পাওয়ার প্লেতে তিনি ব্যাটসম্যানদের বিভীষিকা, শেষের সময়টায় যেন সাক্ষাৎ যম। অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, ২০ ওভারের ম্যাচে তার চার ওভার হিসেবের বাইরে রেখে সমীকরণ সাজাতে হয় প্রতিপক্ষকে।
Published : 30 Jun 2024, 05:03 PM
চোটের কারণে ক্যারিয়ার খুব দীর্ঘ হয়নি ইয়ান বিশপের। কিন্তু সেরা সময়ে তিনি ছিলেন ভয়ঙ্কর এক ফাস্ট বোলার। শন পোলক তো বিশ্ব ক্রিকেটেরই গ্রেট। কিন্তু জাসপ্রিত বুমরাহকে দেখে তাদের বিস্ময়ের শেষ নেই। ফাইনালে তারা ধারাভাষ্যে বারবার বলছিলেন, এমন বোলিং কীভাবে সম্ভব! শুধু এই দুজনই কেন, ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস থেকে ডেল স্টেইন, ক্রিকেট ইতিহাসের কিংবদন্তি সব পেসাররা বুমরাহর বোলিং দেখে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে হয়রান।
ফাইনাল শেষে রোহিত শার্মার কাছে এই প্রশ্নই করলেন বিশপ। ভারতীয় অধিনায়ক হেসে উত্তর দিলেন, এত বছর ধরে কাছ থেকে দেখে তিনি নিজেও বুঝতে পারেন না, এমন অতিমানবীয় বোলিং কীভাবে করেন বুমরাহ।
এটিই এখনকার বুমরাহ। একটি দলের বিশ্বকাপ জয় তো দু-একজনের জন্য হয় না। তবে ভারতের বিশ্বকাপ সাফল্যের যদি যে কোনো একটি কারণ বলতে বলা যায়, যে কেউ হয়তো বলবেন ওই একজনের কথাই। এই বিশ্বকাপের বুমরাহ ছিলেন এক জাদুকর। ভারতের আশীর্বাদ, প্রতিপক্ষের আতঙ্ক।
এবারের আসরে ৮ ম্যাচে ১৫ উইকেট তার। বোলিং গড় ৮.২৬। এর চেয়েও পাগলাটে পরিসংখ্যান আছে। ওভারপ্রতি রান দিয়েছেন মোটে ৪.১৭! তার ম্যান অব দা টুর্নামেন্ট পুরস্কার পাওয়া নিয়ে দ্বিমত করার মতো একজন মানুষও হয়তো গোটা ক্রিকেটবিশ্বে মিলবে না।
পরিসংখ্যানই অনেকটা বলে দিচ্ছে, এবারের বিশ্বকাপের বুমরাহ কতটা দুরূহ ছিলেন ব্যাটসম্যানদের জন্য। তবে আদতে, এই সংখ্যাগুলি ফুটিয়ে তুলতে পারছে না সবকিছু।
প্রতিপক্ষ সব দলেরই সাধারণত লক্ষ্য থাকে, বুমরাহকে কোনোভাবেই উইকেট দেওয়া যাবে না। যতটা সম্ভব নিরাপদে খেলে পার করে দিতে হবে। তার পরও এতগুলি উইকেট তিনি আদায় করে নিয়েছেন।
নতুন বল হোক বা পুরোনো বল, ইনিংসের শুরুতে হোক বা মাঝে কিংবা, উইকেট ব্যাটিং সহায়ক হোক বা স্পিন-বান্ধব, বুমরাহর বদল নেই যেন। গতি আর বাউন্স, দুই দিকেই সুইং, নিখুঁত ও অস্বস্তিকর লাইন-লেংথ, রিভার্স সুইং, ব্যাটসম্যানের দুর্বলতায় আঘাত হানা, বৈচিত্র আর অভিজ্ঞতা, সব মিলিয়ে তিনি পরিপূর্ণ এক ফাস্ট বোলারের প্রতিচ্ছবি।
সবচেয়ে বড় কথা, বলের পর বল, ওভারের পর ওভার, দিনের পর দিন একই কাজ তিনি করে যাচ্ছেন। ভেন্যু, শহর, প্রতিপক্ষ, কন্ডিশন, পিচ কোনো পারিপার্শ্বিকতায় যেন তার কিছুই যায়-আসে না।
পাওয়ার প্লেতে তিনি ব্যাটসম্যানদের বিভীষিকা, শেষের সময়টায় তো যেন সাক্ষাৎ যম। অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, ২০ ওভারের ম্যাচে তার চার ওভার হিসেবের বাইরে রেখে সমীকরণ সাজাতে হয় প্রতিপক্ষকে। এই চার ওভার থেকে যা কিছু আসবে, তা যেন বোনাস! শেষের ওভারগুলোয় যখন সমীকরণ মেলানোর পালা, বুমরাহর দুই ওভার বাদ দিয়ে বাকি ওভারগুলোর পরিকল্পনা করতে হয়।
শনিবার ফাইনালেও যথারীতি বড় পার্থক্য গড়ে দিলেন তিনি জাদুকরী বোলিংয়ের প্রদর্শনীতে। নতুন বলে ভারতকে তিনি এনে দিলেন প্রথম ব্রেক থ্রু। অসাধারণ ডেলিভারিতে বোল্ড হয়ে হতভম্ব হয়ে গেলেন রিজা হেনড্রিকস। দক্ষিণ আফ্রিকান ওপেনার কিছু বুঝতেই পারছিলেন না, কীভাবে পরাস্ত হলেন।
পাওয়ার প্লে দুই ওভারের পর আবার যখন তিনি বোলিংয়ে এলেন, ভারতের জয়ের স্বপ্ন তখন ভীষণ ম্লান। সেটিকে উজ্জ্বল করার কাজটিও শুরু হলো বুমরাহর হাত ধরে। ষোড়শ ওভারে বিপজ্জনক দুই প্রোটিয়া ব্যাটসম্যানকে আটকে রেখে রান দিলেন কেবল চার। ৩০ বলে ৩০ রান থেকে সমীকরণ একটু কঠিন হলো তাতে।
পরে অষ্টাদশ ওভারটিতে বাস্তবিক অর্থেই ভারতের স্বপ্ন ফিরিয়ে আনলেন তিনি আগুনে বোলিংয়ে। ওভারে কেবল দুই রান দিয়ে উইকেট নিলেন একটি। মার্কো ইয়ানসেন বোল্ড হয়ে যথারীতি হতভম্ব ও অসহায়। তার করার তেমন কিছু ছিল না।
টুর্নামেন্ট জুড়েই তার এই রূপ দেখা গেছে। তার প্রতিটি উইকেট যেন এককটি গল্প, প্রতিটি ওভার আর প্রতিটি স্পেল একেকটি রহস্য উপন্যাস।
ম্যাচ শেষে যখন রোহিত শার্মাকে সেই রহস্য ভেদ করতে বলা হলো, ভারতীয় অধিনায়ক বললেন, তিনি নিজেও বুমরাহর কূল-কিনারা পান না।
“আমি বুঝতে পারি, আপনারা তাকে ভাষায় ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন। তবে আমি ওকে এত বছর ধরে দেখছি, একসঙ্গে খেলছি…এমনকি আমিও জানি না, ওর ব্যাপারটা আসলে কী! আমি জানি, সে কী করতে পারে। কিন্তু কীভাবে এসব করে (তা জানি না)… এটা স্রেফ মাস্টারক্লাস…।”
এই যে বুমরাহর ওপর দলের এতটা নির্ভরতা, তার চার ওভারকে ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের মতোই নিরাপদ ভাবা, এসব তো বড় একটা চাপও! ম্যাচের পর ম্যাচ, দিনের পর দিন এই প্রত্যাশা পূরণ করা বিশাল এক চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে এমন বড় ম্যাচে, দল যখন তার কাছে নতুন বলে ব্রেক থ্রু চায়, যখন ওভার বাকি কেবল একটি, কিন্তু দল চায় তার হাতের ইন্দ্রজালে খেলার মোড় পাল্টে দিতে, চাপ তো তখন পেয়ে বসার কথা!
সেই চাপ সামলানোর নিজস্ব পদ্ধতির কথা ম্যাচ শেষে বললেন বুমরাহ।
“আমি ব্যাপারটা (চাপ) এভাবে দেখি না। যখন মানসিক অবস্থা চূড়ায় থাকি, আমি স্রেফ একটি করে ডেলিভারি নিয়ে ভাবি এবং একটি করে ওভার ভাবনায় রাখি। ম্যাচের সার্বিক অবস্থা একটু আগেভাগেই ভাবনায় নিয়ে ফেললে অতিরিক্ত চেষ্টা করে নিজের ওপর চাপ নিয়ে ফেলি কখনও কখনও। কাজেই আমার জন্য কাজে দিচ্ছে, সেভাবেই চেষ্টা করেছি।”
“এখন কাজ হয়ে গেছে। আবেগের জোয়ার বইতে পারে। এখন আমি গলা ফাটাতে পারি।”
তার এই রূপ দেখেও বিস্মিত হতে পারেন অনেকে। বোলিংয়ের মতো আচরণেও বুমরাহ এমনিতে খুব পরিশীলিত। আবেগের প্রকাশ তেমন একটা দেখা যায় না। তবে বিশ্বকাপ ফাইনাল জয়ের পর নিজেকে হারিয়ে ফেলতেই পারেন!
২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপ হারের বিষাদ পেছনে ফেলার তৃপ্তিও তাকে ছুঁয়ে গেল। সব মিলিয়ে তিনি যেন আত্মহারা।
“এমনিতে আমি এমন একজন, যে আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রেখে শান্ত থাকতে চায় এবং নিজের কাজ মনোযোগ দেয়। তবে আজকে খুব বেশি কথা খুঁজে পাচ্ছি না, আবেগ ঘিরে ধরেছে একেবারে। খেলা শেষে আমি এমনিতে কাঁদি না.. তবে এই অর্জন তো সত্যিই স্পেশাল। মাঝের সময়টায় মনে হচ্ছিল, আমরা বিপাকে পড়েছি। সেখান থেকে এভাবে জিততে পারার অনুভূতি অবিশ্বাস্য।”
“সত্যি বলতে আমি আকাশে উড়ছি… আমার ছেলে এখানে আছে, আমার পরিবার এখানে এবং ওদের সামনে ভারতের জন্য কিছু করতে পারলাম। এটার জন্য আমরা কঠোর পরিশ্রম করছিলাম। সবশেষবার আমরা কাছাকাছি গিয়েও আটকে গিয়েছি। এবার শেষ পর্যন্ত যেতে পেরেছি। এর চেয়ে ভালো অনুভূতি আর কিছু নেই। আমরা এই খেলা খেলি এসবের জন্যই। এমন দিনের জন্য। বড় মঞ্চে যখন কেউ ভালো করে এবং দলকে জিতিয়ে দেয়, এর চেয়ে ভালো অনুভূতি আর নেই।”