তামিম-মুশফিকদের দেখা পেয়ে সেই শাহীনের স্বপ্ন পূরণ

শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বেড়ে ওঠা ১৮ ইঞ্চি উচ্চতার এই যুবকের সঙ্গে টিম হোটেলে দেখা করলেন তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, শাহরিয়ার নাফীস ও নাফিস ইকবাল।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিসিলেট থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 March 2023, 05:01 PM
Updated : 17 March 2023, 05:01 PM

“পদ্মা সেতু যেমন একটা স্বপ্ন ছিল, ওইরকম স্বপ্ন পূরণ মনে হচ্ছে আমার কাছে… তামিম ইকবালের সামনে বসে আছি, এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না”- বরিশালের ভাষায় যখন কথাগুলি বলছিলেন শাহীন ফকির, তার চোখেমুখে খেলা করছিল বিস্ময়, আনন্দ, ভালো লাগার আভা। স্বপ্ন পূরণের উদ্ভাসিত আলোর ছটা যেমন হয়!

শুধু কী তামিম! শাহীনের সঙ্গে দেখা করলেন দেশের আরেক তারকা ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম, সাবেক ক্রিকেটার ও জাতীয় দলের লজিস্টিকস ম্যানেজার নাফিস ইকবাল, আরেক সাবেক জাতীয় ক্রিকেটার ও বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের সহকারী ম্যানেজার শাহরিয়ার নাফীস। ছিলেন বিসিবির সিনিয়র মিডিয়া ম্যানেজার রাবীদ ইমামও।

সিলেটে টিম হোটেলে লম্বা সময় ধরে তারা কথা বললেন, আড্ডা দিলেন, নাশতা করলেন। সব মিলিয়ে প্রায় ৪৫ মিনিট, পোলিও আক্রান্ত হয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বেড়ে ওঠা শাহীনের জীবনের স্মরণীয় এক সন্ধ্যা।

বরিশালের মুলাদি উপজেলার চর কমিশনার এলাকার ছেলে শাহীন। গত ১০ মার্চ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় তাকে নিয়ে। সাত দিন বয়সে অনেক কান্নাকাটি করলে তাকে স্থানীয় পল্লী চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসক তাদের বরিশালে নিয়ে ‘বড় ডাক্তার’ দেখাতে বলেন। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকট এবং যাতায়াতের দুর্গমতার কারণে তাদের পক্ষে তা করা সম্ভব হয়নি। কিছুদিন পর শাহীনের হাত পা বেঁকে যেতে থাকলে তারা বরিশালে নিয়ে জানতে পারেন সে পোলিও আক্রান্ত হয়েছে।

প্রায় ৩৫ বছর বয়সেও তার শরীরটা আটকে আছে ১৮ ইঞ্চি উচ্চতায়। তবে জীবনের পথচলায় তিনি আটকে থাকেননি। অন্যের সহায়তা ছাড়া কিছু দৈনিন্দন কিছু করতে পারেন না তিনি। তবু ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই নিজেকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করেছেন, নিজের দোকানে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার পাশাপাশি শিশুদের চকলেট, বিস্কুটসহ কয়েক ধরনের পণ্য বিক্রি করেন। 

ক্রিকেটপাগল মানুষটির জীবনের একটি সাধ ছিল প্রিয় ক্রিকেটার তামিম ইকবালের সঙ্গে জীবনে একবার দেখা করা ও কথা বলা। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদন থেকে তা জানতে পারেন তামিম। জানার পরপরই তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন বিডিনিউজের মাধ্যমে। তাকে আমন্ত্রণ জানান সিলেটে তার সঙ্গে দেখা করতে এবং বাংলাদেশ-আয়ারল্যান্ড সিরিজের ম্যাচ দেখতে।

অভাবনীয় আনন্দে সওয়ার হয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলে শাহীন রওনা হয়ে যান বাড়ি থেকে। চার সঙ্গীকে নিয়ে শুক্রবার সকালে পা রাখেন সিলেটে। সন্ধ্যায় টিম হোটেলে বাংলাদেশ-আয়ারল্যান্ড সিরিজের ট্রফি উন্মোচন অনুষ্ঠান শেষে তামিম দেখা করেন তার ভক্তের সঙ্গে।

চোখের সামনে তামিমকে দেখে নিজেকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন শাহীন। শুরুতে কথাই বলতে পারছিলেন না। তামিম তার সঙ্গে নানা কিছু নিয়ে কথা বলেন, তার রোগ, পরিবার, জীবন, আরও কত কী! সেই কবে শেষবার জাতীয় লিগ খেলতে বরিশাল গিয়েছিলেন তিনি, সেই গল্প শোনান শাহীনকে।

একপর্যায়ে তামিমের জিজ্ঞাসা, “আমাকে ছাড়া আর কার খেলা ভালো লাগে?” শাহীন ফকিরের জবাব দিতে সময় লাগে না, “আপনি সবচেয়ে প্রিয়। তবে বাংলাদেশ দলের সবাই প্রিয়। দল হারলেও আমি সবসময় সাপোর্ট করি। সাকিব ভাই, মাশরাফি ভাই, মুশফিকুর রহিম ভাই… সবাইক ভালো লাগে।”

তামিম তখন বলেন, “মুশফিক হোটেলেই আছে, ওকে ডেকে নিচ্ছি…।” একটু পর মুশফিকের দেখাও মেলে। বিস্ময় আর ভালোলাগায় টইটম্বুর শাহীন ফকির বুঝে উঠতে পারেন না, কী বলবেন আর কী করবেন!

মুশফিকও স্বতস্ফূর্ত হয়ে কথা বলেন, হাসি-মজা চলতে থাকে। তামিম এক পর্যায়ে বলেন, “বরিশালের অনেক ক্রিকেটারও তো নানা সময় খেলেছে বাংলাদেশ দলে।” শাহীন ত্বরিত যোগ করেন, “হ্যাঁ, শাহরিয়ার নাফীস ভাই  খেলতেন…।” তামিম তখন ডেকে নেন শাহরিয়ারকেও! বরিশালের ভাষায় বেশ এক দফা কথাবার্তা হয়ে যায় শাহরিয়ার ও শাহীনের। এর মধ্যে যোগ দেন সেখানে নাফিস ইকবালও।

ছবি তোলার পর্ব চলতে থাকে। শাহীন সেলফি তোলার আব্দার করলে তামিম নিজেই তার পাশে গিয়ে নিজের ফোনে আর শাহীনের ফোনে তোলেন সেলফি। মুশফিকও নিজ থেকে গিয়ে ছবি তোলেন শাহীনের সঙ্গে।

স্বপ্নের নায়কদের সঙ্গে কথা ফাঁকেই শাহীন ফোন করেন বাড়িতে, "তামিম ভাই, মুশফিক ভাইদের সামনে বসে আছি। তারা আমার সঙ্গে গল্প করছেন। অনেক পদ দিয়ে খেতে দিয়েছেন...।" ফোনে কথা শেষে সঙ্গীদের তিনি বলেন, "একটু ভিডিও করে রাখো, নইলে কেউ বিশ্বাস করবে না...।"

বরিশালের মুলাদি থেকে সিলেটে শাহীনের যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়ার সব ব্যবস্থা করে দেন তামিমই। শেষ নয় সেখানেই। রুম থেকে নিজের একটি জার্সি এনে তিনি উপহার দেন ভক্তকে। সেই জার্সিতে অটোগ্রাফ দিয়ে লিখে দেন, “অনেক ভালোবাসা।”

শুধু শাহীনকেই নয়, তার চার সঙ্গীকেও জাতীয় দলের চারটি জার্সি উপহার দেওয়া হয়।

শাহীন জীবনে কখনও মাঠে বসে খেলা দেখেননি। বাংলাদেশ-আয়ারল্যান্ড সিরিজের প্রথম ম্যাচের গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডের ৫টি টিকিট তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে তামিম বলেন, “বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর মাঠেই প্রথম ম্যাচটি দেখবেন…।”

তামিম এক পর্যায়ে শাহীনের কাছে জানতে চান তার কোনো কিছু লাগবে কি না। শাহীনের উত্তর, “আপনাদের দেখা পেয়েই খুশি।” তার পরও বারংবার জিজ্ঞাসার এক পর্যায়ে আবার উঠে আসে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সেই প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ, যেখানে শাহীন বলেছিলেন, “একটা মোটর চালিত হুইল চেয়ার পেলে জীবনটা আরেকটু সহজ হতো।”

তামিম ও মুশফিক একযোগেই বলেন, “আপনার জন্য একটি মোটর চালিত হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা আমরা করব।”

এভাবেই কেটে যায় প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা। দোয়া চেয়ে বিদায় নেন তামিম-মুশফিকরা। হোটেল লবি থেকে বের হয়ে আরও এক অকল্পনীয় অভিজ্ঞতা হয় শাহীনের। একাগাদা টিভি ক্যামেরা ও মাইক্রোফোনের আগ্রহের কেন্দ্রে তিনিই! তাদের সামনে শোনান নিজের অনুভূতির কথা।

সেই পর্ব শেষ করে হোটেলের গেট পেরিয়ে বের হয়েও যেন ঘোর কাটে না শাহীনের।

“আসার সময়ও ভয় কাজ করছিল, আসলেই কী তামিম ভাইয়ের দেখা পাব! কিন্তু দেখা হয়ে গেল কতজনের সঙ্গে। উনারা যত বড় খেলোয়াড়, তার চেয়ে বড় মানুষ। আমার মতো একজন মানুষকে এত সম্মান দিয়েছেন। বিডিনিউজকে ধন্যবাদ, এই ব্যবস্থা করার জন্য। আমার জীবনে এত আনন্দের ঘটনা আর নাই।”