মালান পারলেও বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা কেন পারলেন না

বাংলাদেশে ও মিরপুরে অনেক ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা কাজে লাগালেন মালান, যে কাজটি করতে পারেননি বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যান।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 March 2023, 05:15 PM
Updated : 1 March 2023, 05:15 PM

ম্যাচ শেষে তামিম ইকবাল ও নাজমুল হাসান শান্তর আক্ষেপ আর ৩০-৩৫ রান বেশি করতে না পারায়। দুর্দান্ত সেঞ্চুরিতে ইংল্যান্ডের জয়ের নায়ক দাভিদ মালান তার অধিনায়ক জস বাটলারকেও বলেছেন, লক্ষ্য ৩০-৪০ রান বেশি হলেই ভীষণ কঠিন হয়ে যেত। তামিম-শান্তরা এদেশের মানুষ, বছর জুড়ে এই মাঠেই খেলেন। মালানও এখানে যথেষ্ট অভিজ্ঞ। এই ইংলিশ ব্যাটসম্যান তার অভিজ্ঞতা কাজে লাগালেন, পারলেন না তামিম-শান্তরা। ব্যবধানটা গড়া হয়ে গেল ওখানেই।

 

মজার ব্যাপার হলো, ইংল্যান্ডের জার্সিতে বাংলাদেশে এই প্রথম ম্যাচ খেললেন মালান। তবে এদেশের উইকেট-কন্ডিশনে তার ধারেকাছে অভিজ্ঞতাও এই ইংল্যান্ড দলে কারও নেই। মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামেই আগে তিনি খেলেছেন ২৭টি ম্যাচ!

বলার অপেক্ষা রাখে না, সবই বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে। সেই ২০১৩ সালে প্রাইম দোলেশ্বরের হয়ে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ খেলতে আসেন তিনি। ইংল্যান্ডের বাইরে তখন তাকে চিনতেন কজন! আগেই বাংলাদেশে খেলে যাওয়া স্বদেশি দুই ক্রিকেটার ওয়াইস শাহ ও রবি বোপারার মাধ্যমে ঢাকা লিগে দল পাওয়ার সেই গল্প তিনি শোনালেন এ দিন।

ইংল্যান্ড থেকে এসে বাংলাদেশের কন্ডিশনে আনকোরা কোনো ব্যাটসম্যানের কাজটি সহজ নয় কখনোই। কিন্তু প্রথম মৌসুমেই ৮ ম্যাচ খেলে মালান করলেন ৬৭.৬৬ গড়ে ৪০৬ রান। মুগ্ধ দোলেশ্বর তাকে দলে আনল পরের মৌসুমেও। এবার ১৪ ইনিংস খেলে ৪৯৬ রান ৬২.৭০ গড়ে।

ঢাকা লিগে পারফরম্যান্সের হাত ধরেই ২০১৬ বিপিএলে তাকে সুযোগ দিল বরিশাল বুলস। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সঙ্গে তার সম্পর্ক পোক্ত হলো আরও। পরে ২০১৯ আসরে খেললেন খুলনা টাইটান্সের হয়ে, ২০১৯-২০ আসরে কুমিল্লা ওয়ারিয়ার্সে এবং এবারের বিপিএলে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের হয়ে দুটি ম্যাচ খেলে গেলেন মাস দুয়েক আগে।

সব মিলিয়ে ৫২ ম্যাচের অভিজ্ঞতা ছিল তার বাংলাদেশে। জাতীয় দলের হয়ে এদেশে প্রথম ম্যাচটিতে সেই অভিজ্ঞতার সবটুকুই তিনি উজাড় করে দিলেন। কন্ডিশন, উইকেট, প্রতিপক্ষ, বোলার, কৌশল, সবই তার চেনাজানা। তার কাজ ছিল সেই জানাশোনাকে নিজের শক্তির জায়গার সঙ্গে সংযোগ করে ইনিংস বড় করা। সেখানে তিনি শতভাগ সফল।

ইনিংসের প্রথম ওভারে জেসন রয় আউট হওয়ার পর তিনি উইকেটে যান। কাজ শেষ হওয়ার আগে তাকে ক্রিজ থেকে সরানো যায়নি। ৩২ রানের সময় একটি আম্পায়ার্স কল তার পক্ষে যায়। এছাড়া আউট হওয়ার কোনো সুযোগও দেননি। ৮ চার ও ৪ ছক্কায় অপরাজিত ১১৪, দারুণ গোছানো, পরিশীলিত এবং প্রায় নিখুঁত ইনিংস।

অপরপ্রান্তে তিনি সঙ্গী হারিয়েছেন নিয়মিত। কখনও দ্রুত, কখনও ছোট জুটির পর। কিন্তু একপ্রান্তে তিনি দলকে ভরসা জুগিয়ে গেছেন। সেঞ্চুরি ছুঁয়েও যদি তিনি আউট হতেন বা লক্ষ্যের ১৫-২০ রান আগেও যদি থমকে যেতেন, তাহলেও ইংল্যান্ডের বিপদ থাকত, বাংলাদেশের সম্ভাবনা জাগত। কিন্তু তিনি নিশ্চিত করেছেন, দলকে যেন বিপাকে পড়তে না হয় এবং বাংলাদেশের কোনো সুযোগ যেন না থাকে।

ম্যাচ সেরা হয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসে মালান অকপটে বললেন, আগের অভিজ্ঞতা তাকে কতটা সহায়তা করেছে এই ইনিংসে।

“ভিন্ন ধরনের কন্ডিশনে খেলার সুযোগ যতটা মেলে, খেলা সমৃদ্ধ করার সুযোগ তত বেশি পাওয়া যায়। আগে সাফল্য আসুক বা না আসুক, বিভিন্ন কন্ডিশনে খেলা শিখতে পারাটা দারুণ ব্যাপার। আমার কিছু অভিজ্ঞতা ছিল এখানে খেলার। ব্যাটিংয়ে শুরুর দিকে কাজটা এখানে সহজ নয়। কঠিন সময়ে নিজের প্রক্রিয়ার ওপর ভরসা রেখে পরের দিকে তা কাজে লাগাতে হয়।”

অ্যাশেজে পার্থে ১৪০ রানের ইনিংস আছে তার। ১৬ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ৪ সেঞ্চুরি হয়ে গেল, একটি করেছেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। টি-টোয়েন্টিতে ৫১ বলে ১০৩ রানের ইনিংস খেলেছেন নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে। ঘরোয়া ক্রিকেটে তো আছে হাজার হাজার রান ও ৪০টির বেশি সেঞ্চুরি। কিন্তু মিরপুরে এই সেঞ্চুরিকে নিজের ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস বলছেন ৩৫ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান।

“হ্যাঁ (এটিই সেরা), এমনকি ঘরোয়া ক্রিকেট মিলিয়েও সেই ইনিংসগুলোর কথা যদি বলি, অবসরের পর যে ইনিংসগুলোর কথা ভাবলে তৃপ্তি মিলবে, এটি নিশ্চিতভাবেই সেখানে থাকবে। ম্যাচের যে পরিস্থিতি ছিল, কন্ডিশন যেমন ছিল… এবং অনেক সময়ই এরকম হয় যে, কাছাকাছি গিয়ে আউট হয়ে যায় অনেকে, কিন্তু এবার শেষ পর্যন্ত থেকে দলের জয় নিশ্চিত করা দারুণ তৃপ্তিদায়ক।”

বাংলাদেশে ৫২ ম্যাচ আর মিরপুরে ২৭ ম্যাচের অভিজ্ঞতা মালান কাজে লাগালেন এভাবে, প্রশ্ন তখন জাগতে বাধ্য, এত এত বছরের অভিজ্ঞতা কেন কাজে লাগাতে পারলেন না তামিম-শান্তরা?

শুরুটা দারুণ করেছিলেন তামিম। পরে একটু ছন্দ ও গতি হারান। শেষ পর্যন্ত ২৩ রান করে আউট হন মার্ক উডের বাড়তি লাফানো বলে।

ক্যারিয়ারের ষোড়শ ওয়ানডেতে প্রথম ফিফটির দেখা পেয়েছেন শান্ত। প্রথম ৩৫ রানে তিনি খেলেছেন দারুণ। পরে গতিতে টান পড়লেও টিকে থেকে পঞ্চাশ পেরিয়ে যান। মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে ভালো জুটিও গড়ে তোলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার বিদায়েই দলের ইনিংসের পথ হারানোর শুরু।

যে ৩০-৩৫ রানের জন্য ম্যাচ শেষে আক্ষেপ, সেই রান আসতে পারত তামিমের ব্যাট থেকে, শান্তর ব্যাট থেকে, মুশফিক-মাহমুদউল্লাহ-সাকিব, যে কারও ব্যাট থেকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেননি তারা কেউই। শেষ দিকে তাসকিন আহমেদ ও তাইজুল ইসলাম দারুণ কয়েকটি শট না খেললে আসলে বাংলাদেশের রান ২০০ স্পর্শও করতে পারত না।

শান্ত ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে দায়টা নিলেন আর আশা দেখালেন ভবিষ্যতের জন্য।

“আমি যদি ইনিংসটি বড় করতে পারতাম, তাহলে হয়তো দলের রান ২৪০-২৫০ হতে পারত।”

“আজকে হয়তো আমি ইনিংস বড় করতে পারিনি। তবে অতীতে আমাদের ব্যাটসম্যানরা এরকম ইনিংস বড় করে ম্যাচ জিতিয়েছে বা বড় স্কোর গড়েছে। এমন নয় যে আমাদের ব্যাটসম্যানরা ইনিংস লম্বা করতে পারে না। ভালো ভালো ইনিংস আছে তাদের, যেগুলি আমাদের ম্যাচ জিততে সহায়তা করেছে। তবে আজকে হয়নি। আশা করি, এরকম যে ইনিংস খেলবে (টিকে থাকবে), চেষ্টা করবে ইনিংস বড় করা।”