সাগরিকায় সাকিবের সাগর পাড়ি দেওয়ার প্রস্তুতি ৩০ মিনিটে

না কোনো রানিং সেশন, না কোনো স্ট্রেচিং। স্রেফ মাঠে কিছুক্ষণ বিচরণ, কোচ-অধিনায়ক-টিম ডিরেক্টরের সঙ্গে কথোপকথন আর দুটি বিরতি দিয়ে ৩০ মিনিটের মতো ব্যাটিং। চট্টগ্রামের সাগরিকায় জহুর আহমেদ চৌধুরি স্টেডিয়ামে সাকিব আল হাসানের অনুশীলন পর্ব বলতে এটুকুই। ৫ দিনের টেস্ট ম্যাচ, প্রচণ্ড গরমে ব্যাটে-বলে-ফিল্ডিংয়ে সেশনের পর সেশন কঠিন পরীক্ষা। কোভিডমুক্ত সাকিব সেই চ্যালেঞ্জ জয়ের প্রস্তুতি সেরে নিলেন আধ ঘন্টার ব্যাটিং সেশনে।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিচট্টগ্রাম থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 May 2022, 11:30 AM
Updated : 14 May 2022, 03:42 PM

গত ১৫ বছর ধরেই বাংলাদেশের ক্রিকেটে আগ্রহের কেন্দ্রে সাকিব। মাঠের পারফরম্যান্স-কীর্তিতে, নানা আলোচনা-বিতর্কে, অর্জনে-আক্ষেপে সবচেয়ে বেশি মিশে থাকে তার নাম। তার অনুশীলন ঘিরে কৌতূহল থাকে স্বাভাবিক সময়েও। আর যখন তিনি এভাবে বিরতির পর মাঠে ফেরেন, নাটকীয়ভাবে দলে যুক্ত হন, তখন আগ্রহের মাত্রাও থাকে চূড়ায়। শনিবার যেমন, তিনি মাঠে নামার পর থেকেই অনেক ক্যামেরা, ফোন আর জোড়া জোড়া মানব চোখ নিবদ্ধ তার প্রতিটি পদক্ষেপে।

এদের সবাইকে খানিকটা হতাশই হতো হলো। মাঠে যতক্ষণ ছিলেন সাকিব, ফিটনেস ট্রেনিং কিংবা স্কিল ঝালাই করতে খুব একটা দেখা গেল না তাকে।

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম টেস্টের আগের দিন বাংলাদেশ দলের ছিল ঐচ্ছিক অনুশীলন। ১০টা থেকে দলের অনুশীলন শুরুর কথা থাকলেও শুরু হয় একটু আগেই। সাকিব মাঠে নেমেই সরাসরি চলে যান উইকেট দেখতে। তিনি খেলছেন, এই বার্তা পাওয়া হয়ে যায় তাতেই। খেলা নিয়ে সংশয় থাকলে নিশ্চয়ই উইকেট দেখার তাড়না এতটা থাকার কথা নয়!

এরপরই কোচ রাসেল ডমিঙ্গো ও টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায় তাকে মিনিট পনের ধরে। কথা বলেন ব্যাটিং কোচ জেমি সিডন্সের সঙ্গেও। এরপরই হাঁটা দেন ড্রেসিং রুমের দিকে।

তাকে নিয়ে আগ্রহীদের অপেক্ষার অবসান একটু পরেই। প্যাড-থাই প্যাড-গ্লাভসে সজ্জিত হয়ে মাঠে নামেন তিনি। ব্যাটিং পেতে অবশ্য অপেক্ষা করতে হয় কিছুটা। ঐচ্ছিক অনুশীলনের দিনে তামিম ইকবাল ছিলেন বিশ্রামে। ড্রেসিং রুম প্রান্তের পাশাপাশি দুই নেটে মাহমুদুল হাসান জয়ের সঙ্গে ব্যাট করেন শুরুতে মুশফিকুর রহিম। নেটের পাশে দাঁড়িয়ে মোসাদ্দেক হোসেন, মুমিনুল হকদের সঙ্গে খুনসুটি চলতে থাকে সাকিবের। মিনিট দশেক পর আসে তার ব্যাটিংয়ের পালা।

এবার ক্যামেরার শার্টারে আবার চাপ পড়তে থাকে ক্রমাগত, ভিডিও ক্যামেরা স্থির তার দিকে, নেটে তাকিয়ে চকচকে সবার চোখ।

নেটে সাকিব শুরুতে খেললেন থ্রো-ডাউন। আর্ম থ্রোয়ারে বল ছোঁড়া শুরু করলেন কোচ ডমিঙ্গো। লেংথ বলটি মাঝব্যাটে খেলতে পারলেন না সাকিব। বল তার ব্যাটে লেগে গেল পেছনে দিকে। পরের বলটিতেই অবশ্য ফুল লেংথ পেয়ে মাঝব্যাটে খেললেন দারুণ কাভার ড্রাইভ।

বল থ্রো করতে এলেন তখন টিম বয় বুলবুল, হাতের জোর যার ডমিঙ্গোর চেয়ে বেশি। সাকিব বললেন, “তুই থ্রো করবি? পুরনো বল নিস।”

একটু পর থ্রো করতে এলেন মোহাম্মদ রমজান, স্পেশালিস্ট থ্রোয়ার হিসেবেই যিনি আছেন দলে। তার থ্রো সবচেয়ে গতিময়। তাকে দেখে সাকিব মজা করে বললেন, “আরে এ কে আসছে!”

এই তিন জনের সঙ্গে টিম বয় নাসির, লজিস্টিকস ম্যানেজার নাফিস ইকবালও থ্রো ডাউন খেলালেন সাকিবকে। নেটের পেছনে তখন সতর্ক দৃষ্টি জেমি সিডন্সের। বাংলাদেশের ব্যাটিং কোচ এক পর্যায়ে বললেন, “প্রতি বলেই ব্যাক ফুটে থেকে যাচ্ছো। সামনে পা বাড়াও।” সাকিব শুধরে নিলেন নিজেকে। এবার সিডন্স বলে উঠলেন, “মাচ বেটার।” এরপর কয়েক দফায় ব্যাটিং কোচ বললেন, “নাইস মেট’, ‘গুড শট সাকিব।’

পরে নেটে এলেন ঘরোয়া ক্রিকেটের অফ স্পিনার ইফতিখার সাজ্জাদ, বাঁহাতি স্পিনার হাসান মুরাদ। চট্টগ্রামে দলের প্রস্তুতি পর্বের শুরু থেকে নেট বোলারদের সঙ্গে তারাও সহায়তা করছেন দলকে। স্পিনারদের পেয়ে হাত খুললেন সাকিব। কিছু ইনসাইড আউট শট, কিছু সুইপ, স্লগ সুইপ দেখা গেল। কোনোটিতে টাইমিং হলো ভালো, কোনোটিতে হলো না ততটা। 

১৫ মিনিট ব্যাটিংয়ের পর পানি পান করে নিলেন একটু, ভেজা তোয়ালে দিয়ে মুছে নিলেন গা। এরপর আবার শুরু ব্যাটিং। এবার নেট বোলারে দেখা গল বড় চমক। বল হাতে তৈরি মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন!

নেটে সহায়তার জন্য এই পেস বোলিং অলরাউন্ডারকে ডেকে এনেছেন কোচ ডমিঙ্গো। সাইফের প্রথম বলটিতে ব্যাট ছোঁয়াতেই পারলেন না সাকিব। পরে অবশ্য ভালোই সামলে নিলেন।

এবার সেশন চলল ১০ মিনিটের মতো। পানি পানের আগে-পরে মিলিয়ে প্রায় ২৫ মিনিট ব্যাটিংয়ের পর একটু ক্ষান্তি দিয়ে সাকিব বললেন, ‘৫ মিনিট বিশ্রাম।’ বিশ্রাম নিলেন যদিও মিনিট দশেক। এরপর আবার নেটে নেমে ৫ মিনিট ব্যাটিং করতেই নেমে এলো বৃষ্টি।

মাঠকর্মীরা যখন মাঠ ঢাকতে ব্যস্ত, সতীর্থরা সবাই ছুট লাগিয়েছেন ড্রেসিং রুমের পথে, সাকিব তখনও চালিয়ে গেলেন অনুশীলন। বৃষ্টি ভারি হওয়ার পরই কেবল তিনি ছাড়লেন নেট।

সেই বৃষ্টি অবশ্য শেষ ৫ মিনিটেই। তবে বৃষ্টির পর আর নামেননি সাকিব। অপেক্ষা ছিল তার বোলিং-ফিল্ডিং দেখার। সেসব কিছু তিনি করলেন না একদমই।

কোচ ডমিঙ্গো শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, দিনে ১৫ ওভার বোলিং করা ও ব্যাটিংয়ে তিন-চার ঘণ্টা সময় কাটানোর মতো শারীরিক অবস্থায় গেলেই কেবল একাদশে বিবেচনা করা হবে সাকিবকে। কিন্তু কোচের কথায় দলের ভাবনার প্রতিফলন পড়ল না মাঠে সাকিবের অনুশীলনে। স্রেফ ব্যাটিংটাই তো করলেন তিনি!

অধিনায়ক মুমিনুল হক অবশ্য পরে সংবাদ সম্মেলনে বললেন, ব্যাটিং দেখেই তারা বুঝে নিয়েছেন যে সাকিব শতভাগ ফিট ও খেলার জন্য প্রস্তুত। সাকিব মনস্তাত্ত্বিকভাবে কতটা শক্ত, সেটিও মনে করিয়ে দিলেন অধিনায়ক।

সংশয়ের জায়গা তবু কিছু থাকে তার প্রস্তুতি নিয়ে। গত ডিসেম্বরের শুরুর দিকে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্টের পর লাল বলে আর খেলেননি এই ৩০ মিনিটের ব্যাটিংয়ের আগ পর্যন্ত। প্রথাগত ফিটনেস পরীক্ষা হয়নি, এই প্রচণ্ড গরমে লম্বা সময় মাঠে থাকার ব্যাপারটি পরখ করা হয়নি। আদৌ তিনি টেস্ট খেলতে কতটা প্রস্তুত, সেই সংশয় থাকছেই।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, পাঁচ দিনের টেস্টের উত্তাল সাগর পাড়ি দেওয়ার অভিযানে নামছেন তিনি ডিঙি নৌকা বেয়ে চলার প্রস্তুতিতে। তবে নৌকা যেমনই হোক, শক্ত হাতে হাল তিনি ধরতে পারেন। সব বাস্তবতাকে বুড়ো আঙুল দেখানো, প্রতিকূলতা জয় করা আর প্রত্যাবর্তনে নায়ক হওয়ার নজির তো তার কম নেই! এবারও তার ওপর বাজি ধরাই যায়।