বিপিএলে প্রথমবার সেঞ্চুরির স্বাদ পেলেন এনামুল হক, কিন্তু শেষ ওভারে চমৎকার বোলিং করে খুলনা টাইগার্সকে রোমাঞ্চকর জয় এনে দিলেন হাসান মাহমুদ।
Published : 19 Jan 2025, 11:13 PM
হাসান মাহমুদের ফুল লেংথ ডেলিভারি অন সাইডে খেলে এক রান নিয়ে সেঞ্চুরিতে পৌঁছে গেলেন এনামুল হক। অপর প্রান্তে পৌঁছে হেলমেট খুললেন তিনি। কিন্তু উঁচিয়ে ধরলেন না ব্যাট। মুখেও নেই কোনো হাসি। থাকবেই বা কেন? জয়ের জন্য যে ওই বলে প্রয়োজন ছিল ৯ রান!
শেষ বলে সিঙ্গল নিয়ে বিপিএলে প্রথমবার তিন অঙ্কের স্বাদ পেলেন এনামুল। কিন্তু তার দারুণ সেঞ্চুরিও যথেষ্ট হলো দুর্বার রাজশাহীর জয়ের জন্য। কেবল দুই উইকেট নিলেও শেষ ওভারসহ ম্যাচে দুর্দান্ত বোলিং পারফরম্যান্সে খুলনা টাইগার্সকে জয় এনে দিলেন হাসান মাহমুদ।
ম্যাচ যখন শেষের পথে, গ্যালারি ততক্ষণে অনেকটাই ফাঁকা। যারা শেষ পর্যন্ত ছিলেন, দারুণ এক টি-টোয়েন্টি ম্যাচের বিনোদন পেলেন তারা। যেখানে দুই দলই পেরিয়ে গেল দুইশ রান। শেষ ওভারের ফয়সালায় যেখানে খুলনার জয় ৭ রানে।
শেষ ওভারে রাজশাহীর প্রয়োজন ছিল ১৭ রান। প্রথম বলে চার মেরে ম্যাচ আরও জমিয়ে তোলেন এনামুল। পরের পাঁচ বলে আর সুযোগ দেননি হাসান।
ওভারের চতুর্থ বলে সীমানায় ক্যাচ দিয়েও বেঁচে যান এনামুল। কিন্তু পরে শুধু ব্যক্তিগত মাইলফলক পূরণ করতে পারেন তিনি। দলকে জেতাতে পারেননি। ঠাণ্ডা মাথায় প্রায় নিখুঁত বোলিংয়ে কাজ শেষ করেন হাসান।
সেঞ্চুরির পরও অবশ্য এনামুলের শেষের ব্যাটিং নিয়ে একটু প্রশ্ন তোলা যায়। শেষ ১৮ বলে রাজশাহীর প্রয়োজন ছিল ৩৬ রান। এর মধ্যে এনামুল ১২ বল খেলে করতে পারেন কেবল ১৮ রান।
দুই জয়ে আসর শুরুর পর টানা চার ম্যাচ হেরেছিল খুলনা। অবশেষে তারা পেল তৃতীয় জয়ের স্বাদ। আট ম্যাচে রাজশাহীর এটি পঞ্চম পরাজয়।
আফিফ হোসেন ও উইলিয়াম বসিস্টোর ফিফটির সঙ্গে মাহিদুল ইসলামের ক্যামিও ইনিংসে ২০৯ রানের পুঁজি পায় খুলনা। ৯ চার ও ৫ ছক্কায় এনামুল ৫৭ বলে সেঞ্চুরি করলেও শেষ পর্যন্ত ২০২ রানে থামে রাজশাহীর ইনিংস।
দুই দল মিলিয়ে ৪১১ রানের ম্যাচে ৪ ওভারে মাত্র ২৫ রানে ২ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জেতেন বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দল থেকে বাদ পড়া হাসান।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এনামুলের এটি তৃতীয় সেঞ্চুরি। তবে বিপিএলে এটিই প্রথম। বাংলাদেশের হয়ে দুইয়ের বেশি সেঞ্চুরি করা দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান তিনি। চারটি শতরান করে সবার ওপরে তামিম ইকবাল।
৮ ম্যাচে দুই ফিফটি ও এক সেঞ্চুরিতে ৩২৪ রান নিয়ে এখন এবারের আসরের সর্বোচ্চ রান এনামুলের।
চলতি আসরে সব মিলিয়ে সেঞ্চুরি হয়ে গেল ৭টি। বিপিএলের এক আসরে এটিই সর্বোচ্চ শতকের রেকর্ড। ২০১৯ সালে হয়েছিল ৬টি সেঞ্চুরি।
৯ মাস পর রুবেল
টানা ৪ হারের পর ঘুরে দাঁড়ানোর আশায় একাদশে তিনটি পরিবর্তন করে খুলনা টাইগার্স। এই আসরে প্রথমবার খেলার সুযোগ পান রুবেল হোসেন। সব মিলিয়ে স্বীকৃত ক্রিকেটে তিনি মাঠে নামেন প্রায় ৯ মাস পর। গত বছরের এপ্রিলে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের পর আর খেলেননি অভিজ্ঞ পেসার।
এছাড়া একাদশে ফেরানো হয় উইলিয়াম বসিস্টোকে। ম্যাচের আগে দলে যোগ দিয়েই মাঠে নেমে যান অ্যালেক্স রস।
নাঈম-মিরাজের ঝড়ো শুরু
টস জিতে ব্যাটিং নেমে শুরুতে ঝড় তোলেন মোহাম্মদ নাঈম শেখ ও মেহেদী হাসান মিরাজ। প্রথম ওভারে সানজামুল ইসলামের তৃতীয় বলে ছক্কা মারেন নাঈম। এক বল পর স্ট্রাইক পেয়ে পরপর দুটি চার মারেন মিরাজ।
জিসান আলমের বল চারের পর ছক্কায় ওড়ান নাঈম। দুই ওভারে স্কোরবোর্ডে জমা হয়ে যায় ৩০ রান।
রাজশাহীর ফেরা
পাওয়ার প্লের বাকি ৪ ওভারে লাগাম টেনে ধরে রাজশাহীর বোলাররা। তৃতীয় ওভারে মাত্র ৩ রান খরচ করেন তাসকিন আহমেদ। ওই ওভারে মিড অফে নাঈমের ক্যাচ ছেড়ে দেন মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরি।
পরের ওভারে নাঈমকে বোল্ড করে ৪২ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন জিসান। ১৪ বলে ২৭ রান করেন বাঁহাতি ওপেনার।
পঞ্চম ওভারে তাসকিনের বলে পরপর দুটি ছক্কা মারেন মিরাজ। পরের বলেই জবাবটা দিয়ে দেন তাসকিন। পয়েন্টে ক্যাচ নেন জিসান। খুলনা অধিনায়কের ব্যাট থেকে আসে ১৩ বলে ২৬ রান।
পাওয়ার প্লের শেষ বলে রসের রানআউটে আরও বাড়ে রাজশাহীর বিপদ।
আফিফ-বসিস্টোর শতরানের জুটি
মাঝের ওভারগুলোতে দলের ওপর চাপ আসতে দেননি আফিফ ও বসিস্টো। শুরুতে কিছুটা সময় নিয়ে ক্রমেই রাজশাহীর বোলারদের ওপর চড়াও হন দুই ব্যাটসম্যান। চতুর্থ উইকেটে ৭১ বলে ১১৩ রানের জুটি গড়ে তোলেন তারা।
৭ রানে অবশ্য জীবন পান বসিস্টো। অষ্টম ওভারে মার্ক ডেয়ালের বলে ক্যাচ নিতে পারেননি আকবর আলি।
দশম ওভারে ডেয়ালের শর্ট বলে পুল করে গ্যালারির দোতলায় পাঠান আফিফ। টিভিতে তখন ভেসে ওঠে, ওই ছক্কা পাড়ি দিয়েছে ১০৩ মিটার পথ! এবারের বিপিএলের সবচেয়ে বড় ছক্কা এটি।
পরের ওভারে তিনি আফতাব আলমের তিন বলের মধ্যে মারেন দুটি চার। এক ওভার পর রায়ান বার্লের বল ওড়ান ছক্কায়।
এরপর কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে আফিফের ব্যাট। ২৮ বলে যার রান ছিল ৪২, পরের ১৪ বলে তিনি করতে পারেন আর ১৪ রান। ডেয়ালের বল ছক্কায় উড়িয়ে চলতি আসরে প্রথম ফিফটি ছুঁতে তার লাগে ৩৫ বল।
সপ্তদশ ওভারে আফতাব আলমের বলে ছক্কার পর চার মারেন বসিস্টো। ৩২ বলে টুর্নামেন্টে নিজের দ্বিতীয় ফিফটি করেন অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান।
পরের ওভারে আফিফকে ফিরিয়ে জুটি ভাঙেন তাসকিন। ৩টি করে চার-ছক্কা মারেন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান।
শেষে মাহিদুলের তাণ্ডব
১৩ বল বাকি থাকতে ক্রিজে গিয়ে ঝড় তোলেন মাহিদুল ইসলাম। ১৯তম ওভারে মৃত্যুঞ্জয়ের প্রথম দুই বলেই ছক্কা মারেন তিনি। ডট বলের খোঁজে অফ স্টাম্পের অনেক বাইরের করার চেষ্টায় টানা দুটি ওয়াইডের পর একটি নো বলও করেন বাঁহাতি পেসার। তবে বাকি চার বলে আর বাউন্ডারি হজম করেননি।
শেষ ওভারে তাসকিনের শর্ট বল চমৎকার শটে লং অফ দিয়ে ছক্কায় ওড়ান মাহিদুল। এক বল পর হাফভলি পেয়ে দারুণ লফটেড ড্রাইভে একই জায়গা দিয়ে সীমানার ওপারে পাঠান এই কিপার-ব্যাটসম্যান।
মাহিদুলের তাণ্ডবেই দুইশ ছাড়িয়ে যায় খুলনা। ৪টি ছক্কায় ১২ বলে ৩০ রান করেন মাহিদুল। ৪ চারের সঙ্গে ১ ছক্কায় ৩৭ বলে ৫৫ রানে অপরাজিত থাকেন বসিস্টো।
জিসানের ঝড়ো শুরু
বড় লক্ষ্যে রানের চাহিদা মিটিয়ে দারুণ শুরু করেন জিসান। দ্বিতীয় বলে রুবেলের বলে চার মারেন তিনি। এক বল পর ছক্কায় ওড়ান আরেক ওপেনার মোহাম্মদ হারিস।
আবু হায়দারের বলে চারের পর পুল শটে ছক্কা মারেন জিসান। মোহাম্মদ নাওয়াজের বলে ছক্কার পর তিনি মারেন বাউন্ডারি। ৪ ওভারে ৪৭ রান হয়ে যায় রাজশাহীর।
পঞ্চম ওভারে আক্রমণে এসে জিসানকে (১৫ বলে ২০) থামান হাসান মাহমুদ।
পাওয়ার প্লের শেষ ওভারে এনামুলকেও ফেরানোর সুযোগ তৈরি করেন নাওয়াজ। কিন্তু লং অফে ক্যাচ নিতে পারেননি আফিফ।
ফের ব্যর্থ হারিস
টুর্নামেন্টের শুরু থেকে সব ম্যাচে সুযোগ পেলেও টানা ব্যর্থতার পরিচয় দেওয়া হারিস এ দিনও বেশি কিছু করতে পারেননি। সপ্তম ওভারে ড্রেসিং রুমের ফেরার আগে ১৫ বলে মাত্র ১৫ রান করেন পাকিস্তানি ওপেনার।
সব মিলিয়ে ৮ ম্যাচে তার সংগ্রহ মাত্র ১৭.৫০ গড়ে ১৪০ রান। সর্বোচ্চ ইনিংস ৩২ রানের।
এনামুল-ইয়াসিরের জুটি
দ্বিতীয় সুযোগ পেয়ে খুলনাকে চড়া মাশুল দিতে বাধ্য করেন এনামুল। ইয়াসির আলি চৌধুরির সঙ্গে তিনি গড়ে তোলেন ৩৯ বলে ৫৮ রানের জুটি। যেখানে ইয়াসিরের অবদান ১৭ বলে ২০ রান।
দীর্ঘ দিন পর ফেরা রুবেলের বলে দুটি ছক্কা মারেন এনামুল। এক ওভার পর নাওয়াজের বলও ওড়ান ছক্কায়। ওই ওভারে কভার সীমানায় ইয়াসিরের ক্যাচ ছাড়েন আবু হায়দার। পরের ওভারে সালমান ইরশাদের বলে চার ও ছক্কা মেরে খুলনার হতাশা বাড়ান ইয়াসির।
ত্রয়োদশ ওভারে বোলিংয়ে ফিরে ইয়াসিরকে আউট করেন আবু হায়দার।
এনামুল-বার্লের চেষ্টা
৪৩ বলে যখন প্রয়োজন ৯০ রান, রায়ান বার্লের সঙ্গে জুটি বাধেন এনামুল। দুজন মিলে ৩৭ বলে যোগ করেন ৭৩ রান।
চতুর্দশ ওভারে মিরাজের বলে দুটি চার মেরে ৩৩ বলে পঞ্চাশে পৌঁছান এনামুল। পরের ওভারে বার্লের কাছে ছক্কা হজম করেন আবু হায়দার। এনামুল মারেন দুটি চার।
এক ওভার পর সালমানের ফুল লেংথ বল রিভার্স স্কুপ করে ছক্কায় ওড়ান এনামুল। ওই ওভার থেকে নেওয়া ১৫ রানে কিছুটা কমের রানের চাপ। শেষ তিন ওভারে ৩৬ রানের সমীকরণে প্রথম পাঁচ বলে মাত্র ৫ রান দেন মিরাজ। শেষ বল ছক্কা মেরে দেন এনামুল।
১৯তম ওভারে চার মেরে শুরু করেন বার্ল। কিন্তু বাকি পাঁচ বলে আর বাউন্ডারি মারতে পারেননি দুই ব্যাটসম্যান। সব মিলিয়ে মাত্র ৮ রান খরচ করেন সালমান। শেষ বলে থার্ড ম্যানে চমৎকার ক্যাচ নিয়ে বার্লের বিদায়ঘণ্টা বাজান হাসান।
এরপর শেষ ওভারের নায়ক হাসান।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
খুলনা টাইগার্স: ২০ ওভারে ২০৯/৪ (নাঈম ২৭, মিরাজ ২৬, আফিফ ৫৬, রস ১, বসিস্টো ৫৫*, মাহিদুল ৩০*; সানজামুল ১-০-১৭-০, জিসান ৪-০-৩৩-১, তাসকিন ৪-০-৩৬-২, মৃত্যুঞ্জয় ৪-০-৪৫-০, ডেয়াল ৩-০-২৬-০, আফতাব ৩-০-৩৩-০, বার্ল ১-০-১৩-০)
দুর্বার রাজশাহী: ২০ ওভারে ২০২/৪ (হারিস ১৫, জিসান ৩০, এনামুল ১০০*, ইয়াসির ২০, বার্ল ২৫, আকবর ০*; আবু হায়দার ৪-০-৪২-১, রুবেল ২-০-৩০-০, নাওয়াজ ৪-০-৩৪-০, হাসান ৪-০-২৫-২, সালমান ৪-০-৪১-১, মিরাজ ২-০-২৩-০)
ফল: খুলনা টাইগার্স ৭ রানে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: হাসান মাহমুদ