ম্যাচের ফলাফল ও গ্রাহাম ক্লার্কের ব্যাটিং নিয়ে খেলা শুরুর আগে যা বলেছিলেন চিটাগং কিংসের কোচ শন টেইট, মাঠে সেটিই ফুটে উঠল শতভাগ।
Published : 16 Jan 2025, 10:30 PM
দুই দলের প্রথম লড়াইয়ে মিরপুরে জিতেছিল খুলনা। চট্টগ্রামে ফিরতি লড়াইয়ের আগে টিভি সাক্ষাৎকারে সেই ম্যাচের প্রসঙ্গ উঠতেই চিটাগংয়ের কোচ শন টেইট বললেন, “ওই ম্যাচ গোনায় ধরা হবে না। আমাদের প্রথম ম্যাচ ছিল, আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। আজকে আমরা প্রস্তুত, আমরাই জিতব। কোনো সন্দেহ নেই, জিতব আমরাই।” যেমন কথা, তেমন কাজ!
কোচের কথা যেন প্রতিজ্ঞা হয়ে ফুটে উঠল গোটা দলের পারফরম্যান্সে। খুলনা টাইগার্সকে ৪৫ রানে হারিয়ে চট্টগ্রাম পর্বের সূচনা করল চিটাগং কিংস।
ম্যাচ শুরুর আগে সেই সাক্ষাৎকারে আলাদা করে একজনের কথা বলেছিলেন কোচ টেইট। ইংলিশ ক্রিকেটে গ্রাহাম ক্লার্ক পরিচিত নাম হলেও এই উপমহাদেশে তার পরিচিতি তেমন ছিল না। দেশের বাইরের লিগেও আগে কখনও খেলেননি। এবার চিটাগংয়ের হয়ে নিজের প্রথম তিন ম্যাচেই ভালো পারফর্ম করেন তিনি। ৩১ বছর বয়সী ব্যাটসম্যানকে নিয়ে টেইট বলেন, “ডারহামে ওকে আমি দেখেছিলাম। সেখানে দেখেই নিয়ে এসেছি। এরকম অনেক ক্রিকেটার আছে, যারা এই অঞ্চলে অপরিচিত, তাদের জন্য এই টুর্নামেন্ট দারুণ সুযোগ।”
এখানেও কোচের কথাকে শতভাগ সত্যি প্রমাণ করেই দারুণ শতরান উপহার দিলেন ক্লার্ক। তার বিধ্বংসী সেঞ্চুরিতেই ২০০ রানের পুঁজি পায় চিটাগং। খুলনা পারেনি লড়াই জমাতেও।
খুলনার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচের সেই হারের পর টানা চার ম্যাচ জিতল চিটাগং। প্রথম দুই ম্যাচে জয়ের পর খুলনা হারল টানা চার ম্যাচ।
৭ চার ও ৬ ছক্কায় ৫০ বলে ১০১ রানের ইনিংস খেলেন ক্লার্ক। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তার দ্বিতীয় শতরান এটি।
এই বিপিএলে চার ম্যাচ খেলে তার রান ৬০ গড়ে ও ১৭১.৪২ স্ট্রাইক রেটে ২৪০।
বিপজ্জনক উসমানকে ফিরিয়ে খুলনার হাসি
ম্যাচের শুরুটা খুব ভালো ছিল না চিটাগংয়ের। বড় ভরসা উসমান খানকে দ্রুতই হারায় তারা।
টস হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে দ্বিতীয় ওভারে হাসান মাহমুদের বলে দুটি চার মারেন উসমান। পরের ওভারেই তাকে থামিয়ে দেন আবু হায়দার। ১৩ রান করে কট বিহাইন্ড হয়ে ফেরেন আগের তিন ম্যাচে পঞ্চাশছোঁয়া ইনিংস খেলা উসমান।
পারভেজকে নিয়ে ক্লার্কের পাল্টা আক্রমণ
শুরুর ধাক্কা সামলে নিতে বেশি সময় লাগেনি ক্লার্ক ও পারভেজ হোসেনের। পাওয়ার প্লের শেষ দুই ওভারে একটি করে ছক্কা মারেন পারভেজ। অষ্টম ওভারে মেহেদী হাসান মিরাজের বলে ছক্কার পর চার মারেন ক্লার্ক।
পরের ওভারে দুজনের কাছেই একটি করে ছক্কা হজম করেন হাসান মাহমুদ। দশম ওভারে একশ পেরিয়ে যায় চিটাগং। মাত্র ২৭ বলে টানা দ্বিতীয় ফিফটি পূর্ণ হয় ক্লার্কের।
রাব্বির দুঃস্বপ্নের শুরু
বিপিএল অভিষেক ম্যাচে একাদশতম ওভারে প্রথম বোলিংয়ে আসেন মাহফুজুর রহমান রাব্বি। বড় মঞ্চের চাপেই হয়তো প্রথম বলটি শর্ট করেন বাঁহাতি স্পিনার। ওয়াইড লং অন দিয়ে ছক্কায় ওড়ান ক্লার্ক।
রাব্বির পরের দুই বলের ঠিকানাও সীমানার ওপারে। ওভারের শেষ বলে স্ট্রাইক পেয়ে ওয়াইড লং দিয়ে ছক্কা মারেন পারভেজ। ২৭ রান খরচ করে যাত্রা শুরুর পর আর বোলিং পাননি রাব্বি।
পরের ওভারে একটি করে চার-ছক্কা মেরে মাত্র ৩৮ বলে ৮৮ রানে পৌঁছে যান ক্লার্ক।
পারভেজের বিদায়ে জুটির ভাঙন
ত্রয়োদশ ওভারে শতরানের দ্বিতীয় উইকেট জুটি ভাঙেন মোহাম্মদ নাওয়াজ। ছক্কা মারতে গিয়ে লং অনে ক্যাচ দেন পারভেজ। ৪ ছক্কায় ২৯ বলে ৩৯ রান করে ফেরেন বাঁহাতি ওপেনার। চলতি আসরে আগের চার ম্যাচে তার সর্বোচ্চ ছিল ১৭।
তার বিদায়ে ভাঙে ৬৩ বলে ১২৮ রানের জুটি।
ক্লার্কের শতক, পেছন পানে বাকিরা
পারভেজের বিদায়ের পর কোনো ব্যাটসম্যান বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। ষোড়শ ওভারে এক রান নিয়ে নিজের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে দ্বিতীয় সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন ক্লার্ক। ৮৮ থেকে সেঞ্চুরি ছুঁতে তিনি খেলেন ১০ বল।
ওই ওভারেই ড্রেসিং রুমে ফেরেন ক্লার্ক। ৫০ বলের ইনিংসে ৭ চারের সঙ্গে ৬টি ছক্কা মারেন ইংলিশ ব্যাটসম্যান।
এবারের বিপিএলে সবমিলিয়ে এটি ষষ্ঠ সেঞ্চুরি। টুর্নামেন্টের এক আসরে এটিই সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির রেকর্ড। ২০১৯ সালে বিপিএলের ষষ্ঠ আসরেও হয়েছিল ৬টি সেঞ্চুরি। এবার মাত্র ২২ ম্যাচেই হয়ে গেল তা।
ক্লার্কের বিদায়ের পর রানের চাকায় কাঙ্ক্ষিত গতিতে দিতে পারেননি শামীম হোসেন, হায়দার আলি, মোহাম্মদ মিঠুনরা। শেষ দুই ওভারে তারা করে মাত্র ১০ রান। তবু দ্বিতীয় উইকেট জুটির সৌজন্যে পাঁচ ম্যাচে তৃতীয়বার দুইশ স্পর্শ করে চিটাগং।
নাওয়াজের ৩, সালমানের ৩
পরপর দুই ম্যাচে উইকেটশূন্য থাকার পর এই ম্যাচে ৪ ওভারে ২৯ রান দিয়ে ৩ উইকেট নেন মোহাম্মদ নাওয়াজ। তার স্বদেশি সালমান ইরশাদের শিকার ৩১ রানে ৩টি।
পেসারদের তোপে কোণঠাসা খুলনার টপ-অর্ডার
বড় লক্ষ্য তাড়ায় শরিফুল ইসলামের প্রথম বলেই জীবন পান মোহাম্মদ নাঈম শেখ। স্লিপে ক্যাচ ছেড়ে দেন পারভেজ হোসেন।
পরের ওভারে সৈয়দ খালেদ আহমেদের বলে ভুল করেননি মোহাম্মদ ওয়াসিম। ৮ বলে মাত্র ৩ রান করে ফেরেন বিপিএলে অভিষিক্ত ইংলিশ ব্যাটসম্যান ডমিনিক সিবলি।
তৃতীয় ওভারে আলিস আল ইসলামের প্রথম বল ছক্কায় ওড়ান নাঈম। পরে দুটি চার মারেন মিরাজ। তবে দুজনকে অল্পতেই থামিয়ে দেন ওয়াসিম ও শরিফুল।
শরিফুলের পরের ওভারে ফাইন লেগ দিয়ে ছক্কা মেরে পরের বলেই কট বিহাইন্ড হন মিরাজ (৮ বলে ১৯)।
পঞ্চম ওভারে ওয়াসিমের বলে মিড অফে নাঈমের চমৎকার ক্যাচ নেন আরাফাত সানি। পাঁচ ওভারের মধ্যে প্রথম তিন ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে চাপে পড়ে যায় খুলনা।
ব্যর্থ আফিফ, ব্যাটিংয়েও ভরাডুবি রাব্বির
ওয়াসিমের বলে ডিপ মিড উইকেট দিয়ে ছক্কা, আলিসের বলে ছক্কার পর চার মেরে দারুণ কিছুর আভাস দিচ্ছিলেন আফিফ হোসেন। কিন্তু আগের অনেকবারের মতো এবারও ইনিংস বড় করতে পারেননি বাঁহাতি ব্যাটসম্যান।
অষ্টম ওভারে আলিসের শর্ট বলে ছক্কার চেষ্টায় মিড উইকেট সীমানার অনেক ভেতরে ধরা পড়েন আফিফ। হতাশায় মাথা নিচু করে মাঠ ছেড়ে যান তিনি। পরে ড্রেসিং রুমে না গিয়ে নিচে ডাগআউটেই বসে থাকেন লম্বা সময়।
বল হাতে ভুলে যাওয়ার মতো শুরুর পর ব্যাটিংয়েও কিছু করতে পারেননি রাব্বি। সানির বল ভুল লাইনে খেলে বোল্ড হন তরুণ অলরাউন্ডার। ৩ বলে করেন ২ রান।
আটে মাহিদুল, বৃথা রাসুলি-নাওয়াজের চেষ্টা
ডানহাতি-বাঁহাতি সমন্বয় ঠিক রাখতে গিয়েই হয়তো ৫ উইকেট পড়ে যাওয়ার পরও মাহিদুল ইসলামকে নামায়নি খুলনা। ষষ্ঠ উইকেটে ৪৩ রানের জুটি গড়ে দলকে একশ পার করান দারভিশ রাসুলি ও মোহাম্মদ নাওয়াজ।
পঞ্চদশ ওভারে সানির বলে ওয়াসিমের দারুণ ক্যাচে ফেরেন রাসুলি। ৩১ বলে দলের সর্বোচ্চ ৩৭ রান করেন তিনি। পরের ওভারে খালেদের দ্বিতীয় শিকার হন নাওয়াজ। ২০ বলে করেন ২৫ রান।
রাসুলির বিদায়ের পর আট নম্বরে ক্রিজে যান মাহিদুল। কিছু করতে পারেননি উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান। নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে ফেরার আগে ১২ বলে তিনি করেন ১৮ রান।
সানি-খালেদের চমৎকার বোলিং
নতুন বলে দারুণ শুরুর শেষটাও ভালো করেন খালেদ। ৪ ওভারে ২৬ রানে তিনি নেন ২ উইকেট। বাঁহাতি স্পিনে ২৫ রান খরচায় ৩ উইকেট নেন সানি।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
চিটাগং কিংস: ২০ ওভারে ২০০/৭ (পারভেজ ৩৯, উসমান ১০, ক্লার্ক ১০১, শামীম ১৬, হায়দার ১, মিঠুন ১১*, ওয়াসিম ৭, শরিফুল ০, খালেদ ৭*; আবু হায়দার ৪-০-২৪-১, হাসান ৪-০-৫২-০, মিরাজ ৩-০-৩১-০, সালমান ৪-০-৩১-৩, নাওয়াজ ৪-০-২৯-৩, মাহফুজুর ১-০-২৭-০)
খুলনা টাইগার্স: ২০ ওভারে ১৫৫/৯ (নাঈম ৯, সিবলি ৩, মিরাজ ১৯, আফিফ ২০, রাসুলি ৩৭, রাব্বি ২, নাওয়াজ ২৫, মাহিদুল ১৮, আবু হায়দার ০, হাসান ১২*, সালমান ২; শরিফুল ৪-০-৩০-২, খালেদ ৪-০-২৬-২, আলিস ৪-০-৩৭-১, ওয়াসিম ৪-০-৩১-১, সানি ৪-০-২৫-৩)
ফল: চিটাগং কিংস ৪৫ রানে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: গ্রাহাম ক্লার্ক