কদের একজন!

উডের সঙ্গে দুর্দান্ত বোলিং করলেন দেশের তরুণ পেসার তানজিম হাসান সাকিবও। রোমাঞ্চ ছড়ানো ম্যাচে রংপুর রাইডার্সকে ১৯ রানে হারিয়ে বিপিএলের ফাইনালে পৌঁছে গেল সিলেট স্ট্রাইকার্স।

বিপিএলের ৯ আসর মিলিয়ে এই প্রথম ফাইনালে উঠল সিলেটের কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি। সেই সাফল্য পেল তারা বিপিএলের সফলতম অধিনায়কের হাত ধরে। এই নিয়ে পঞ্চমবার ফাইনালে পা রাখলেন অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। আগের চারবারই তিনি উঁচিয়ে ধরেছেন ট্রফি।

বৃহস্পতিবারের ফাইনালে মাশরাফিদের প্রতিপক্ষ কাগজে-কলমে আসরের সবচেয়ে শক্তিশালী দল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স।

শক্তির বিচারে, বিশেষ করে বিদেশি ক্রিকেটারদের নিয়ে এগিয়ে ছিল রংপুরও। তবে দলীয় পাফরম্যান্সে তাদেরকে হারিয়ে দেয় সিলেট।

মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে টস হেরে ব্যাটিংয়ে নামা সিলেটের হয়ে ৪০ ছাড়াতে পারেননি একজনও। কয়েকজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ২০ ওভারে তারা তুলে ফেলে ১৮২ রান। পুঁজি বড় হলেও শেষ পর্যন্ত বড় পার্থক্য গড়ে দেয় উড ও তানজিমের বোলিং। রংপুর থমকে যায় ১৬৩ রানে।

ব্যবধান শেষ পর্যন্ত মোটামুটি বড় হলেও তিন ওভার বাকি থাকতেও ম্যাচ ছিল দোদুল্যমান। সম্ভাবনায় এগিয়ে ছিল রংপুরই। কিন্তু শেষের তিন ওভারে সিলেট ম্যাচ নিয়ে আসে নিজেদের দিকে।

৩৪ রান খরচ করলেও উড নেন গুরুত্বপূর্ণ তিন উইকেট। বিধ্বংসী খেলতে থাকা নিকোলাস পুরানকে থামান তিনি। পরে শেষের আগের ওভারে টানা দুই বলে বিদায় করেন শেখ মেহেদি হাসান ও ডোয়াইন ব্রাভোকে।

ম্যাচে সেরা বোলার ছিলেন নিঃসন্দেহে তানজিম। আঁটসাঁট বোলিংয়ের পাশাপাশি তিনি এনে দেন মহামূল্য দুটি উইকেট। এই ম্যাচের আগে রংপুরে যোগ দেওয়া আগ্রাসী ইংলিশ ব্যাটসম্যান স্যাম বিলিংসকে ফেরান তিনি শুরুতেই। পরে শেষ দিকে নুরুল হাসান সোহানকে ফিরিয়ে তিনি ভেঙে দেন সিলেটের সামনে বাধার দেওয়াল হয়ে থাকা জুটি।  

৪ ওভারে স্রেফ ১৯ রান দিয়ে ২ উইকেট নিয়ে ম্যাচে সেরা ২০ বছর বয়সী এই পেসারই।

সিলেটের শুরুটা ছিল সাবধানী। নাজমুল হোসেন শান্ত ও তৌহিদ হৃদয় প্রথম ৩ ওভারে তোলেন ১৪ রান। তবে পরের ৩ ওভারে আসে ৩০ রান। সেটি অবশ্য মূলত শান্তর ব্যাটিং তোড়ে। পাওয়ার প্লেতে তার রান ছিল ২১ বলে ৩০, হৃদয়ের ১৫ বলে ১৪।

রবিউল হককে ছক্কায় হৃদয় গা ঝাড়া দেওয়ার ইঙ্গিত দিলেও ইনিংসে গতি দিতে পারেননি শেষ পর্যন্ত। আউট হন তিনি ২৫ বলে ২৫ করে।

৫৩ বলে ৬৫ রানের উদ্বোধনী জুটি অবশ্য এর আগেই ভাঙে শান্তর বিদায়ে। শেখ মেহেদি হাসানকে স্লগ সুইপে ছক্কা মারার পরের বলে ক্রিজ ছেড়ে একটু বেরিয়ে এলবিডব্লিউ হন তিনি। তৃতীয় আম্পায়ারের দেওয়া আউটের সিদ্ধান্তে অবশ্য বেশ ক্ষুব্ধ দেখা যায় তাকে। তার শরীরী ভাষা দেখে মনে হচ্ছিল, ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে খেলার ব্যাপারটিতে তার আপত্তি। টিভি রিপ্লেতে যদিও দেখা যায়, ৩ মিটার দূরত্বের সীমার ভেতরেই ছিলেন তিনি। আউট তাই বৈধই ছিল।

৩০ বলে ৪০ করে থামেন শান্ত। এবারের আসরের সর্বোচ্চ স্কোরার তার সংগ্রহ নিয়ে যান ৪৫২ রানে।

ইনিংসে গতিময় করতে তিনে নামা মাশরাফি সফল হন আরও একবার। আগের দিন পাঁচে নেমে ১৭ বলে ২৬ রান করার পর এবার শুরু করেন প্রথম বলে মেহেদিকে ছক্কায়।

জাকির হাসান শুরুটা ভালো করলেও ধরে রাখতে পারেননি (১৩ বলে ১৬)। ২ চার ও ১ ছক্কায় ৬ বলে ১৫ করে আউট হয়ে যান রায়ার্ন বার্লও। কাভার সীমানায় দারুণ ক্যাচ নেন বিলিংস। পরের ওভারে ব্রাভোকে উড়িয়ে মেরে বিদায় নেন মাশরাফিও (১৬ বলে ২৮)। মুশফিকুর রহিম (৫ বলে ৬) পারেননি পরিস্থিতির দাবি মেটাতে।

দ্রুত কিছু উইকেট হারিয়ে সিলেটের রানের গতিতেও ভাটার টান পড়ে। তবে থিসারা পেরেরা ও জর্জ লিন্ডা শেষটা ভালো করেন। পেরেরা করেন ১৫ বলে ২১। শেষ ওভারে দাসুন শানাকাকে দুটি ছক্কা ও ১ চারসহ লিন্ডা অপরাজিত থাকেন ১০ বলে ২১ করে। তাতে সিলেটের রান ছাড়িয়ে যায় ১৮০।

রংপুরের রান তাড়ার শুরুটা হয় হোঁচট খেয়ে। বিলিংসকে দ্বিতীয় ওভারেই ফেরান তানজিম।

রংপুরের আগের ম্যাচের নায়ক শামীম হোসেন তিনে নেমে একটি চার-ছক্কার পর রুবেলের বলে আউট হয়ে যান ১১ বলে ১৪ করে। রনি ভালো শুরুর পর একটু থমকে যান আরেকপ্রান্তে উইকেট পতন দেখে। পাওয়ার প্লেতে রান আসে কেবল ৩৭।

কিন্তু হঠাৎ জ্বলে উঠে ম্যাচের চিত্র বদলে দেন নিকোলাস পুরান। লিন্ডার টানা দুই বল তিনি উড়িয়ে দেন লং অফের ওপর দিয়ে। পরে ছক্কায় ওড়ান তিনি মাশরাফিকে। এমনকি উডকেও টানা দুই বলে মারেন ছক্কা ও চার। তবে এ দিন সকালেই সিলেট দলে যোগ দেওয়া ইংলিশ পেসার ওই ওভারেই থামান পুরানের ঝড় (১৪ বলে ৩০)।

পুরান ফেরার পর ফিরতে পারতেন রনিও। মাশরাফিকে ছক্কা মারার পরের বলে ক্যাচ দেন তিনি সীমানায়। কিন্তু ফিল্ডার জাকিরের হাত গলে বল গড়িয়ে যায় সীমানায়।

এরপর রনি জেগে ওঠেন দারুণভাবে। নুরুল হাসান সোহান গিয়েও দারুণ সঙ্গ দিতে থাকেন তাকে। দুই প্রান্ত থেকেই বাউন্ডারি আসতে থাকে প্রায় প্রতি ওভারেই। গড়ে ওঠে দারুণ জুটি। ৬ ওভারে যখন প্রয়োজন ৬৩ রান, রুবেলের হোসেনের এক ওভারে রনি ও সোহান মিলে চারটি বাউন্ডারি মেরে সমীকরণ নিয়ে আসেন নাগালে।

১৮ বলে যখন প্রয়োজন ৩৩ রান, ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ মোড় আসে তখনই। অসুস্থতার কারণে সিলেটের বোলিং ইনিংসের শুরু থেকে কিপিং করছিলেন না মুশফিক, তার জায়গায় কিপিং করছিলেন বদলি নামা আকবর আলি। ১৭ ওভার শেষে মাঠে নামেন মুশফিক। কিন্তু কিপিং গ্লাভস হাতে নেননি তিনি। আকবরের জায়গায় তখন কিপিংয়ে আসেন জাকির হাসান। এই পুরো প্রক্রিয়ায় সময় নষ্ট হয়ে যায় বেশ কিছুটা।

বিরতি শেষে খেলা শুরু হতেই প্রথম বলে আউট হয়ে যান সোহান (২৪ বলে ৩৩)। আউট হয়ে বেশ ক্ষিপ্ত দেখা যায় তাকে। আম্পায়ারদের সঙ্গে কথা বলেন বেশ উত্তেজিত হয়ে। পরে নিজেদের ড্রেসিং রুমের সামনে গিয়েও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা যায় তার শরীরী ভাষায়।

ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে রংপুরের কোচ সোহেল ইসলাম জানান, মুশফিকের মাঠে ঢোকার প্রক্রিয়ায় দেরি হয়ে মোমেন্টাম নষ্ট হওয়াতেই আপত্তি ছিল সোহানের।

রংপুর আরও বড় ধাক্কা খায় ওই ওভারেই। তানজিমের একটি বলে ব্যাট-বলে করতে পারেননি রনি। উইকেটে পেছনে জাকিরও শুরুতে ধরতে পারেননি বল। তাতে রান নিতে একটু এগিয়ে যান রনি। জাকির বল ছুড়ে মারেন স্টাম্পে। রনির হাতে সময় ছিল ফেরার, তবে আলসে ভঙ্গিতে ফিরতে গিয়ে হারান তিনি নিজের উইকেট। ৫২ বলে ৬৬ রানের ইনিংস শেষ হয় হতাশায়।

দুর্দান্ত বোলিংয়ে ওই ওভারে মাত্র ২ রান দেন তানজিম। পরের ওভারে উড দারুণ বোলিংয়ে ২ উইকেট নেন স্রেফ ৩ রান দিয়ে। ৩ ওভারে ৩৩ রান থেকে সমীকরণ হয়ে যায় এক ওভারে ২৮ রান!

রুবেলের করা শেষ ওভারে শানাকা প্রথম দুই বলে চার মারলেও এরপর আর পারেননি। শেষ বলে শানাকাকে বোল্ড করে দেন রুবেল। গোটা দলকে নিয়ে আনন্দ নৃত্যে মেঠে ওঠেন মাশরাফি।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

সিলেট স্ট্রাইকার্স : ২০ ওভারে ১৮২/৭ (হৃদয় ২৫, শান্ত ৪০, মাশরাফি ২৮, জাকির ১৬, বার্ল ১৫, মুশফিক ৬, পেরেরা ২১, লিন্ডা ২১*, তানজিম ০; মেহেদি ৪-০-২৫-১, রাকিবুল ২-০-১৯-০, হাসান ৪-০-৩৪-২, ব্রাভো ৪-০-৩১-১, রবিউল ২-০-২৩-০, শানাকা ৪-০-৪৫-২)।

রংপুর রাইডার্স: ১৬৩/৮ (রনি ৬৬, বিলিংস ১, শামীম ১৪, পুরান ৩০, সোহান ৩৩, শানাকা , শেখ মেহেদি ২, ব্রাভো ০, রবিউল ০* ; লিন্ডা ৪-০-৩৩-০, তানজিম ৪-০-১৯-২, রুবেল ৪-০-৪২-২, উড ৪-০-৩৪-৩, মাশরাফি ৩-০-২৪-০, বার্ল ১-০-১১-০)।

ফল: সিলেট স্ট্রাইকার্স ১৯ রানে জয়ী।

ম্যান অব দা ম্যাচ: তানজিম হাসান সাকিব।