তামিমের সিদ্ধান্তের পেছনে নিজের বা বোর্ডের কোনো দায় দেখছেন না বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান, বোর্ডের কাছে এই ওপেনারই এখনও অধিনায়ক জানিয়ে তিনি বললেন, তামিমের সিদ্ধান্ত বদলের অপেক্ষায় আছেন তারা।
Published : 07 Jul 2023, 08:31 AM
তামিম ইকবাল অবসরের ঘোষণা দেন বুধবার দুপুর দেড়টায়। ওয়ানডে অধিনায়কের বিদায় নিয়ে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান বোর্ড পরিচালকদের নিয়ে সভায় বসেন রাত ১০টায়। পরে যখন তিনি সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হলেন, তখন পেরিয়ে গেছে মধ্যরাত। ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান ঢাকার বাইরে থাকায় সভায় এত দেরি বলে আগেই জানিয়ে রাখলেন বিসিবি প্রধান। বোর্ড পরিচালকদের সঙ্গে দুই ঘণ্টার সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনেও লম্বা সময় কথা বললেন তিনি।
তামিম ইকবালের সিদ্ধান্তে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করলেন বারবার। বিদায়ী ক্রিকেটারের সঙ্গে যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করেও পারেনি বলে জানালেন। বিশ্বকাপের এত কাছে এসে এমন বিদায় তারা মানতে পারছেন না বলেই দাবি করলেন। এখনও তারা তামিমকেই অধিনায়ক হিসেবে দেখছেন এবং সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে তামিমের ফেরার অপেক্ষায় আছে।
সংবাদ সম্মেলনে বোর্ড প্রধানের কথার উল্লেখযোগ্য অংশ তুলে ধরা হলো এখানে:
প্রশ্ন: এতক্ষণ ধরে সভা হলো আপনাদের, তামিম ইকবাল অবসর নিলেন, সবকিছু মিলিয়ে আপনাদের কি আলোচনা হলো?
নাজমুল হাসান: আজকে বসার পেছনে কারণ একটাই। হঠাৎ করে তামিম ইকবাল মিডিয়ায় বলেছে, সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছে। এটা আমাদের জন্য একেবারে… মানে একেবারেই আমরা অবাক হয়েছি। একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল এই কারণে যে, ওর সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ আছে।
বিশেষ করে কোনো একটা সিরিজ চলার সময় অধিনায়কের সঙ্গে তো হবেই। যেহেতু সে ওয়ানডে অধিনায়ক, ওর সঙ্গে আমার তিন দিন আগেও কথা হয়েছে। কালকেও আমি খেলা শুরু হওয়ার আগে কথা বলেছি। আমার পক্ষে কোনোভাবেই বোঝার কোনো উপায় ছিল যে এই ধরনের সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
ওর সঙ্গে আমার কয়েকবারই কথা হয়েছে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে। ও আমাকে সবসময় বলেছে যে পরের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি (২০২৫ সালে পাকিস্তানে) পর্যন্ত খেলতে চায়। আমি বলেছি, ‘ভালো, খেলো।’ তার পর বিশ্বকাপের অধিনায়কত্ব নিয়ে কথা হয়েছে আমার সঙ্গে, জালাল ভাইয়ের (ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান) সঙ্গে, জানতে চেয়েছে যে বিশ্বকাপে অধিনায়ক কে থাকবে। আমি বললাম যে, ‘কে হবে মানে? ও তো অধিনায়ক আছেই! আমরা তো ওকেই বানিয়েছি। এটা নিয়ে কোনো দ্বিমত বা চিন্তা থাকার কথা নেই।’ আমরা অন্য কিছু বলিনি।
যেহেতু বিশ্বকাপ সামনে, একেবারেই সময় নেই, এত অল্প সময়ের মধ্যে অন্য কাউকে অধিনায়ক করা আর ও খেলবে না, এই ধরনের চিন্তা কখনও আমাদের মাথায় আসেইনি। এটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত।
এখন বিসিবির সিদ্ধান্ত কি? তামিমকে আপনারা কোনো আহবান জানাবেন?
নাজমুল : অলরেডি আহবান জানিয়েছি। সকাল থেকে চেষ্টা করি, ওকে পাচ্ছি না (ফোনে)। তখন নাফিস ইকবালের (জাতীয় দলের ম্যানেজার ও তামিমের বড় ভাই) সঙ্গে কথা বলেছি। ওর মাধ্যমেও পাইনি। বারবারই বলছে যে ‘দেখছি, বলছি।’ কিন্তু ওর মাধ্যমেও যোগাযোগ হয়নি। তখন আমি একটা ম্যাসেজ পাঠাই নাফিস ইকবালের কাছে, ৫টা ২০ মিনিটে।
আমি বলেছি যে, ‘দয়া করে তামিমকে বলো, আমি চাই যেন এই সিরিজটা অন্তত সে শেষ করে অধিনায়ক হিসেবে। এরপর আমরা বসে কথা বলতে পারি যে সামনে কীভাবে এগোব। ওর মতো কিংবদন্তি ক্রিকেটারের আবেগপ্রবণ হয়ে এরকম চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। তার দলে থাকাটা বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
তামিমকে যখন কিছুতেই পাচ্ছি না এবং নাফিসকে বারবার বলার পরও তামিম যোগাযোগ করছে না, তখন এই ম্যাসেজটা আমি পাঠিয়েছি। নাফিস আমাকে লিখেছে, ‘অবশ্যই ভাই, আমি আপনার ম্যাসেজ জানিয়ে দেব। কিন্তু এখনও পর্যন্ত পাল্টা উত্তর আমার কাছে আসেনি। এখন এই অবস্থানে আমরা আছি।
তামিমের এই অবসরে বিসিবি সভাপতি হিসেবে আপনি নিজেকে দায়ী মনে করেন কি না? প্রেক্ষাপট হচ্ছে, তামিমের ফিটনেস ইস্যুতে একটি পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে আপনি যা বলেছেন, সেটিই হয়তো একমাত্র কারণ নয়, তবে সেটির প্রেক্ষিতে কোনোভাবে মনে হয় কি না, তামিমের সিদ্ধান্তের পেছনে আপনারও একটা দায় আছে?
নাজমুল: আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, আমার মনে হয় কি না, আমি বলব প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, এরকম ঘটনা এরকম সিদ্ধান্ত আরও ১ হাজার বার এলে ১ হাজার বারই বলব। ও ফিটনেস টেস্ট দিয়েছে এবং ভালোভাবে পাস করেছে। আমাদের ফিজিও ও সবাই নিশ্চিত করেছে, সে ফিট এবং পরদিনই খেলা। আগের দিন কেউ গিয়ে যদি বলে, ‘আমি ফিট নই, তবে খেলব’, এটা হতে পারে না। এগুলো পৃথিবীর কোনো বোর্ড গ্রহণ করবে না।
আপনি বলছেন যে তামিমের সঙ্গে আপনার নিয়মিত কথা হয়। তাহলে ফিটনেসের কথাটি তামিমকে সরাসরি না বলে মিডিয়ায় কেন বললেন?
নাজমুল: মিডিয়ায় আমি বললাম কোথায়? মিডিয়ার সঙ্গে আমার কথা হচ্ছে… এখন আপনি আমাকে একটা ফোন করলেন, আমার সঙ্গে একটা টপিক নিয়ে কথা হচ্ছে, তখন ওই কথার মধ্যে এটা যখন আসবে, তখন এটা আসবে আর আপনি দিয়ে দেবেন, এটা আমি জানিও না…।
ফিটনেস পরীক্ষায় পাস করা মানেই শতভাগ ফিট নয়। পৃথিবীর অনেক খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রে এটা হয়েছে, অনেক বোর্ড দেখেছে, যুগে যুগে এটা হয়ে আসছে…
নাজমুল: আমি আপনাকে একটা কথা বলি, খেলোয়াড় যদি বলে, সে ঠিক আছে, সে খেলবে, আর ফিজিও যদি বলে, ও পাস করেছে, তাহলে আমি কি আনফিট করে বাদ দিয়ে দেব?
বাংলাদেশের ক্রিকেটে আলোচনা হচ্ছে যে আপনার সঙ্গে অভিমান করে তামিম সরে গেছে…
নাজমুল: আমার তা মনে হয় না… জানি না না, ওর সঙ্গে কথা না হলে বলতে পারব না। ওর সঙ্গে কথা হলে বলতে পারব। তবে একটা সিম্পল জিনিস বলতে চাই, কেউ যদি ফিট না থাকে, কারও চোট সমস্যা থাকলে, আমাদেরকে বলতে হবে। আমাদের বলতে আমি নই, বিভাগ আছে এটির। ওই বিভাগ আমাদেরকে বলবে। আমাদেরকে না বলে মিডিয়ায় বলা, এটার কারণটা কী, এটা যদি জানতে পারতাম, তাহলে আপনাদের সঠিক উত্তর দিতে পারতাম। আমি মনে করি, এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এখন তাহলে বিসিবির সিদ্ধান্ত কি? তামিমের সিদ্ধান্ত যদি থেকেই যায়, নেতৃত্ব নিয়ে বোর্ডের সিদ্ধান্ত কি?
নাজমুল: আমি যেহেতু একটা ম্যাসেজ দিয়েছি, আমাকে অপেক্ষা করতেই হবে যে তার কাছ থেকে কোনো সাড়া আসে কি না। আমি আশা করব, অন্তত আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে, কথা বলবে এবং এটার সমাধান বের করা যায় কি না, আমরা চেষ্টা করব। একটা সিরিজের মাঝখানে হঠাৎ করে… সে অধিনায়ক, শুধু খেলোয়াড় নয়, একজন অধিনায়ক এভাবে হঠাৎ করে বলা যে ‘অবসর নিলাম’, এটা ভালো দেখায় না। আমি মনে করি, এটা ঠিক না। এটা পৃথিবীর কোথাও হয় না। আমাদের এখানে শুরু হয়েছে এটা।
সিরিজের মধ্যে এরকম হলে কি আপনার মনে হয় না যে দলেল মধ্যে প্রভাব পড়বে?
নাজমুল: দলের ওপর প্রভাব না পড়ার কোনো কারণ নেই। অলরেডি পড়ে গেছে। পড়বে না কেন? শুধু এই সিরিজ কেন, আমাদের সামনে এশিয়া কাপ, এরপর বিশ্বকাপ, আর কয় মাস বাকি? এই সময় এরকম একটা সিদ্ধান্ত তো অবশ্যই দলের ওপর বিরাট একটা প্রভাব পড়বে। আমা যেখানে ভাবছিলাম, আশা করছিলাম, বাংলাদেশ এবার ভালো করবে। এবারই প্রথম আমরা সকলে আশা করেছিলাম, বাংলাদেশ এবার বিশ্বকাপে ভালো করবে। এমন একটা সময়ে এরকম সিদ্ধান্ত আমাদের ক্রিকেটের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়েছে বলে আমি মনে করি।
একটি পত্রিকায় তামিম বলেছেন যে, তার মনে হয়েছে বিসিবির একটি পক্ষ চাইছে যেন সে নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়…
নাজমুল: প্রশ্নই ওঠে না। আপনাদের কি কারও মনে হয়, হঠাৎ করে এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপের আগে এসে এরকম একটা সিদ্ধান্ত কারও জন্য নেওয়া সম্ভব? আমার ধারণা ইমোশনাল কোনো একটা সিদ্ধান্ত হয়েছে, যে কারণেই হোক। যদিও সে বলেছে এটা একদিন-দুই দিন ধরে নয়, বেশ কিছু দিন ধরেই এটা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে সবার সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কাজেই, কিছু একটা ফ্যাক্টর তো আছেই।
“সেই ফ্যাক্টরগুলি যদি জানতে পারি, তাহলে শুধু এবারের জন্য নয়, সামনে ক্রিকেট বোর্ডের জন্য ভালো হবে। সঙ্গে এটাও আশা করি, ওকে আমাদের এখনও দরকার এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ওয়ানডে দলে, এই কথাটায় যদিও ওর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে, তাহলে আমি খুশি হব। আমরা সেটার জন্য অপেক্ষা করছি।”
যেহেতু সিরিজ চলছে, আপনারা নিশ্চয়ই একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, দলটাকে কে চালাবে?
নাজমুল: আমাদের কাছে এখনও পর্যন্ত ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবাল। এখনও পর্যন্ত আমাদের কাছে সেটাই আছে। কোনো কারণে অধিনায়ক না খেললে সহ-অধিনায়ক চালায়। সহ-অধিনায়কই চালাবে। কিন্তু স্থায়ী কোনো অধিনায়ক আমরা দিচ্ছি না এখন।
এই দলে তো সহ-অধিনায়ক নেই!
জালাল ইউনুস (ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান): আছে, লিটন দাস।
অফিসিয়ালি কারও নাম জানানো হয়নি…
জালাল ইউনুস : মিডিয়া রিলিজ দেওয়া হয়নি, কিন্তু অনেকে জানে।
অধিনায়ক যদি আবেগপ্রবণ হয়ে সিদ্ধান্ত নেন, তার মানসিক অবস্থা কোন পর্যায়ে, সেটা বুঝতে পারাও বোর্ডের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে এমন একজন আবেগী অধিনায়ক থাকলে বড় টুর্নামেন্টে খেলার মতো মানসিক শক্তি কি ক্রিকেটারদের থাকবে?
নাজমুল: এটা বলতে পারব না, এটা বলা মুশকিল। তবে আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, আমার কাছে এখনও মনে হয়, আমাদের বিশ্বকাপর জন্য, এশিয়া কাপের জন্য তামিমই সেরা পছন্দ অধিনায়ক হিসেবে।
কালকেও যদি তামিম আপনাদের ম্যাসেজের সাড়া না দেয়, তাহলে আপনাদের পদক্ষেপ কি হবে?
নাজমুল: আমরা চাচ্ছি, ও নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ফেরত আসুক। না করলে তখন আমরা বসে সিদ্ধান্ত নেব। আগেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে বসে থেকে লাভ কী!
তামিমের সিদ্ধান্তে কোচ চান্দিকা হাথুরুসিংহের প্রতিক্রিয়া কি?
নাজমুল: কোচের সঙ্গে এটা নিয়ে কোনো কথা হয়নি।”