মেহেদী হাসান মিরাজের ১০ উইকেট নেওয়ার ম্যাচে কিছুটা সম্ভাবনা জাগালেও শেষ পর্যন্ত পারল না বাংলাদেশ, ১০ টেস্ট পর জয়ের স্বাদ পেল জিম্বাবুয়ে।
Published : 23 Apr 2025, 06:25 PM
দিনের দ্বিতীয় বলে নাজমুল হোসেন শান্তর ‘আত্মহত্যা।’ বাজে শটে আউট হয়ে ড্রেসিং রুমে না ফিরে প্যাড পরেই তিনি বসে রইলেন সীমানার পাশে ডাগআউটে। টিভি ক্যামেরা ধরতেই ভেসে উঠল হতাশার আধারে ঢেকে থাকা মুখ। তখনও বাকি ছিল ৫ উইকেট। কিন্তু নিজের বিদায়ের পর যেন ম্যাচের সম্ভাব্য ফলাফল বুঝে গেলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।
পরে যদিও লড়াই জমল বেশ। তবে সেই অনুমিত ফলাফলে বদল এলো না। প্রথম ইনিংসের মতো দ্বিতীয়বারেও ৫ উইকেট নিয়ে ম্যাচে রোমাঞ্চ জাগালেন মেহেদী হাসান মিরাজ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পূর্ণতা পেল তার প্রচেষ্টা। চার দিনেই স্বাগতিকদের হারিয়ে দিলো জিম্বাবুয়ে।
সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ৩ উইকেটের জয়ে সিরিজে এগিয়ে গেল সফরকারীরা।
বাংলাদেশের জন্য যতটা হতাশার, জিম্বাবুয়ের জন্য ঠিক ততটাই আনন্দের উপলক্ষ্য। টেস্ট ক্রিকেটে চার বছরের বেশি সময় পর জয়ের স্বাদ পেল তারা। এর আগে আবু ধাবিতে ২০২১ সালের মার্চে আফগানিস্তানকে সবশেষ হারিয়েছিল জিম্বাবুয়ে।
বাংলাদেশের বিপক্ষে সাড়ে ছয় বছর পর জিতল জিম্বাবুয়ে। ২০১৮ সালের নভেম্বরে সিলেটের মাঠে প্রথম টেস্টে ১৫১ রানে জিতেছিল তারা। মাঝের সময়ে তিন টেস্টে কোনো লড়াই করতেই পারেনি তারা।
এবার শুরু লড়াই করলোই না, প্রথম দিন থেকেই দাপট দেখিয়ে জিতল তারা। তৃতীয় দিন শেষে ৪ উইকেটে ১৯৪ রান করা বাংলাদেশ বুধবার আর মাত্র ৬৫ রান করতে পারে। ১৭৪ রানের লক্ষ্যে রেকর্ড গড়ে জেতে জিম্বাবুয়ে।
টেস্ট ক্রিকেটে রান তাড়ায় জয়ে এটিই জিম্বাবুয়ের রেকর্ড। ১৯৯৮ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৬২ রানের লক্ষ্যে ৭ উইকেটে জিতেছিল তারা। সব মিলিয়ে রান তাড়ায় জিম্বাবুয়ের ষষ্ঠ জয় এটি।
জিম্বাবুয়ের কাছেও পরাজয়ে ঘরের মাঠে দৈন্যদশা অব্যাহত রইল বাংলাদেশের। গত বছর দুই সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হওয়াসহ দেশের মাটিতে টানা ছয় টেস্ট হারল শান্তর দল।
সিলেট বুধবারের সকাল ছিল মেঘাচ্ছন্ন। আগের রাতে টানা বৃষ্টির কারণে ভেজা আউটফিল্ডে খেলা শুরু হয় নির্ধারিত সময়ের ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট পর।
শান্তকে দিনের প্রথম বলটিই ইয়র্কার করেন ব্লেসিং মুজারাবানি। সেটি সামলে নেন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। পরের বল বাউন্সার করেন জিম্বাবুয়ের দীর্ঘদেহী পেসার। তেমন বিপজ্জনক ছিল না। পুল করতে গিয়ে ফাইন লেগে ক্যাচ দিয়ে বসেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।
বড় লক্ষ্য দেওয়ার আশা নিয়ে খেলতে নেমে দিনের শুরুতেই চাপে পড়ে যায় বাংলাদেশ। আগের দিনের ৬০ রানের সঙ্গে আর কিছু যোগ করতে পারেননি শান্ত।
অধিনায়কের বিদায়ের পর নামা সহ-অধিনায়কও দায়িত্ব নিতে পারেননি। শুরু থেকেই যেন পাল্টা আক্রমণের পথ ধরেন মেহেদী হাসান মিরাজ। মুজারাবানির পরপর দুই ওভারে চার-ছক্কা মারেন তিনি।
বদলা নিতে সময় নেননি জিম্বাবুয়ের পেসার। অফ স্টাম্পের বাইরের ব্যাক অব লেংথ বলে খোঁচা মেরে গালিতে ক্যাচ দেন মিরাজ। ক্যারিয়ারে তৃতীয় ৫ উইকেট পূর্ণ হয় মুজারাবানির। পরের ওভারে তাইজুল ইসলামকে ফিরিয়ে বাংলাদেশের চাপ বাড়ান ভিক্টর নিয়াউচি।
অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে ততক্ষণ পর্যন্ত সতীর্থদের আসা-যাওয়া দেখছিলেন জাকের আলি। অষ্টম উইকেটে হাসান মাহমুদকে নিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান। দুজন মিলে ৯১ বলে যোগ করেন ৩৫ রান।
এই জুটির বেশিরভাগ বল হাসানই খেলেন। নিয়মিতই ওভারের শুরুর দিকে সিঙ্গেল নিয়ে স্ট্রাইক ছেড়ে দেন জাকের। তবে বাজে বল পেলে সুযোগ বুঝে বাউন্ডারি মেরে রান বাড়াতে থাকেন তিনি।
নিয়াউচির বলে পুল করে বাউন্ডারি মেরে চার ম্যাচের ক্যারিয়ারে চতুর্থ ফিফটি পূর্ণ করেন জাকের। টেস্টে প্রথম চার ম্যাচের প্রতিটিতে পঞ্চাশছোঁয়া ইনিংস খেলা বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান তিনি। প্রথম তিন ম্যাচে ফিফটি করে রেকর্ডটি এত দিন ছিল জাকির হাসানের।
পরের ওভারে ভাঙে হাসানের প্রতিরোধ। অনেক দূরের বল বড় শট মারতে গিয়ে ক্যাচ দেন তিনি। ৫৮ বল খেলে করেন ১২ রান। পরে সৈয়দ খালেদ আহমেদ প্রথম বলেই ধরেন ড্রেসিং রুমের পথ।
৯ উইকেট পড়ে যাওয়ায় আগ্রাসী ব্যাটিং করে রান বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেন জাকের। রিচার্ড এনগারাভার স্লোয়ারে নিজের একমাত্র ছক্কাটি মারেন তিনি। পরের ওভারে মুজারাবানির বলে ছক্কার খোঁজে আউট হন ৫৮ রান করা ব্যাটসম্যান।
প্রথম ইনিংসে ৩টির পর দ্বিতীয়বার ৬ উইকেট নিয়ে ১১ টেস্টে ৫০ উইকেট পূর্ণ করেন মুজারাবানি। জিম্বাবুয়ের হয়ে যা যৌথভাবে দ্রুততম।
বাংলাদেশকে অলআউট করে প্রথম সেশনে ১ ওভারের জন্য ব্যাটিংয়ে নামে জিম্বাবুয়ে। ওই ওভারে কোনো বিপদ ঘটতে দেননি বেন কারান ও ব্রায়ান বেনেট।
মধ্যাহ্ন বিরতির পর ব্যাটিংয়ে নেমে স্বাগতিক বোলারদের ওপর চড়াও হন জিম্বাবুয়ের দুই ওপেনার। ইতিবাচক ব্যাটিংয়ে ওয়ানডের গতিতে রান করতে থাকেন তারা। দ্বাদশ ওভারে পূর্ণ হয় তাদের জুটির পঞ্চাশ রান।
প্রথম ইনিংসেও পঞ্চাশছোঁয়া জুটি গড়েন বেনেট ও ব্রায়ান। প্রায় ১৪ বছর পর জিম্বাবুয়ের উদ্বোধনী জুটি এক ম্যাচে দুটি পঞ্চাশছোঁয়া জুটি গড়ল। সবশেষ ২০১১ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষেই এই কৃতিত্ব দেখান ভুসিমুজি সিবান্দা ও টিনো মাওয়ায়ো।
শতক পূর্ণ হওয়ার আগে উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন মিরাজ। বড় শটের খোঁজে হাওয়ায় ভাসিয়ে দেন ৭৫ বলে ৪৭ রান করা কারান। ৯৫ রানে ভাঙে প্রথম উইকেটের বন্ধন।
অন্য প্রান্তে ৬৫ বলে ম্যাচে নিজের দ্বিতীয় ফিফটি করেন বেনেট। দ্রুতই নিক ওয়েলচকে ফেরান তাইজুল।
শেষ সেশনে নাটকীয়তার জন্ম দেন মিরাজ। তার আচমকা টার্নের সঙ্গে লাফিয়ে ওঠা বলে হকচকিয়ে যান শন উইলিয়ামস। ৯ রান করে ধরেন ড্রেসিং রুমের পথ।
মিরাজের পরের ওভারে বড় শটের খোঁজে টাইমিং করতে পারেননি বেনেট। লং অনে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন ৭ চার ও ১ ছক্কায় ৫৪ রান করা তরুণ ওপেনার।
পরে তাইজুলের বলে কট বিহাইন্ড হন ক্রেইগ আরভাইন। এখানেও বড় ভূমিকা মিরাজের। অনেকটা জোর করেই শান্তকে দিয়ে সফল রিভিউ নেওয়ান বাংলাদেশ সহ-অধিনায়ক।
পরের ওভারে নিয়াশা মায়াভোকে বোল্ড করে ম্যাচে উত্তেজনা বাড়ান মিরাজ। ৪ উইকেট বাকি রেখে তখনও জয় থেকে ২৯ রানে দূরে ছিল জিম্বাবুয়ে।
আট নম্বরে নেমে পাল্টা আক্রমণ শুরু করেন ওয়েলিংটন মাসাকাদজা। তাইজুলের পরপর দুই ওভারে ছক্কা ও চার মেরে দেন তিনি। তবে বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। দারুণ ডেলিভারিতে মাসাকাদজাকে বোল্ড করে ৫ উইকেট পূর্ণ করেন মিরাজ।
তখনও বাকি ছিল ১৩ রান। তাই আশা দেখছিল বাংলাদেশ। এর মাঝেই এক দফা বৃষ্টি ও পরে আলোকস্বল্পতার কারণে খেলা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তবে ফ্লাডলাইট জ্বালিয়েই চলতে থাকে খেলা।
মিরাজের বলে লং অন দিয়ে বাউন্ডারি মেরে দেন এনগারাভা। তাইজুলের বলে স্লগ করে চার মারেন মাধভেরে। পরে মিরাজের বলে রিভার্স সুইপ করে মারা বাউন্ডারিতে দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয় নিশ্চিত করেন মাধভেরে।
শেষ পর্যন্ত পরাজিত দলে থাকলেও দারুণ বোলিংয়ে একাধিক অর্জন ধরা দিয়েছে মিরাজের। এ নিয়ে তৃতীয়বার ম্যাচে দশ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের সবাইকে ছাড়িয়ে গেলেন তিনি। সাকিব আল হাসান ও তাইজুলের আছে দুবার করে দশ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড।
একইসঙ্গে ৫২ ম্যাচে দুইশ উইকেট পূর্ণ হলো তার। বাংলাদেশের বোলারদের মধ্যে মিরাজের আগে দুইশ উইকেট পেয়েছেন শুধু সাকিব ও তাইজুল।
জিম্বাবুয়ের কাছে এমন পরাজয়ের পর অবশ্য এরকম ব্যক্তিগত অর্জন কোনো স্বান্ত্বনা হতে পারে না!
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ১৯১
জিম্বাবুয়ে ১ম ইনিংস: ২৭৩
বাংলাদেশ ২য় ইনিংস: (আগের দিন ১৯৪/৪) ৭৯.২ ওভারে ২৫৫ (শান্ত ৬০, জকের ৫৮, মিরাজ ১১, তাইজুল ১, হাসান ১২, খালেদ ০, নাহিদ ০*; নিয়াউচি ১৮-৪-৪২-১, মুজারাবানি ২০.২-৫-৭২-৬, এনগারাভা ১৯-০-৭৪-১, মাধভেরে ৮-১-৩২-০, মাসাকাদজা ১৪-৪-২০-২)
জিম্বাবুয়ে ২য় ইনিংস: (লক্ষ্য ১৭৪) ৫০.১ ওভারে ১৭৪/৭ (কারান ৪৪, বেনেট ৫৪, ওয়েলচ ১০, উইলিয়ামস ৯, আরভাইন ১০, মাধেভেরে ১৯*, মায়াভো ১, মাসাকাদজা ১২, এনগারাভা ৪*; নাহিদ ৫-০-২৪-০, হাসান ৪-১-১৩-০, মিরাজ ২২.১-৮-৫০-৫, খালেদ ৩-১-৬-০, তাইজুল ১৬-০-৭০-২)
ফল: জিম্বাবুয়ে ৩ উইকেটে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: ব্লেসিং মুজারাবানি