জাতীয় লিগে ডিউক বল, যেমন দেখছেন ক্রিকেটাররা

ডিউক বলে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন ব্যাটসম্যানরা, বাড়তি উদ্যমে বোলিং করছেন পেসাররা।

শাহাদাৎ আহমেদ ভূঁইয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Nov 2022, 07:40 AM
Updated : 3 Nov 2022, 07:40 AM

সুমন খানের মিডল স্টাম্পে পিচ করা ডেলিভারি সোজা ব্যাটেই খেলার চেষ্টা করেছিলেন নাসির হোসেন। নিখুঁত সুইংয়ে ব্যাট পরাস্ত করে বল আঘাত হানল অফ স্টাম্পে। যেমনটা জিমি অ্যান্ডারসনের বলে হরহামেশাই দেখা যায় টেস্ট ক্রিকেটে। পরের বল অফ স্টাম্পের বাইরে প্রায় একই লেংথে। ডিফেন্স করার চেষ্টা করছিলেন আকবর আলি। আবারও সেই সর্পিল সুইং। ব্যাটের বাইরের কানায় লেগে বল জমা পড়ল উইকেটরক্ষকের গ্লাভসে।

দুটি বলই চলতি জাতীয় ক্রিকেট লিগের প্রথম রাউন্ডে প্রথম দিনের প্রথম ঘণ্টায় হওয়া। ঢাকার পেসার সুমনের সুইংয়ের সামনে খাবি খাওয়া রংপুর সেই ম্যাচটি হারে পাঁচ সেশনের মধ্যে। খানিক মেঘলা কন্ডিশনে যে কেউ এটিকে ইংল্যান্ডে হওয়া প্রথম শ্রেণির ম্যাচ ভেবে ভুল করতে পারেন। খেলা ইংল্যান্ডে না হলেও, সে দেশের প্রস্তুতকৃত ডিউক বলে চলমান জাতীয় লিগে অনেকবার দেখা গেছে এমন দৃশ্য।

এবারই প্রথমবারের মতো ডিউক বল দিয়ে খেলা হচ্ছে জাতীয় ক্রিকেট লিগ। হাতে সেলাই করা এসব বল সাধারণত বাড়তি সুবিধা দেয় বোলারদের। রান করতে ব্যাটসম্যানদের দিতে হয় কঠিন পরীক্ষা। তবু টুর্নামেন্টের প্রথম তিন রাউন্ড শেষে ডিউক বল সম্পর্কে ইতিবাচক কথাই শোনা গেছে ক্রিকেটারদের মুখে।

দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে লাল বলের সংস্করণে সাধারণত ব্যবহৃত হয় এসজি বা কোকাবুরা বল। গত কয়েক মৌসুমে ভারতের এসজি বল ব্যবহার হয়েছে বেশি। এসব বল সাধারণত ৩৫-৪০ ওভার পর নরম হয়ে যায়। পরে আর সুইং পাওয়া যায় না। রান করা সহজ হয়ে যায়।

ডিউক বলের ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন। এসব বলের সিম অনেক খাড়া হয়। পাশাপাশি বল অনেক শক্ত ও ঔজ্জ্বল্য থাকে লম্বা সময়। যে কারণে প্রায় সারাক্ষণই সুইং পাওয়া যায় এই বলে। বাউন্সও এসজি ও কোকাবুরা বলের চেয়ে তুলনামূলক বেশি পাওয়া যায়।

ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজে টেস্ট খেলা হয় ডিউক বলে। গত জুনে ক্যারিবিয়ান সফরে গিয়ে ডিউক বলের সামনে পড়ে বাংলাদেশ। কখনও এই বলে খেলার অভ্যাস না থাকায় মানিয়ে নিতে বেশ কাঠখড় পোহাতে হয়েছে ক্রিকেটারদের। তাই ক্রিকেটারদের ডিউক বলের সঙ্গে অভ্যস্ত করার জন্য ঘরোয়া ক্রিকেটে বল বদলেছে বিসিবি।

এবারের জাতীয় লিগে ডিউক বলের পাশাপাশি প্রায় সব মাঠে উইকেটে ঘাস রেখে খেলা হচ্ছে। ফলে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে ব্যাটসম্যানদের। প্রথম তিন রাউন্ডের ১২ ম্যাচে সেঞ্চুরি হয়েছে স্রেফ পাঁচটি। এর মধ্যে তৃতীয় রাউন্ডে হয়েছে তিন সেঞ্চুরি। প্রথম দুই রাউন্ড মিলে দেখা গেছে মোটে দুই সেঞ্চুরি।

চকচকে ডিউক বল পেয়ে ব্যাটসম্যানদের নাভিশ্বাস তোলার কাজ বেশ ভালোভাবেই করেছেন বোলাররা। তিন রাউন্ডে ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়ার ঘটনা দেখা গেছে ১৪ বার। এই বলে পেসারদের বাড়তি সুবিধার কথা শোনা গেলেও উইকেট শিকারে সবার ওপরে ছিলেন অভিজ্ঞ স্পিনার নাবিল সামাদ (১৭)। অন্য দুই বাঁহাতি স্পিনার হাসান মুরাদ ও তানভির ইসলাম নিয়েছেন ১৪টি করে উইকেট।

এককভাবে ওপরে না থাকলেও, পেসাররা কম যাননি। ইনিংসে ৪ বা ৫ উইকেট নেওয়ার দৌড়ে তারাই এগিয়ে। সুমন খান, কামরুল ইসলাম রাব্বিদের মতো ধারাবাহিক পারফর্মারদের সঙ্গে ভালো করেছেন মুশফিক হাসান, মুকিদুল ইসলাম মুগ্ধ, তানজিম হাসান সাকিবরা।

খানিক মেঘলা আবহাওয়া ও ঘাসের উইকেটে ডিউক বলের সামনে প্রথম রাউন্ডের ম্যাচে রীতিমতো খাবি খেয়েছেন ব্যাটসম্যানরা। সব ম্যাচে ছড়ি ঘুরিয়েছেন বোলাররা। বৃষ্টির কারণে সব মাঠে নষ্ট হয়েছে লম্বা সময়। তবু ফল এসেছে তিন ম্যাচে। ড্র হয়েছে শুধু এক ম্যাচ। প্রথম রাউন্ডে কোনো সেঞ্চুরির দেখা মেলেনি।

দ্বিতীয় রাউন্ডেও বদলায়নি ব্যাটসম্যানদের ভাগ্য। মুশফিকুর রহিম ও নাহিদুল ইসলামের কল্যাণে হয়েছে দুইটি সেঞ্চুরি। বোলাররা দারুণ অবদান রাখায় চারটি ম্যাচেই ফল হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কবলে পড়ে পুরো খেলা সম্ভব হয়নি তৃতীয় রাউন্ডের কোনো ম্যাচে। এর মধ্যেই সিলেট বিভাগের বিপক্ষে মৌসুমের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকান রংপুরের ১৮ বছর বয়সী ওপেনার আব্দুল্লাহ আল মামুন। এছাড়া তিন অঙ্কের দেখা পান অমিত মজুমদার ও মার্শাল আইয়ুব।

মিরপুর শের-ই বাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে প্রথম রাউন্ডের ম্যাচে রংপুরের ব্যাটসম্যানদের নিয়ে রীতিমতো ছেলেখেলা করেছেন ঢাকা বিভাগের ২২ বছর বয়সী পেসার সুমন। দুই ইনিংসে ৯ উইকেট নেওয়া এ পেসার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে ডিউক বলে প্রথমবার খেলার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন।

খেলার আগে ডিউক বল সম্পর্কে যেমনটা শুনেছিলেন, তেমনই হয়েছে বলে জানালেন সুমন। এই বলে বোলারদের জন্য সবসময় বাড়তি সুবিধা থাকে বলেছেন তিনি।

“যেমনটা ভেবেছিলাম, বাড়তি একটা সুইং সবসময় থাকে। বলটা সহজে নষ্ট হয় না। উইকেটে সাহায্য থাকলে, বাউন্স থাকলে ব্যাটসম্যানদের জন্য একটু চ্যালেঞ্জিং হয়। গতিময় উইকেট হলে ব্যাটসম্যানদের পরীক্ষা দিতে হয় বেশি। এই বলের সিম অনেক ভালো, তাই বাউন্স বেশি থাকে। বলটা সহজে পুরোনো হয় না। সবসময়ই বল মুভ করতে থাকে, একটা সুইং পাওয়া যায়। এটাই বোলারদের জন্য মূলত বাড়তি সুবিধ।”

সুমনের মতো ডিউক বলের বাড়তি সুইং-মুভমেন্টের কথা বলেছেন ঢাকা মেট্রোর অধিনায়ক মার্শাল।

“ডিউক বল আলাদা আমরা জানি। সুইং বেশি হয়, মুভমেন্ট সারাক্ষণ থাকে। উইকেটের সাহায্য গুরুত্বপূর্ণ। রাজশাহীতে (ঘাসের উইকেট) যেমন ৫০ ওভার পরেও বলের মুভমেন্ট কমেনি। প্রথম ম্যাচে একটু সমস্যা হয়েছে। প্রথম প্রথম মানসিক কিছু ব্যাপারও থাকে যে নতুন একটা বলে, ঘাসের উইকেটে খেলা। প্রথম রাউন্ডে মানিয়ে নিতে সমস্যা হয়েছে কিছুটা। তবে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে সবাই অভ্যস্ত হতে শুরু করেছে।”

বল দৌড়ায় কম, বাউন্ডারি মেলে কদাচিৎ

লিগের শুরুতে রান কম হওয়ার পেছনে ডিউক বলের বড় প্রভাব রয়েছে বলে মনে করেন মার্শাল। তৃতীয় রাউন্ডের ম্যাচে ক্যারিয়ারের ২৩তম সেঞ্চুরি হাঁকানো এ অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান জানিয়েছেন, ডিউক বল ব্যাটে লাগার পর কম গতিতে ছোটে। তাই বাউন্ডারি পাওয়া যায় না তেমন। দৌড়ে রান নিতে হয় বেশি।

“ডিউক বলটা মারলে একটু ধীরে যায়। আমি যেটা সেঞ্চুরি করলাম, অন্য বলে হলে আরও আগে হয়ে যেতো। (এই বলে) বাউন্ডারি মারা খুব কঠিন। দৌড়েই রান নিতে হয় বেশি। প্রথম রাউন্ডে যে ৪০ রান করেছিলাম, কোনো বাউন্ডারি নেই। বলটা আসলে কম দৌড়ায়। ব্যাটসম্যানদের জন্য এটাও চ্যালেঞ্জিং। বলের কোয়ালিটি আরেকটু ভালো হলে হয়তো ভালো হবে।”

“মুশফিকের ইনিংসটা (২৪৬ বলে ১১০ রান) দেখার পর আমার একটা ধারণা এসেছে যে কীভাবে খেলা উচিত। ওর সেঞ্চুরিতে মাত্র ছয়টা বাউন্ডারি ছিল। দৌড়ে অনেক রান নিয়েছে। তখন বুঝতে পেরেছি, এখানে কষ্ট করে রান করতে হবে। মুশফিকের মতো ব্যাটসম্যানের সেঞ্চুরি করতে দুইশর বেশি বল লেগেছে, প্রায় ছয় ঘণ্টা খেলতে হয়েছে। ওখান থেকেই আসলে বুঝেছি যে আমার শট কিছু কমিয়ে দিতে হবে।”

মার্শালের মতো একই মত সুমনেরও।

“ডিউক বলে কিন্তু এমন না যে ব্যাটসম্যানরা উইকেটে টিকতে পারছে না। তারা অনেকক্ষণ ধরে খেলছে কিন্তু রান বেশি করতে পারছে না। কারণ বলটা মারলে দৌড়ায় না। এসজি বলে দেখা যায়, টাইমিং করলে বাউন্ডারি পেয়ে যায়। কিন্তু ডিউক বলটা সেভাবে আগায় না। তাই দেখবেন ডিউক বলে সবসময়ই রানটা কম হয়। এ বিষয়টা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। যারা খেলছে তারা বুঝতেছে।”

খুব বেশি পার্থক্য দেখেননি বরিশালের রাব্বি-রাফসান

বরিশাল বিভাগের ওপেনার রাফসান আল মাহমুদ ডিউক বলে চ্যালেঞ্জ আগের চেয়ে বেশি মনে করছেন। মানসিকভাবে দৃঢ় থাকলে এই চ্যালেঞ্জ জয় করা কঠিন নয় বলেই তার বিশ্বাস। ঢাকা মেট্রোর বিপক্ষে তৃতীয় রাউন্ডে ম্যাচ জেতানো ৭১ রানের ইনিংস খেলা এ ওপেনার এসজি বলের সঙ্গে ডিউক বলের খুব একটা তফাত খুঁজে পাননি।

“ওপেনারদের জন্য আসলেই একটু চ্যালেঞ্জিং। উইকেটে কিছুটা ঘাসও রাখা হয়েছে। রাজশাহীতে আমরা দুটি ম্যাচ খেলেছি। দুই ম্যাচেই আগের চেয়ে বেশি মুভমেন্ট ছিল মনে হয়েছে আমার। ডিউক বল একটু বেশি ওপরে ওঠে। আগে যেটা ঊরু বরাবর আসত, সেটা এখন দেখা যায় কোমরে উঠে যাচ্ছে। আর শাইন অনেকক্ষণ থাকে। ৪০ ওভার পরেও বলটা নতুনের মতো লাগে। সবসময়ই কিছু না কিছু হয়। তাই নির্ভার হওয়ার সুযোগ থাকে না।”

“তবে খেলে মজা আছে। আমার খেলার অনুভূতি বেশ ভালো। খুব বেশি যে ভয় জাগানিয়া ব্যাপার, তা নয়। এটা মাথায় নিলেই আসলে বেশি সমস্যা। খুব বেশি পার্থক্য নেই। কোকাবুরা বল তো সুইং করে না খুব একটা। এসজি বল আগেও সুইং করতো। এসজি বলের চেয়ে খুব পার্থক্য মনে হয়েছে তা বলব না। কাছাকাছিই মনে হয়েছে আমার।”

রাফসানের সতীর্থ পেসার কামরুল ইসলাম রাব্বিও মনে করেন এসজি ও ডিউক বলের মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই। তিন রাউন্ড শেষে পেসারদের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৪ উইকেট পেয়েছেন তিনি। 

“ডিউক বল আসলে এসজি বলের চেয়ে খুব একটা আলাদা নয়। বোলারদের জন্য সুবিধা বলতে যাদের কবজির কাজ ভালো, তারা ভালো সুইং আদায় করতে পারে। সিমে হিট করলে বল জোরে যায়। শাইন অনেকক্ষণ থাকায় সারাদিনই সুইং করতে থাকে। উইকেট ভালো হলে একটা বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়। এসজি বলের সঙ্গে পার্থক্য দেখেছি যে, এই বলের সিম শক্ত থাকে, শাইনও অনেকক্ষণ থাকে। আগে দেখা যেত প্রথম স্পেলের পর আর সুইং হতো না। এখন ভালোভাবে বলের শাইন করাতে পারলে সারাদিনই সুইং পাওয়া যায়।”

সময়ের সঙ্গে কেটে যাচ্ছে গ্রিপ করার সমস্যা

অন্যান্য বলের চেয়ে তুলনামূলক শক্ত ডিউক বল পেসারদের জন্য যতটা উৎসাহদায়ক, স্পিনারদের জন্য ততটা নয়। কেননা বল নরম হলে স্পিনাররা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি টার্ন পেয়ে থাকেন। এছাড়া শক্ত বল স্পিনারদের জন্য গ্রিপ করাও কঠিন। 

সিলেট বিভাগের অভিজ্ঞ স্পিনার নাবিলও জানালেন নতুন চকচকে বল শুরুর দিকে আঙুলের মধ্যে গ্রিপ করতে সমস্যা হয়েছিল। তবে ক্রমেই মানিয়ে নিচ্ছেন তিনি।

“গ্রিপের ক্ষেত্রে যেটা হয়, একদম নতুন বলটা চকচকে হওয়ায় তখন ধরতে সমস্যা হয়। একটু পুরাতন হলে আর ঝামেলা হয় না। কিছু কিছু বল আকারে বড় হওয়ায় লম্বা স্পেল করতে একটু সমস্যা হয়। আমিই যেমন প্রথম ম্যাচে প্রায় দুই ঘণ্টা টানা বল করেছি। তখন আমার আঙুল কিছুটা ফুলে গিয়েছিল।”

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগের তরুণ স্পিনার হাসান মুরাদ জানালেন, শুরুতে অনভ্যস্ততার কারণে গ্রিপ করতে সমস্যা হচ্ছিল। তবে এখন মানিয়ে নিয়েছেন তিনি।

“গ্রিপের বিষয়টা, আমার কাছে প্রথম ম্যাচের প্রথম দিকে একটু সমস্যা হচ্ছিল। তবে এখন মানিয়ে নিয়েছি। তেমন কোনো ঝামেলা মনে হয় না। প্রথম প্রথম নতুন করে ডিউক বল পাওয়ায় সমস্যা হচ্ছিল আর কি। যেটা স্বাভাবিক। আমার ডিউক বলটা ভালো লেগেছে। বলে অনেকক্ষণ শাইন থাকে বিধায় সারাক্ষণই কিছু না কিছু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বলটা নষ্ট হয় না তেমন। বোলারদের জন্য খুবই রোমাঞ্চকর বিষয়।”

ডিউক বলকেই এগিয়ে রাখছেন তারা

ব্যক্তিগতভাবে ডিউক বল ভালো লেগেছে মুরাদের। অবশ্য তিনি একা নন, প্রায় সব ক্রিকেটার ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে রায় দিয়েছেন ডিউক বলের পক্ষে। অভিজ্ঞ মার্শাল বলেছেন, এখন রান কিছুটা কম হলেও দীর্ঘ মেয়াদে চিন্তা করলে ডিউক বল দিয়ে খেললে দেশের ব্যাটসম্যানদের স্কিল বাড়বে এবং যেকোনো কন্ডিশনে গিয়ে মানিয়ে নেওয়া সহজ হবে। একইসঙ্গে পেস বান্ধব উইকেট বাড়ানোর তাগিদও দিয়েছেন তিনি।

“ব্যাটসম্যান হিসেবে তো আমি বলব এসজি বলে খেললেই ভালো। রান করা সহজ (হাসি)। তবে বৃহৎ পরিসরে বাংলাদেশ ক্রিকেটের কথা চিন্তা করলে ডিউক বল দিয়ে খেলাই ভালো হবে। ব্যাটসম্যানদের চ্যালেঞ্জ থাকবে, বলটা বেশি মুভ করবে, সুইং করবে। ব্যাটসম্যানদের স্কিল বাড়বে এসব চ্যালেঞ্জ সামলে খেলতে খেলতে।”

“ডিউক বল কন্টিনিউ করলে আমাদের পেস বোলারদের অবশ্যই সাহায্য হবে। বিশ্ব ক্রিকেটে যেকোনো দলে পেসারই বেশি থাকে। আমরা যত সবুজ উইকেটে খেলব, তত ভালো। আমাদের মূল বিষয়টা তো হলো বাইরের দেশে গিয়ে ভালো খেলা। বাইরে ভালো খেলতে হলে রাজশাহী-বগুড়ার মতো উইকেট বেশি দরকার। যেখানে পেসারদের সাহায্য বেশি থাকে।”

আরও কয়েক ম্যাচ খেললে ব্যাটসম্যানরা নিজেদের খেলা বুঝতে পারবেন এবং ভালো রান করবেন বলে আশাবাদী ঘরোয়া ক্রিকেটের এ অভিজ্ঞ মুখ।

“এটাকে আমি ব্যাটসম্যানদের জন্য ভালো বলব। এসজি বলে আমরা যেটা পাই না, ডিউক বলে মুভমেন্টটা বেশি থাকে। স্পোর্টিং উইকেট পেলে হয়তো বেশি ভালো হবে। এক-দুই মৌসুম খেললে নিশ্চিতভাবেই সবাই মানিয়ে নিতে পারবে। ঘাসের উইকেটে খেললে অনেক কিছুই বদলাতে হয়। আমরা খেলতে খেলতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে ব্যাটিংটা আরও উন্নত হবে।”

প্রায় দেড় যুগ ধরে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলা মার্শালের সুরে তাল মিলিয়েছেন ২১ বছর বয়সী স্পিনার মুরাদ। ডিউক বলে সবসময়ই চ্যালেঞ্জ থাকে বিধায় খেলায় উত্তেজনা বাড়ে বলে মনে করেন তিনি। এছাড়া বিদেশের মাটিতে ভালো করার জন্যও ডিউক বলে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার কথা বলেছেন মুরাদ।

“আমি চাইব ডিউক বলেই খেলা হোক। এটা সবার জন্যই ভালো। পেসারদের জন্য অনেক সুইং থাকে, মুভমেন্ট থাকে। ব্যাটসম্যানদের জন্যও এটা সমস্যা হওয়ার কথা না। কারণ বলটা যতক্ষণ ভালো থাকে, ততক্ষণ চ্যালেঞ্জ থাকে। খেলায় কোনো একঘেয়ে মুহূর্ত আসে না। সবসময় উত্তেজনাটা থাকে। এমনটা হলেই আমরা শিখতে পারব। বাইরের দেশে বিশেষ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা ইংল্যান্ডে মানিয়ে নেওয়ার জন্য এটি খুব কাজে দেবে।”

পেসার হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই ডিউক বলের বাড়তি সুবিধা মনে ধরেছে কামরুল রাব্বির।

“আমার খেলার অভিজ্ঞতা থেকে আমি ডিউক বলকে এগিয়ে রাখব। এসজি বল ৩০-৩৫ ওভার করার পর নরম হয়ে যায় এবং বলে সুইং-বাউন্স কিছুই থাকে না। আর কোকাবুরার ক্ষেত্রে দেখা যায় ২০-২৫ ওভার পর আর শাইন হয় না। কিন্তু ডিউক বলটা শক্ত থাকে এবং শাইনও হয়। যে কারণে সারাক্ষণই সুইং পাওয়া যায় এবং সবসময়ই কিছু না কিছু হতে থাকে।”

অনেক ইতিবাচকতার মাঝেও আছে কিছুটা শঙ্কা

ডিউক বলের অনেক সম্ভাবনার মাঝে একটি শঙ্কার কথাও তুলে ধরেছেন দ্বিতীয় ও তৃতীয় রাউন্ডে দুটি ফিফটি করা বরিশাল বিভাগের মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান সালমান হোসেন ইমন। তার মতে, কিছু কিছু বল অত্যধিক শক্ত হওয়ায় ক্রিকেটারদের ইনজুরিতে পড়ার ঝুঁকি অনেক বেশি।

“আমি ডিউক বলের বিশেষ কিছু বুঝিনি। বোলার যতটা সুইং করাতে পারবে এবং পিচে যা সাহায্য থাকবে ততটুকুই মনে হলো। কয়েকটা বল অনেক শক্ত পাথরের মতো মনে হয়েছে। আমার এর মধ্যে তিনবার ব্যাট মেরামত করতে হয়েছে। বৃষ্টি বা ঠাণ্ডার কন্ডিশনে এই বল কারও হাতে লাগলে হাত ভেঙে যেতে পারে। ইনজুরির শঙ্কাটা অনেক বেশি আমার মনে হয়েছে।”

সময় নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চান নির্বাচক রাজ্জাক

ক্রিকেটারদের বেশিরভাগ ডিউক বলের পক্ষে রায় দিলেও, বাংলাদেশ জাতীয় দলের নির্বাচক আব্দুর রাজ্জাক এখনই কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে রাজি নন। তবে এখন পর্যন্ত যা দেখেছেন তাতে বেশ ভালো মনে হয়েছে তার।

“তিন ম্যাচেই আসলে কিছু বলা মুশকিল। যেকোনো নতুন কিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে একটা সময় তো লাগেই। আমি নিশ্চিত ক্রিকেটাররা এটিকে তেমন কঠিনভাবে নিচ্ছে না। আর কিছু ম্যাচ খেললে সবাই অভ্যস্ত হয়ে যাবে। ক্রিকেটারদের তো আসলে সব বলই খেলতে হয়।”

“ডিউক বল নাকি এসজি বল সেটি খুব বড় পার্থক্য গড়ে না। মূল বিষয় আসলে অভ্যস্ত হওয়ার। এক-দুই মৌসুম খেললে সবাই বুঝতে পারবে এই বলেও বাড়তি কী করা যায়, কীভাবে করতে হবে। এখন পর্যন্ত যা দেখেছি, ডিউক বল ব্যবহার করে ভালো হয়েছে। বোলাররা একদম শেষ পর্যন্ত ব্যাটসম্যানদের সমান চ্যালেঞ্জ দিতে পারছে।”

প্রাথমিকভাবে এখন চলতি জাতীয় লিগের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে ডিউক বল। সামনেও এটি ব্যবহার করা হবে কি না তা অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন রাজ্জাক। তার মতে, ক্রিকেটারদের সব বলের সঙ্গে অভ্যস্ত করতেই ডিউক বল আনা হয়েছে। ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে প্রয়োজনীয়তা বুঝে।

“যে দেশের বিপক্ষে সিরিজ থাকবে, সেখানে যে বলে খেলব আমাদের চেষ্টা থাকবে সেই বলে অনুশীলন করে মানিয়ে নেওয়ার। এই মৌসুমে ডিউক বলে করছি কারণ এসজি বল সম্পর্কে খেলোয়াড় ও আম্পায়াররা বলেছেন যে, এসজি বলের আকৃতি দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। ডিউক বলে সেই সমস্যা নেই। আসলে যে কয়টা বলে টেস্ট ম্যাচ হয়, সবগুলো দিয়েই চেষ্টা করে দেখলাম আমরা। তারপর আমরা ঠিক করতে পারব যে কোনটা আমাদের জন্য বেশি মানানসই।”

“এখন বলতে পারব, বিশ্বব্যাপী যে তিন বল দিয়ে টেস্ট ক্রিকেট হয়, তিন বল দিয়েই আমরা খেলেছি। এখন আমাদের বের করতে হবে যে, দেশের মাটিতে আমাদের কোন বলে খেললে বেশি সুবিধা হয়। সেটা দেখতে হলেও আসলে অপেক্ষাই করতে হবে। এ মৌসুমে ডিউক বল দিয়ে খেলছি। এখন সবার ধারণা থাকবে এই বল সম্পর্কে। ক্রিকেটের প্রতিটি বলেরই নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। আমাদের জন্য যেটা বেশি মানানসই, আমরা সেই বলেই খেলার চেষ্টা করব।”