‘মিরাকল’ মিরাজ এখন পূর্ণতার পথে

বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে যেরকম ছিলেন, এখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও তেমন পরিপূর্ণ অলরাউন্ডার হওয়ার পথে তিনি।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Dec 2022, 04:35 AM
Updated : 8 Dec 2022, 04:35 AM

উইকেটে শেষ জুটি। জয় তখনও দৃষ্টিসীমার বাইরে। সেখান থেকে প্রবল প্রতিরোধে ম্যাচ জয়ের মতো কিছু কেবল লোকের স্বপ্নে থাকে। কিংবা ভিডিও গেমসে। ইনিংসের বয়স অর্ধেক না হতেই ব্যাটিং অর্ডারের অর্ধেকের বেশি হারিয়ে ধুঁকছে দল। সেই অবস্থায় ব্যাটিংয়ে নেমে পাল্টা আক্রমণে সেঞ্চুরি আর রেকর্ডের পর রেকর্ড। এসব আসলে থাকে কল্পনায়। আর রূপকথায়। বাস্তবে রূপ পায় কদাচিৎ। ভারতের বিপক্ষে চলতি সিরিজে মেহেদী হাসান মিরাজ এমন কিছুই করে দেখালেন পরপর দুই ম্যাচে। তাকে ‘মিরাকল’ মিরাজ বললে এখন বাড়িয়ে বলা হয় না খুব একটা। 

ওয়ানডেতে আটে নেমে পঞ্চাশের বেশি ইনিংস খেলা ক্রিকেটার আছেন ১১ জন। নামগুলিতে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। শন পোলক, ওয়াসিম আকরাম, আব্দুর রাজ্জাক, ড্যানিয়েল ভেটোরি, হিথ স্ট্রিক, ড্যারেন স্যামি এবং আরও কজন। ওয়ানডে ইতিহাসের সেরা অলরাউন্ডারদের মধ্যে থাকে তাদের নাম। এই পজিশনে তাদের কারও ব্যাটে আসেনি সেঞ্চুরি। মিরাজ ওই জাদুকরি তিন অঙ্কের দেখা পেয়ে গেছেন অর্ধেক ইনিংস খেলেই (২৫)। 

অনেকে বলতে পারেন, এই নামগুলির সঙ্গে মিরাজের একটু পার্থক্য আছে। তারা সবাই বোলিং অলরাউন্ডার। মিরাজ তো বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই ‘জেনুইন’ অলরাউন্ডার! এই কথায় ভুল নেই। তবে ফাঁক আছে। এখনও তিনি নিয়মিত ব্যাট করছেন আটে। দলে আছেন মূলত বোলিংয়ের কারণেই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার মূল পরিচয় বোলারই। বলা যায়. গত বছর দেড়েকে ব্যাটিং পারফরম্যান্সে ‘বোলিং অলরাউন্ডার’ হয়ে উঠেছেন। 

এখন সেই ধাপ পেরিয়ে তিনি ছুটছেন বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের সম্ভাবনাকে পূর্ণতা দেওয়ার পথে। মিরাজের পারফরম্যান্সে এখন সত্যিকারের পরিপূর্ণ অলরাউন্ডারের ছাপ। 

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি স্বাদ পেয়ে গেছেন তিনি চট্টগ্রামে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। তবে বয়সভিত্তিক ক্রিকেট মাতিয়েছেন যে সংস্করণে, সেই ৫০ ওভারের ক্রিকেটে তার অলরাউন্ডার সত্ত্বার সত্যিকারের আবির্ভাব এই বছর থেকে। 

এ বছর এখনও পর্যন্ত ১৪ ওয়ানডে খেলে ৯ বার ব্যাট করে মিরাজের রান ৩২৭। ব্যাটিং গড় ৮১.৭৫। বাংলাদেশে তার গড়ের ধারেকাছে নেই আর কেউ। স্ট্রাইক রেট ৮৪.৪৯। অন্তত ২০০ রান করা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে এখানেও তিনি দেশের সেরা। 

বল হাতে উইকেট ২৩টি। বাংলাদেশের হয়ে ১৫ উইকেটের বেশি নেই আর কারও। একাধিকবার ৪ উইকেট শিকারি একমাত্র বোলারও তিনি। 

ফিল্ডিংয়ে তিনি ক্যাচ নিয়েছেন ৭টি। কিপার ছাড়া তার চেয়ে বেশি ক্যাচ নেই দলের অন্য কারো। গ্রাউন্ড ফিল্ডিংয়েও তিনি বরাবরের নির্ভরতা। এই সিরিজেও তিনি দুই ম্যাচে রান বাঁচিয়েছেন বেশ কিছু। বিশেষ করে বৃত্তের ভেতরে তিনি দুর্দান্ত। 

সব মিলিয়ে ওয়ানডের এই বছরের মিরাজ সত্যিকারের এক অলরাউন্ডারের প্রতিচ্ছবি। 

অনেকের হয়তো মনেও নেই, ওয়ানডে ক্রিকেটে নিজের প্রথম ইনিংসেই তিনি ফিফটি করেছিলেন। সেই ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কায়। কিন্তু সেটা ছিল বোলার মিরাজের ফিফটি। অলরাউন্ডার হয়ে উঠতে তার সময়ে লেগেছে। তবে এত কম বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরু করেছেন, সময়টা তার হাতে ছিল। এখনও সামনে পড়ে আছে অনেক সময়।

ব্যাটিং পারফরম্যান্সে আত্মবিশ্বাসী মিরাজ এখন সময়ের সঙ্গেই এগিয়ে যেতে চান উন্নতির পথ ধরে। 

“আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ার যখন শুরু হয়েছিল, বোলার হিসেবেই হয়েছিল, টেস্ট ক্রিকেটে। ব্যাটিংটা লেটে করা হতো। তখন নিজেকে মানসিকভাবে ওইভাবে তৈরি করেছিরাম যে বোলিং যেহেতু করছি, ভালো হচ্ছে। ব্যাটিংয়ে ওইভাবে সুযোগ পাচ্ছিলাম না। এখন তো অনেক পরিপূর্ণ হয়েছি, অনেক দিন থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছি, ৫-৬ বছর হয়ে গেছে। এখন মানিয়ে নিয়েছি যে কীভাবে খেললে ভালো হবে।” 

“যে জায়গায় উন্নতি করতে হবে, সেই জায়গায় কাজ করেছি। সবসময় চেষ্টা করি যে, কীভাবে প্রতিদিন উন্নতি করা যায়। আমার শুরুর দিকে ব্যাটিং খুবই খারাপ ছিল, বলতে গেলে ভালোই ছিল না। এখন যে অনেক ভালো হয়ে গেছে, এটা নয়। তবে ভালোর তো শেষ নেই, উন্নতির শেষ নেই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে হলে প্রতিদিন উন্নতি করতে হবে। উন্নতি ছাড়া কখনোই সফল হওয়া সম্ভব নয়। নিজেকে ওইভাবেই মানসিকভাবে তৈরি করেছি কীভাবে ভালো করা যায়।” 

২০১৬ সালে দেশের মাঠে টার্নিং উইকেটের বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে আচমকাই তাকে টেস্ট ক্রিকেটে নামিয়ে দেওয়া হয় মূলত বোলিংয়ের কারণে। অভিষেক টেস্টে তিনি পেয়ে যান ৭ উইকেট, পরের টেস্টে ১২টি। সেটিও তো ছিল ‘মিরাকল!’ বোলার পরিচয় তার সঙ্গে এমনভাবে সেঁটে যায়, তিনি নিজেও সেই পরিচয়ের ঘোরে মজে যান। 

তবে দল যখন তার ব্যাটিংয়ে আস্থা রাখতে শুরু করল, ক্রমে তিনিও আত্মবিশ্বাস পেয়ে উজ্জীবিত হয়ে উঠলেন দারুণ কিছু করতে। 

“যখন শুরু করেছিলাম, বোলার হিসেবে বিবেচনা করা হতো আমাকে। তবে টিম ম্যানেজমেন্ট বলেন বা ক্রিকেটাররা যদি সুনির্দিষ্টভাবে কোনো ক্রিকেটারের ওপর বিশ্বাস রাখে, কোনো ক্রিকেটারকে তাদের ভালো লাগে, তখন কিন্তু ওই ক্রিকেটারের নিজের ভেতরও আত্মবিশ্বাস চলে আসে। যখন বোলার হিসেবে খেলেছি, আমার মনে হতো, ‘আমি হয়তো বোলারই, ব্যাটিং পারি না।’ এখন বাংলাদেশ দল বলুন বা সবাই আমার ওপর বিশ্বাস রাখে।” 

“আমাকে কিন্তু ওপেনিংয়ে অনেক সুযোগ দেওয়া হয়েছে, ওপরে চেষ্টা করা হয়েছে। তার মানে আমারও বিশ্বাস চলে এসেছে যে আমার ওপর তাদের বিশ্বাস আছে, সেটা আমার মধ্যেও চলে এসেছে। নিজের বিশ্বাস বেড়ে গেছে।” 

মিরাজকে ওপেনিংয়ে সুযোগ দেওয়া হয়েছে মূলত টি-টোয়েন্টিতে। এই সংস্করণে বাংলাদেশের শুরুর দুর্দশা ঘোচাতে গত এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টি থেকে মূলত এই পরীক্ষা-নীরিক্ষা চালানো হয়। ওই সংস্করণে পরীক্ষাটা সফল হয়নি। তবে দিনশেষে লাভ যে হয়েছে, সেটিই এখন প্রতিফলিত হচ্ছে মিরাজের ব্যাটে। 

“এটা আমার কাজে লেগেছে। বিশেষ করে নিউ জিল্যান্ডে ওপেন করেছি, পেস বোলারদের খেলেছি, ওখানে অনেক কাজে লেগেছে, উন্নতি হয়েছে। দুবাইয়েও ওপেন করেছি, এটা কাজে দিয়েছে। টিম ম্যানেজমেন্ট যখন আমার ওপর বিশ্বাস রেখেছে, আমারও বিশ্বাস চলে এসেছে। যা আমাকে সহায়তা করেছে।” 

যুব ওয়ানডের ইতিহাসে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি বোলার তিনি ৮০ উইকেট নিয়ে। ব্যাট হাতে ১ হাজার ৩০৫ রান করে রান সংগ্রহের তালিকায় আছেন তিনি এগারোয়। এখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও তার দুই সত্ত্বা প্রস্ফুটিত হতে শুরু করেছে সমানভাবে। 

বাংলাদেশ কোচ রাসেল ডমিঙ্গো তো এবার প্রথম ম্যাচের পরই বলে দিয়েছেন, সাকিব আল হাসানের মতো অলরাউন্ডার হওয়ার পথেই আছেন মিরাজ। ২৫ বছর বয়সী এই অলরাউন্ডার তিনি অবশ্য এখনই সাকিব নামক এভারেস্টের চূড়ায় তাকাচ্ছেন না। তিনি থাকতে চান উন্নতির প্রক্রিয়ায়, এগোতে চান একটু একটু করে। 

“আগেই বলেছি, প্রতিদিন উন্নতির চেষ্টা করছি। বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচ আছে, তিনি কাজ করছেন। আমাদের যে ব্যাটিং কোচ আছেন, সবসময়ই কাজ করছেন আমার সঙ্গে। সবচেয়ে বড় কথা যেটি বললেন, ব্যাটিংয়ের উন্নতি কিন্তু একদিনে সম্ভব নয়। প্রতিদিন উন্নতি করতে করতে একটা জায়গায় আসে।” 

এখন যে জায়গায় আছেন মিরাজ, তাতে দলের ভরসা তার ওপর আছে। আর আছে আশা। মিরাজ হয়ে উঠবেন পরিপূর্ণ অলরাউন্ডার। ব্যাটে-বলে-ফিল্ডিংয়ে এবং হয়তো, নেতৃত্বেও!