মাঠের বাইরের নানা কেলেঙ্কারি-বিতর্কে টালমাটাল দুর্বার রাজশাহী মাঠের ক্রিকেটে এখন সত্যিই দুর্বার, টানা তৃতীয় জয়ে উজ্জ্বল হলো তাদের প্লে-অফ খেলার সম্ভাবনা।
Published : 27 Jan 2025, 10:06 PM
আগের দিনের জয়ের রেশই কাটেনি। চমকপ্রদ অধ্যায় রচনা করে আরেকটি জয়ে নিজেদের রাঙাল রাজশাহী। সেই রাজশাহী, এবারের বিপিএলে যারা পারিশ্রমিক বিতর্কের কেন্দ্রে, নজিরবিহীন ঘটনার জন্ম দিয়ে যাদের বিদেশি ক্রিকেটাররা মাঠে আসেনি আগের ম্যাচে, যাদের মালিকপক্ষ নিয়ে চলছে ক্রমাগত আলোচনা-সমালোচনা। মাঠের বাইরের সবকিছুকে বাইরেই রেখে মাঠের ক্রিকেটে অবিশ্বাস্যভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে তারা এখন প্লে-অফের দুয়ারে।
বিপিএলের প্রাথমিক পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে সিলেট স্ট্রাইকার্সকে ৫ উইকেটে হারাল দুর্বার রাজশাহী। আগের দিন সম্পূর্ণ দেশি একাদশ নিয়ে তারা হারিয়ে দিয়েছিল শীর্ষে থাকা রংপুর রাইডার্সকে।
দুর্দান্ত বোলিংয়ে সিলেটকে অল্পেই আটকে রেখে প্রথম ইনিংসেই ম্যাচের ফল একরকম লিখে ফেলেন এসএম মেহেরব হাসান, মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরিরা। তবে বিনা যুদ্ধে হাল ছাড়েননি তানজিম হাসানরা। দুর্বার রাজশাহীর ব্যাটিংয়ে কাঁপন ধরিয়ে ছোট পুঁজিকেও দূরের পথ করে তুললেন তারা। তবে আকবর আলি ও রায়ান বার্লের দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে শঙ্কা এড়িয়ে আরেকটি জয় পেল রাজশাহী।
অনেক বিতর্কের মধ্যেই রাজশাহীর এটি টানা তৃতীয় জয়। আসরের প্রথম দল হিসেবে প্রাথমিক পর্বের ১২ ম্যাচের সবকটি শেষ হলো তাদের। ছয় জয়ে পয়েন্ট তালিকার তিনে উঠে এলো তারা। তাদের প্লে-অফে খেলা এখন নির্ভর করবে অন্যদের পারফরম্যান্সে।
মিরপুর শের-ই বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সোমবার সিলেটকে ১১৮ রানে আটকে দেয় রাজশাহী। রান তাড়ায় শুরুতে হোঁচট খাওয়া দলকে কক্ষে ফিরিয়ে ৭৫ রানের জুটি গড়েন বার্ল ও আকবর।
দুজনের জুটির সৌজন্যে ১৯ বল বাকি থাকতেই জিতে যায় তাসকিন আহমেদের দল।
জয়ের মঞ্চটা সাজিয়ে দেন বোলাররা। অফ স্পিনে মাত্র ১৫ রানে ৪ উইকেট নেন অফ স্পিনার এসএম মেহেরব হাসান। আগের ম্যাচে আলো ছড়ানো মৃত্যুঞ্জয় এ দিনও নেন ৩ উইকেট।
চমকে শুরু, হতাশায় শেষ
আগের ম্যাচে ১১ জন দেশি ক্রিকেটার খেলানোর পর রাজশাহীর এই ম্যাচের একাদশ নিয়ে আগ্রহ ছিল প্রবল। এবার দুজন বিদেশিকে রাখে তারা, দলে ফেরেন রায়ান বার্ল ও আফতাব আলম।
ব্যাটিং অর্ডারে শুরুতেই চমক দেখায় সিলেট। সামিউল্লাহ শিনওয়ারিকে নিয়ে ইনিংস সূচনায় নেমে যান অধিনায়ক আরিফুল হক। কিন্তু মেলেনি ইতিবাচক ফল। তাসকিন আহমেদ ও আফতাব আলমের লাইন-লেংথ ও সিম মুভমেন্টের সামনে রানের জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকেন দুই ব্যাটসম্যান।
চতুর্থ ওভারে দুজনকেই ফেরান মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরি। আক্রমণে এসে প্রথম বলে আরিফুলকে আউট করেন বাঁহাতি পেসার। দুই বল পর একই পথ ধরেন শিনওয়ারি। দুজনের কেউই দুই অঙ্ক ছুঁতে পারেননি।
পরের ওভারে আফতাবকে বলে তেড়েফুঁড়ে মারতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দেন সাজ্জাদুল হক। বিপিএল অভিষেকে রানের খাতা খোলা হয়নি ঘরোয়া ক্রিকেটের পরিচিত পেস অলরাউন্ডারের।
পাওয়ার প্লেতে মোটে ২০ রান করতে পারে সিলেট।
জাকির-জাকেরের জুটি ও ধস
হতাশাময় পাওয়ার প্লের পর প্রতিরোধ গড়েন জাকির হাসান ও জাকের আলি। তারাও অবশ্য রানের গতি বাড়াতে পারেননি।
সপ্তম ওভারে আফতাবের বল ছক্কায় ওড়ান জাকির। সানজামুল ইসলামের বাঁহাতি স্পিনে দুটি চার মারেন জাকের। একাদশ ওভারে পঞ্চাশ পেরিয়ে যায় সিলেট। পরের ওভারে ভাঙে ৩৯ রানের জুটি।
মেহেরবের লোপ্পা ফুল টসে ডিপ মিড উইকেটে ক্যাচ দেন জাকের। একই ওভারে লং অফে ধরা পড়েন জাকির। ২৫ বলে তিনি করেন ২৪ রান।
পরে কাদিম অ্যালেইন, তানজিম হাসান, জন-রাস জাগেসারও টিকতে পারেননি। মাত্র ১৪ রানের মধ্যে ৫ উইকেট হারিয়ে একশর আগে গুটিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় পড়ে যায় সিলেট।
ভাট্টি-সুমন ঝড়ে একশ পার
স্বীকৃত ব্যাটসম্যানদের বিদায়ের পর সুমন খানকে নিয়ে পাল্টা আক্রমণ শুরু করেন এহসান হাফিজ ভাট্টি। নবম উইকেটে দুজন মিলে ২০ বলে গড়ে তোলেন ৩৬ রানের জুটি।
অষ্টাদশ ওভারে মৃত্যুঞ্জয়ের বলে ছক্কা মারেন ভাট্টি, সুমনের ব্যাট থেকে আসে বাউন্ডারি। পরে শেষ ওভারেও বাঁহাতি পেসারের বল ছক্কায় ওড়ান ভাট্টি। পঞ্চম বলে স্ট্রাইক পেয়ে সুমনও মারেন ছক্কা।
দুজনের ঝড়ে একশ পেরিয়ে যায় সিলেট। ২ ছক্কায় ২১ বলে ২৫ রান করেন ভাট্টি। সুমন ১১ বলে খেলেন ২০ রানের অপরাজিত ইনিংস।
মেহেরবের ৪, মৃত্যুঞ্জয়ের ৩
টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে আগের ১২ ম্যাচ মিলিয়ে ৪ উইকেট নেওয়া মেহেরব এক ম্যাচেই নেন ৪ উইকেট। ৪ ওভারে তার খরচ মাত্র ১৫ রান। আগের ম্যাচে ৪ উইকেট নেওয়া মৃত্যুঞ্জয়ে প্রাপ্তি এবার ৩ উইকেট। তবে প্রথম দুই ওভারে মাত্র দুই রান খরচ করা বাঁহাতি পেসার বাকি দুই ওভারে দেন ৩১ রান।
শুরুতেই চাপে রাজশাহী
ছোট রান তাড়ায় প্রথম চার ওভারে একটি করে উইকেট হারায় রাজশাহী। প্রথম ওভারের শেষ বলে সাব্বির হোসেনকে ফেরান তানজিম হাসান। পরের ওভারে জাগেসারের বলে চার-ছক্কা মেরে ক্যাচ আউট হন জিসান আলম।
তৃতীয় ওভারে তানজিমের বলে রানের খাতা খোলার আগে ড্রেসিং রুমের পথ ধরেন এনামুল হক। ইয়াসির আলিকে আউট করেন জাগেসার। মাত্র ২২ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়ে যায় রাজশাহী।
গত বছর খুলনা স্ট্রাইকার্সের হয়ে বিপিএলে একটি ম্যাচ খেলার পর স্বীকৃত ক্রিকেটে কোনো ধরনের ম্যাচ আর খেলেননি জাগেসার। প্রায় এক বছর পর বিপিএলেই আরেকটি ম্যাচ খেললেন ৩৮ বছর বয়সী ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটার।
আকবর-বার্লের জুটি, অনায়াস জয়
শুরুর চাপ আর বাড়তে দেননি আকবর ও বার্ল। চমৎকার জুটিতে দলকে একশর কাছে নিয়ে যান দুই ব্যাটসম্যান। ম্যাচ জেতানো জুটিতে ৬৩ বলে তারা যোগ করেন ৭৫ রান।
পঞ্চম ওভারে সুমন খানের বলে থার্ড ম্যান ও পয়েন্ট দিয়ে দুটি চার মারেন বার্ল। জাগেসারের ওভারে পয়েন্ট দিয়ে তিনটি বাউন্ডারি মারেন আকবর। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাদের। ওয়ানডে স্টাইলের ব্যাটিংয়ে দলকে এগিয়ে নেন দুজন।
চতুর্দশ ওভারে সুযোগ তৈরি করেন তানজিম। মিড উইকেটে ত্রিশ গজের বৃত্তের সীমানায় বার্লের ক্যাচ নিতে পারেননি অ্যালেইন। পরের বল লং অন দিয়ে ছক্কা মেরে তানজিমকে হতাশায় ডোবান আকবর।
সম্ভাবনা জাগিয়েও বিপিএল ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটি করতে পারেননি আকবর। এহসান ভাট্টির আলগা বলে উইকেট হারান এই কিপার-ব্যাটসম্যান। বিপিএলে নিজের সেরা ইনিংসে ৫ চার ও ২ ছক্কায় ৩৮ বলে করেন ৪৩ রান।
আকবর ফিরে গেলেও দলকে জয়ের বন্দরে নিয়ে যান বার্ল। ভাট্টির বলে ছক্কা মেরে ম্যাচ শেষ করেন জিম্বাবুয়ের অলরাউন্ডার। ৫ চারের সঙ্গে ২ ছক্কায় ৩৪ বলে ৪৮ রানে অপরাজিত থাকেন তিনি।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
সিলেট স্ট্রাইকার্স: ২০ ওভারে ১১৭/৯ (শিনওয়ারি ৯, আরিফুল ৭, জাকির ২৪, সাজ্জাদুল ০, জাকের ১৭, ভাট্টি ২৫, অ্যালেইন ১, তানজিম ২, জাগেসার ৫, সুমন ২০*, রুয়েল ১*; তাসকিন ৪-১-২৫-১, আফতাব ৩-০-১৩-১, মৃত্যুঞ্জয় ৪-০-৩৩-৩, সানজামুল ৪-০-২১-০, মেহেরব ৪-০-১৫-৪, বার্ল ১-০-৮-০)
দুর্বার রাজশাহী: ১৬.৫ ওভারে ১২১/৫ (জিসান ১১, সাব্বির ০, এনামুল ০, ইয়াসির ২, আকবর ৪৩, বার্ল ৪৮*, মেহেরব ৫*, তানজিম ৪-০-১৭-২, জাগেসার ৪-০-৩৪-২, সুমন ২-০-২২-০, রুয়েল ২-০-৮-০, ভাট্টি ৩.৫-০-৩০-১, অ্যালেইন ১-০-৯-০)
ফল: দুর্বার রাজশাহী ৫ উইকেটে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: এসএম মেহেরব হাসান