সাকিবের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে তামিমের খোলামেলা জবাব

ইংল্যান্ড সিরিজের আগে বাংলাদেশ অধিনায়কের সংবাদ সম্মেলনের বেশির ভাগ জুড়ে থাকল বিতর্কের প্রসঙ্গ, একের পর এক প্রশ্নে তামিম জবাব দিলেন খোলা মনেই।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Feb 2023, 09:36 AM
Updated : 26 Feb 2023, 09:36 AM

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ সিরিজের আগে বাংলাদেশ ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবালের প্রথম সংবাদ সম্মেলন। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় ২৬ মিনিটের সংবাদ সম্মেলনে এই সিরিজ নিয়ে প্রশ্ন হলো কমই। বেশির ভাগটা জুড়ে থাকল সাম্প্রতিক বিতর্ক। ক্রিকেট ওয়েবসাইট ক্রিকবাজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান সম্প্রতি বলেছেন, তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসানের সম্পর্কের তিক্ততা এখন চরম পর্যায়ে, বাংলাদেশ দলের ড্রেসিং রুমের পরিবেশ স্বাস্থ্যকর নয় এবং বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সমস্যা এখন গ্রুপিং। এসব নিয়েই একের পর এক প্রশ্নে সময় নিয়ে খোলামেলা উত্তর দিলেন বাংলাদেশ ওয়ানডে অধিনায়ক। 

বোর্ড সভাপতি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আপনার ও সাকিব আল হাসানের মধ্যে বিরোধ চলছে এবং সেই বিরোধের কারণে ড্রেসিং রুমের আবহ স্বাস্থ্যকর নয়। গুরুত্বপূর্ণ একটি সিরিজের আগে দলের আবহ কেমন? 

তামিম ইকবাল: আমার কাছে মনে হয়, দলের আবহাওয়া অনেক ভালো। আজকে থেকে নয়, অনেক দিন থেকেই ভালো। সেটার ফলও আপনারা দেখছেন। ওয়ানডেতে আমরা সবসময়ই ভালো… সবসময় বলব না, তবে অন্তত গত ৫-৬ বছর ধরেই ভালো। গত ৫-৬ সিরিজ যদি দেখি, আমরা জিতেছি। যখনই ড্রেসিং রুমি খুশি থাকে বা খুশির আবহ থাকে, তখনই এসব ফল অর্জন করতে সহজ হয়। 

তো আমি কোনো বিরোধ দেখি না। সবকিছু খুবই স্বাভাবিক। আজ থেকে এক বছর আগে যেমন ছিল, ভিন্ন কিছু নেই।

সাকিব এখনও দলে যোগ দেননি। তিনি যদি যোগ দিতেন বা শুরু থেকে পাওয়া যেত, তাহলে আরও কি ভালো হতো সিরিজের পরিকল্পনা করতে? 

তামিম: অবশ্যই। পুরো সিরিজ একসঙ্গে থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমি নানা সাক্ষাৎকার-সংবাদ সম্মেলনে বলেছি, পরিবারের যদি কারও কিছু হয়, সেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ক্রিকেট বলেন বা পেশা, এই সবকিছুর ওপরে পরিবার, আমার মতে। ক্রিকেট আমাদের পেশা, আমরা সবাই পেশাদার, সব ঠিক আছে। আপনারা যেখানে আছেন, নিজেদের পেশায় কাজ করেন। কিন্তু ব্যাপারটি যখন পরিবারের, দ্বিতীয় কোনো বিকল্প নেই।

আমি ঠিক নিশ্চিত নই ওর (সাকিব) পরিবারের কার কী হয়েছে। তবে পারিবারিক একটি ইস্যু আছে, সে পরিবারের সঙ্গে আছে এবং আমরা তাকে শতভাগ সমর্থন করি।

সাকিবের সঙ্গে আপনার বিষয়টি নিয়ে (সম্পর্কের টানাপোড়েন) বোর্ড সভাপতি বলেছেন প্রকাশ্যে। আপনি যদি পরিষ্কার করেন যে আসলে কী হয়েছে বা সম্পর্ক এই জায়গায় কেন গেল… 

তামিম: আমার কাছে যেটা মনে হয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমি-সাকিব যখন বাংলাদেশ দলের জার্সি পরি, মাঠে যখন নামি, আমি যদি নিজের শতভাগ দেই, সে যদি শতভাগ দেয়, আমি যদি অধিনায়কত্ব করি এবং তার কাছ থেকে কোনো পরামর্শ চাইলে সে সহায়তা করে, সে অধিনায়কত্ব করার সময় কোনো পরামর্শ চাইলে আমি যদি প্রস্তুত থাকি, তাহলে অন্য আর কিছুর কোনো মূল নেই। নাথিং এলস ম্যাটারস।

আমার কাছে মনে হয়, এই জিনিগুলো যদি ঠিক থাকে… এবং একটি দলের অধিনায়ক হিসেবে আমি নিশ্চিত করছি, যখন আমার প্রয়োজন, তাকে পাশে পাই এবং এটাই নিশ্চিত করে দিচ্ছি, আমি যখন টেস্ট খেলব এবং সে নেতৃত্ব দেবে, তার কোনো প্রয়োজন হলে আমি সবসময় পাশে আছি। এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। নাথিংস এলস শুড ম্যাটার।

এরকম একটা সিরিজের আগে যখন বোর্ড সভাপতি কোনো সাক্ষাৎকারে এভাবে বলেন, এটা কতটা শকিং? এটা নিয়ে কি সাকিবের সঙ্গে আপনার কথা হয়েছে? 

তামিম: নাহ (কথা হয়নি)… আমি এটার ব্যাপারে কালকেই জানতে পেরেছি মাত্র। তবে যেটা বললাম, যখন আমরা বাংলাদেশ দলে খেলছি, দেশকে যখন প্রতিনিধিত্ব করছি এবং মাঠে যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে, তাহলে নাথিং এলস ম্যাটারস মানে আসলেই নাথিং এলস ম্যাটারস। এখানে কে কী বলল, কী হলো না হলো, আমাদের সম্পর্ক কেমন, একসঙ্গে কফি খাই কি না, এগুলো কোনো কিছু কোনো ব্যাপার না, যতক্ষণ আমরা দল ও দেশের জন্য শতভাগ দিচ্ছি। 

যদি এখানে কোনো সমস্যা হতো, তাহলে হয়তো সেটা বলতাম। কিন্তু আমি বলছি, এখানে কোনো সমস্যা নেই। আমরা তো একসঙ্গে ব্যাট করি, সবকিছুই তো স্বাভাবিক থাকে। ১৫-১৬ বছর ধরে একসঙ্গে খেলছি, সে (সাকিব) উইকেট পেলে আমরা একসঙ্গেই সবাই উদযাপন করি। সবকিছু পুরোপুরিই স্বাভাবিক।

বোর্ড সভাপতি আরেকটি কথা বলেছেন যে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো গ্রুপিং। পুরো বাংলাদেশ ক্রিকেটের কথা হয়তো আপনার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তবে আপনার কি মনে হয় ওয়ানডে দলে, আপনার দলে সবচেয়ে বড় সমস্যা গ্রুপিং? 

তামিম: আমি ১৭ বছর ধরে খেলছি বাংলাদেশ জাতীয় দলে। বিভিন্ন সময়ে, ৫ বছর আগে, ১০ বছর আগে, ১৬ বছর আগেও শুনতাম। যখন দল ভালো খেলত না, তখনই কেন যে এই টার্ম ব্যবহার করা হতো যে গ্রুপিং আছে মনে হয়। অমুক গ্রুপ, এই গ্রুপ, সেই গ্রুপ...।

তবে আমি স্রেফ বলার জন্য বলছি না, যারা আমাকে কাছ থেকে চেনে, জানেন যে আমি খুবই স্ট্রেট ফরোয়ার্ড মানুষ। আমি কোনো কিছু লুকিয়ে বলি না, কম রেখে বলি না। যা বলার সোজা বলব। আপনার পছন্দ হবে নাকি হবে না, সেটা আপনার ব্যাপার। আমি ১৬ বছর আগেও গ্রুপ দেখিনি, ১০ বছর আগেও দেখিনি, এখনও দেখি না। 

সবশেষ ৬ মাসে আমি দলের সঙ্গে ছিলাম না। এই জিনিসটা (গ্রুপিং) যদি এই ৬ মাসের মধ্যে ডেভেলপ হয়, তা আমি জানি না। তবে এখন যখন ড্রেসিং রুমে ৩-৪ দিন ধরে আছি, এরকম কোনো কিছু দেখিনি। সবাই উপভোগ করছে। আমরা সবাই মজা করি। বিপিএলে কী হয়েছে না হয়েছে, সবার এটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সামনে কী হবে না হবে, এটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। 

দুঃখজনকভাবে, যখনই দল ভালো করে না, এই জিনিসটা (গ্রুপিংয়ের অভিযোগ) উঠে আসছে। আর একটা দল যখন একটি সংস্করণে এত ভালো করছে…আমি আসলে একই কথা বলব, তখনও দেখিনি গ্রুপিং, এখনও দেখি না। আমি যতদূর জানি, সবকিছুই স্বাভাবিক।

মাঠে আপনারা একসঙ্গে আছেন, খেলছেন, এখানে সমস্যা নেই বলছেন। আমরাও অনেকবার দেখেছি। (গত বছর) সেঞ্চুরিয়নে আপনারা দুজন ম্যাচ জিতিয়ে আলিঙ্গন করলেন পরস্পরকে, দারুণ একটা ছবি ছিল। কিন্তু আপনারা তো মাঠের বাইরেই সময় বেশি কাটান কোনো সিরিজ বা সফরে। দলের শীর্ষ দুজন ক্রিকেটার যখন মাঠের বাইরে কথা বলে না, তখন কি মনে হয় না যে অন্যদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে? আপনারা তো অনেকের আদর্শ। আপনারা হয়তো আর দুই-তিন বছর খেলবেন, তার আগে কি সম্ভব (সম্পর্ক ভালো করা)? যদিও এটা আপনাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং আপনার একার ওপরও নির্ভর করে না, কিন্তু এটা কি সম্ভব যে মাঠের বাইরে আপনারা আগের মতো থাকবেন? 

তামিম: বেশির ভাগ উত্তরই আমি আগে দিয়ে দিয়েছি। এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শেষের কথাটি বলছি, সম্ভব সব কিছুই। এভরিথিং ইজ পসিবল। 

এরকম শোনা গিয়েছিল যে, আপনাদের নিয়ে একসঙ্গে বসা হয়েছিল। একজন বোর্ড পরিচালক ছিলেন সঙ্গে। সেখানে আপনি ইতিবাচক ছিলেন, আপনার দিক থেকে এটা মিটমাট করার উদ্যোগ ছিল, কিন্তু অপরপক্ষ (সাকিব) থেকে সাড়া পাননি। এটা কি ঠিক? 

তামিম:  দেখুন, যা হয়েছে, তা দুজনের মধ্যেই হয়েছে। দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে মনে করি, ওখানে যা হয়েছে, তা ওই কক্ষেই থাকা উচিত। এটা নিয়ে কোনো মন্তব্য করব না।

বাংলাদেশ দলে আপনার বন্ধু কে? 

তামিম: সবাই। 

কূটনতিক নয়, সত্যিকার উত্তর… 

তামিম: কূটনৈতিক উত্তর দেইনি। সবাই বন্ধু আমার। তাসকিনের সঙ্গে ডিনারে যাই, তাইজুলের সঙ্গে যাই, মিঠুন-শান্ত, মুশফিক, সবার সঙ্গে যাই। অনেক বন্ধু আমার দলে।

আর বন্ধুর কথা বললে… দেখুন, এটা কিন্তু পেশাদার একটি জায়গা। আমার মনে হয়, সবার সঙ্গে সবার সম্পর্ক একই পর্যায়ের থাকবে না। আমি নিশ্চিত, আপনার অফিসেও সবার সঙ্গে আপনার একইরকম সম্পর্ক নয়। কারও সঙ্গে বেশি থাকে (ঘনিষ্ঠতা), কারও সঙ্গে কম। কাউকে পছন্দ করেন, কাউকে করেন না। এখানেও ব্যাপারটি একদম এরকমই। 

আর এটা শুধু বাংলাদেশ দলে নয়। বিশ্বের যে কোনো জায়গায় তাকান, যে কোনো দলে, যে কোনো জায়গায়, একই ব্যাপার। বারবার শুধু একটি কথাই বলছি, যখন আমরা একসঙ্গে মাঠে নামছি, তখন কাকে কম পছন্দ করছি বা বেশি, এটার কোনো মূল্য নেই। যখন একসঙ্গে নামছি, আমরা সবাই এক হয়ে একই লক্ষ্য নিয়ে নামি। আমি শতভাগ নিশ্চয়তা নিয়ে বলতে পারি, আমাদের সবার লক্ষ্য এক। এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একই কথা বারবারই বলছি।

গুরুত্বপূর্ণ সিরিজের আগে, মাঠের বাইরে এসব বিতর্ক নিয়ে এত কিছু বলতে কেমন লাগছে? 

তামিম: আমি প্রস্তুত ছিলাম। কালকে থেকেই প্রস্তুত ছিলাম। এত সাংবাদিক সংবাদ সম্মেলনে আগে কখনও দেখিনি। তবে প্রস্তুত ছিলাম এবং জানতাম যে এই ধরনের প্রশ্ন আসবে। 

‘নো কমেন্টস’ বলে এড়িয়ে যাওয়া খুব সহজ হতো আমার জন্য। বলতে পারতাম যে শুধু সিরিজ নিয়ে কথা বলি। তবে আমার কাছে মনে হয়, আমার বার্তাটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। শুধু সাংবাদিকদের প্রতি নয়, বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভক্ত -অনুসারীদের প্রতি, সাকিবের ভক্ত, আমার ভক্ত, অন্যদের ভক্ত, সবার প্রতিই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, মাঠে আমরা কেমন করছি। এই কারণেই খুশি মনে উত্তর দিতে প্রস্তুত ছিলাম। 

এই বার্তা কি বোর্ড সভাপতির জন্যও? 

তামিম: সবার প্রতিই… প্রত্যেকের জন্য।