উইলিয়ামসনের বীরত্বে শেষ বলের রোমাঞ্চে নিউ জিল্যান্ডের স্মরণীয় জয়

ক্রাইস্টচার্চ টেস্টের রুদ্ধশ্বাস শেষ দিনে শেষ বলে 'বাই' রান নিয়ে শ্রীলঙ্কাকে ২ উইকেট হারাল নিউ জিল্যান্ড।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 March 2023, 07:47 AM
Updated : 13 March 2023, 07:47 AM

মাঠের হাজার হাজার চোখ তখন তাকিয়ে বড় পর্দায়। রিপ্লে দেখানো হচ্ছে। রোমাঞ্চকর কোনো চলচ্চিত্রের শেষ মুহূর্তের রুদ্ধশ্বাস ‘ক্লাইম্যাক্স’ যেন। কেন উইলিয়ামসন লম্বা পা বাড়িয়ে এগিয়ে দিলেন ব্যাট। ক্রিজে পৌঁছানোর মরিয়া চেষ্টায় শেষ মুহূর্তে দিলেন ডাইভ। বল ছোবল দিল স্টাম্পে। অবিশ্বাস্য সেই দ্বৈরথে মাইক্রোসেকেন্ড ব্যবধানে জিতে গেলেন উইলিয়ামসন। হাঁটু গেড়ে বসেই তার মুখে বিজয়ের হাসি। গ্যালারিতে স্বাগতিক দর্শকের উল্লাস। টিভিতে ধারাভাষ্যকারের উত্তেজিত উচ্চারণ, “দা ডেসপারেট ডাইভ গেটস নিউ জিল্যান্ড হোম ইন আ থ্রিলার…।” 

আরও একবার নিউ জিল্যান্ড, আরও একটি উত্তেনাময় সমাপ্তি। দুই সপ্তাহ আগেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১ রানের জয়ের পর এবার শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে শেষ বলে জয়। ক্রাইস্টচার্চ টেস্টে ২ উইকেটের এই জয়ে সিরিজে এগিয়ে গেল কিউইরা। 

শেষ ২ বলে নিউ জিল্যান্ডের প্রয়োজন ছিল ১ রান। অসাধারণ এক সেঞ্চুরিতে দলকে এগিয়ে নেওয়া উইলিয়ামসন তখন স্ট্রাইকে। কিন্তু আসিথা ফার্নান্দোর বাউন্সারে ব্যাটে-বলে করতে পারলেন না তিনি। ম্যাচ গড়াল শেষ বলে। এবার আরেকটি বাউন্সার। পুল করার চেষ্টায় আবারও ব্যাটে-বলে হলো না। কিন্তু রান তো নিতেই হবে! 

নন-স্ট্রাইক থেকে ছুটলেন নিল ওয়্যাগনার। কিপার নিরোশান ডিকভেলা বল ধরে গ্লাভস হাতেই থ্রো করলেন। স্টাম্পে লাগলেই আউট, কিন্তু তিনি পারলেন না লাগাতে। ক্রিজের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা আসিথা পেলেন বল। দ্রুত ধরেই তিনি থ্রো করলেন নন-স্ট্রাইক প্রান্তে। স্টাম্পে লাগাতেও পারলেন। কিন্তু উইলিয়ামসন ক্রিজে পৌঁছে গেলেন নিরাপদে। ট্র্যাজেডি নয়, তিনি হয়ে রইলেন অবিস্মরণীয় জয়ের নায়ক। হতাশায় মুষড়ে পড়ল শ্রীলঙ্কানরা। 

শেষ দিনে রোমাঞ্চের উপকরণ এই টেস্টে মজুদ ছিল আগে থেকেই। বৃষ্টির কারণে খেলা দেরিতে শুরু হওয়ায় তা রূপ নেয় ওয়ানডে ম্যাচের। ৫৩ ওভারে নিউ জিল্যান্ডের প্রয়োজন পড়ে ২৫৭ রান, শ্রীলঙ্কার ৯ উইকেট। নানা বাঁক পেরিয়ে লড়াই পৌঁছে যায় শেষ বলের সমীকরণে। 

ওই শেষ বলের আগেও নাটক কম হয়নি। শেষ ৩ ওভারে যখন প্রয়োজন ২০ রান, তখনও নিউ জিল্যান্ডের উইকেট আছে ৫টি। কিন্তু পরপর দুই ওভারে তারা হারায় ২ উইকেট, রান আসে ১২। শেষ ওভারে প্রয়োজন পড়ে ৮ রানের।

প্রথম দুুই বলে সিঙ্গেল নেন উইলিয়ামসন ও ম্যাট হেনরি। তৃতীয় বলে দুই রানের চেষ্টায় রান আউট হয়ে যান হেনরি। ৩ বলে যখন প্রয়োজন ৫ রান, সীমানায় ছড়িয়ে প্রায় সব ফিল্ডার, অসাধারণ এক শটে দুই ফিল্ডারের মাঝ দিয়ে চার মারেন উইলিয়ামসন। সমীকরণ চলে আসে নাগালে।

কিন্তু পঞ্চম বলে তিনি পারেননি বলে ব্যাট ছোঁয়াতে। এরপর সেই শেষ বলের নাটকীয়তা।

টেস্ট ক্রিকেটের ১৪৬ বলের ইতিহাসে শেষ বলে ম্যাচ জয়ের ঘটনা আছে আগে আর একটিই। ১৯৪৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জিতেছিল ইংল্যান্ড। কাকতালীয়ভাবে, ডারবানে সেই টেস্টেও শেষ ওভারে ইংলিশদের প্রয়োজন ছিল ৮ রান। তারাও ম্যাচটি জিতেছিল ২ উইকেটে।

হৃদয়ভাঙা এই হারে আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের লড়াই থেকেও ছিটকে গেল শ্রীলঙ্কা। আগামী জুনে ওভালে ফাইনালে লড়বে ভারত ও অস্ট্রেলিয়া।

কদিন আগে ওয়েলিংটনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১ রানের জয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে দুর্দান্ত সেঞ্চুরি করেছিলেন উইলিয়ামসন। এবারও তিনিই নায়ক ব্যাটিং মাস্টারক্লাসের প্রদর্শনীতে। ২৭তম টেস্ট সেঞ্চুরিতে অপরাজিত থেকে যান তিনি ১৯৪ বলে ১২১ রানের ইনিংস খেলে।

তবে নায়ক তিনি একা নন। ড্যারিল মিচেলকে যে পিছিয়ে রাখা যায় না কোনোভাবেই! উইলিয়ামসনের সঙ্গে তার ১৫৭ বলে ১৪২ রানের জুটিই মূলত নিউ জিল্যান্ডকে এগিয়ে নেয় জয়ের কাছে।

ক্রিজে গিয়ে প্রথম বলেই ছক্কা মারেন তিনি। তখনও পর্যন্ত নিউ জিল্যান্ডের রান রেট ছিল তিনের নিচে। কিন্তু ৪টি করে চার ও ছক্কায় মিচেলের ৮৬ বলে ৮১ রানের ইনিংস দারুণভাবে মিটিয়ে দেয় পরিস্থিতির দাবি।

প্রথম ইনিংসের মহামূল্য সেঞ্চুরির সঙ্গে শেষ দিনের এই ইনিংস খেলে ম্যান অব দা ম্যাচ মিচেলই।

দিনের শুরুতে সম্ভব ছিল সব ফলাফলই। কিন্তু বৃষ্টির কারণে ভেস্তে যায় ৩৭ ওভার। খেলা শুরুর পর দুই অপরাজিত ব্যাটসম্যান টম ল্যাথাম ও কেন উইলিয়ামসন সাবধানী ব্যাটিংয়ে এগিয়ে নেন দলকে। শ্রীলঙ্কা লড়াইয়ে ফেরে প্রবাথ জয়াসুরিয়ার স্পিনে। কাট করতে গিয়ে বল স্টাম্পে টেনে আনেন টম ল্যাথাম (২৪)। শুরুটা দারুণ করলেও হেনরি নিকোলস (২০) আউট হয়ে যান জয়াসুরিয়াকে সুইপ খেলে।

৯০ রানে ৩ উইকেট হারানো নিউ জিল্যান্ডের রান রেটও তখন ধুঁকছে। মিচেল উইকেটে গিয়ে প্রাণের সঞ্চার করেন তাদের সম্ভাবনায়। প্রথম বলেই ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে জয়াসুরিয়াকে ছক্কায় ওড়ান তিনি। এরপর ছুটতে থাকেন দারুণ খেলে।

শ্রীলঙ্কা হাতছাড়া করে উইলিয়ামসনকে ফেরানোর সুবর্ণ সুযোগ। ৩৩ রানে উইকেটের পেছনে ডাইভ দিয়ে ক্যাচ নিতে পারেননি নিরোশান ডিকভেলা।

উইলিয়ামসন ও মিচেলের জুটির সময় মনে হচ্ছিল, নিউ জিল্যান্ড জিতে যাবে সহজেই। কিন্তু আসিথা ফার্নান্দো দুর্দান্ত বোলিংয়ে জাগিয়ে তোলেন শ্রীলঙ্কার সম্ভাবনা।

স্টাম্পের বাইরের ইয়র্কার লেংথের বল স্টাম্পে টেনে আনেন মিচেল। দুর্দান্ত ইয়র্কারে বোল্ড হয়ে যান টম ব্লান্ডেল। এই জোড়া শিকারের পর আসিথা ফিরিয়ে দেন মাইকেল ব্রেসওয়েলকেও। পরে টিম সাউদিকে দ্রুত বিদায় করেন লাহিরু কুমারা।

কিন্তু উইলিয়ামসনকে বিদায় করা যায়নি। সেঞ্চুরি ছুঁয়ে আরও এগিয়ে দলের জয় সঙ্গে নিয়েই ফেরেন তিনি। আগের টেস্টে ইংল্যান্ডের শেষ উইকেট নিয়ে ১ রানের জয় নিশ্চিত করেছিলেন যিনি, সেই নিল ওয়্যাগনার এবার চোট নিয়েও ব্যাটিংয়ে গিয়ে স্বাক্ষী হন অবিস্মরণীয় জয়ের।

আগামী শুক্রবার থেকে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট ওয়েলিংটনে।

সংক্ষিপ্ত স্কোর: 

শ্রীলঙ্কা ১ম ইনিংস: ৩৫৫ 

নিউ জিল্যান্ড ১ম ইনিংস: ৩৭৩ 

শ্রীলঙ্কা ২য় ইনিংস: ৩০৫

নিউ জিল্যান্ড ২য় ইনিংস: (লক্ষ্য ২৮৫, আগের দিন ২৮/১) ৭০ ওভারে  ২৮৫/৮ (ল্যাথাম ২৫, কনওয়ে ৫, উইলিয়ামসন ১২১*, নিকোলস ২০, মিচেল ৮১, ব্লান্ডেল ৩, ব্রেসওয়েল ১০, সাউদি ১, হেনরি ৪, ওয়্যাগনার ০*; রাজিথা ১৭-৫-৬১-১, আসিথা ১৯-৪-৬৩-৩, জয়াসুরিয়া ১৯-১-৯২-২, কুমারা ১৫-৩-৬১-১) 

ফল: নিউ জিল্যান্ড ২ উইকেটে জয়ী

সিরিজ: ২ ম্যাচ সিরিজে নিউ জিল্যান্ড ১-০তে এগিয়ে 

ম্যান অব দা ম্যাচ: ড্যারিল মিচেল (১০২ ও ৮১)