টি-টোয়েন্টির ফ্র্যাঞ্চাইজি জগতের পরিচিত মুখ ট্রিস্টান স্টাবস প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিতে সম্ভাবনার ছাপ রাখলেন লাল বলের ক্রিকেটে।
Published : 29 Oct 2024, 10:32 PM
২০২২ আইপিএলের মাঝামাঝি সময়ের কথা। চোটের কারণে ছিটকে গেলেন টাইমাল মিলস। ইংলিশ পেসারের বদলে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স দলে নিল ট্রিস্টান স্টাবস নামের এক দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটসম্যানকে। বেশ তোলপাড় পড়ে গেল। তাকে নিয়ে গবেষণাও হলো বিস্তর। দেশের বাইরে খুব লোকই যে তাকে চিনতেন! বয়স ২১। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেননি। দক্ষিণ আফ্রিকার ঘরোয়া ক্রিকেটে মাত্রই খেলতে শুরু করেছেন। এমন আনকোরা একজনের মধ্যে কী পেয়েছিল মুম্বাইয়ের মতো তারকায় ঠাসা ফ্র্যাঞ্চাইজি!
অতীতের মগ্নতা থেকে মুখ তুলে চলে আসা যাক বর্তমানে। আড়াই বছর আগে আইপিএলে ডাক পেয়ে আলোচনা খোরাক জোগানো সেই ছেলেটি এবার উদযাপনে মেতে উঠলেন জহুর আহমেদ চৌধুরি স্টেডিয়ামে। প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির উল্লাস!
মাঝের সময়টায় বদলে গেছে অনেক কিছুই। তার জীবনও। আইপিএলে তার উপস্থিতি এখন নিয়মিত। ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টির জগতে তিনি পরিচিত মুখ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিন সংস্করণে অভিষেক হয়ে গেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার তো বটেই, বিশ্ব ক্রিকেটেও সবচেয়ে উজ্জ্বল তরুণ প্রতিভাদের একজন মনে করা হয় তাকে। সেই সম্ভাবনার পথ ধরে এগিয়ে যেতে বড় এক পদক্ষেপ নিলেন চট্টগ্রামে। বাংলাদেশের বোলারদের ভুগিয়ে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির রঙে রাঙালেন নিজেকে।
আইপিএলে যখন তাকে নিয়েছিল মুম্বাই, তখন ঘরোয়া ক্রিকেটেই স্রেফ ১৭ টি-টোয়েন্টির অভিজ্ঞতা ছিল তার। তবে উঠতি প্রতিভা হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটে আলাদাভাবে নজর কেড়েছিলেন। ক্রিকেট সাউথ আফ্রিকার টি-টোয়েন্টি চ্যালেঞ্জে সেবার ২৯৩ রান করেছিলেন ১৮৩.১২ স্ট্রাইক রেটে। এসব জেনেই তাকে নিয়েছিল মুম্বাই।
সেবার মুম্বাইয়ের হয়ে দুটি ম্যাচ খেলে তার রান ছিল শূন্য ও দুই। তবে তার প্রতিভা চাপা থাকেনি। আইপিএলের পরপরই দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে টি-টোয়েন্টি দিয়ে আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়ে যায় তার। দেশের হয়ে প্রথমবার ব্যাট করতে নেমে ২৮ বলে ৭২ রানের বিধ্বংসী ইনিংস খেলেন ৮ ছক্কায়। ওই বছর এসএ টোয়েন্টির ড্রাফটে ৯২ লাখ র্যান্ড (প্রায় ৫ লাখ ২০ হাজার ডলার) পারিশ্রমিকে দল পেয়ে তিনি ছিলেন সবচেয়ে দামি ক্রিকেটার।
এরপর তো ক্রমে তার ওপর নজর পড়ে টি-টোয়েন্টি লিগগুলোর। দক্ষিণ আফ্রিকার টি-টোয়েন্টি দলেও নিয়মিত হয়ে ওঠেন তিনি।
এই বছরের জানুয়ারিতে টেস্ট ক্যাপও পেয়ে যান তিনি। অভিষেক টেস্টে ভারতের বিপক্ষে ভালো করতে পারেননি। পরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গিয়ে প্রথম টেস্ট ফিফটির স্বাদ পান। ত্রিনিদাদে ইনিংসটি শেষ হয় ৬৮ রানে। ওই সিরিজের বাকি তিন ইনিংসেই ২০ ছুঁয়ে আউট হয়ে যান ৩০ করার আগেই। এরপর এই বাংলাদেশ সফর। মিরপুরে প্রথম টেস্টে আবার আউট হন ২৩ রানে। দ্বিতীয় ইনিংসে অপরাজিত থাকেন ৩০ রানে।
যে সম্ভাবনা নিয়ে তার ইনিংসগুলো শুরু হচ্ছিল, সেটির পূর্ণতা পেল অবশেষে চট্টগ্রামে। উইকেট ছিল ব্যাটিং সহায়ক। সেটি কাজে লাগিয়ে তিনি করলেন সেঞ্চুরি।
স্বচ্ছন্দ ব্যাটিংয়ে এগিয়ে গেলেও ৯৯ রানে দাঁড়িয়ে একটু থমকে গিয়েছিলেন। সাত বলে রান করতে পারেননি। পরে শতরান পূরণ করেন ১৯৪ বল খেলে।
তার ওই সময়ের অনুভূতির কথা শোনালেন দিনের খেলা শেষে সংবাদ সম্মেলনে।
“তিন অঙ্ক ছুঁতে পেরে অন্য সব কিছুর চেয়ে স্বস্তিটাই ছিল বেশি… এটা অবশ্যই এখন আমার প্রিয় সেঞ্চুরি।”
টি-টোয়েন্টি ব্যাটসম্যান হিসেবে পরিচিতি থেকে টেস্ট সেঞ্চুরির যে পথচলা, সেই প্রসঙ্গও উঠল। তিনি বললেন সব সংস্করণের প্রতি অনুরাগের কথা।
“টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটার হয়ে ওঠার আগে, আমি আসলে সবসময় লাল বলের ক্রিকেটারই ছিলাম। ব্যাপারটি মূলত মানসিকতার। সত্যি বলতে, আমার সবচেয়ে প্রিয় সংস্করণ ৫০ ওভারের ক্রিকেট। তবে টেস্ট ক্রিকেটও ভালোবাসি।”
‘লাল বলের ক্রিকেটার’ হিসেবে তার আগের পরিচিতির স্বাক্ষ দেবে পরিসংখ্যানও। এই টেস্টের আগে ২১টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে ৫টি সেঞ্চুরি করে ফেলেছেন। এর মধ্যে ট্রিপল সেঞ্চুরিও আছে একটি।
তার প্রিয় সংস্করণেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শুরুটা ভালোই করেছেন সাত ওয়ানডেতে একটি করে সেঞ্চুরি ও ফিফটি করেছেন, ব্যাটিং গড় প্রায় পঞ্চাশ।
সব মিলিয়ে ব্যাটসম্যান হিসেবে সব সংস্করণের উপযোগী হয়ে ওঠার উপকরণ তার ব্যাটিংয়ে মিলতে শুরু করেছে। এই শতরানেই যেমন, অনেকটা সময় নিয়ে তিনি গড়েছেন ইনিংসটি। টনি ডি জর্জি ও এইডেন মার্করামের ৬৯ রানের উদ্বোধনী জুটি থামে ৩৩ রানে মার্করাম বিদায় নেওয়ায়। এরপর ডি জর্জির সঙ্গে স্টাবস গড়ে তোলেন বড় জুটি।
২৫ রানে একটা সুযোগও দিয়েছিলেন। অভিষিক্ত কিপার মাহিদুল ইসলাম স্টাম্পিং করতে পারেননি। এরপর আর ভুল করেননি।
সহজাত আগ্রাসী ব্যাটসম্যান হলেও ফিফটি করেন তিনি ১০৭ বলে। সেখানে চার ছিল স্রেফ তিনটি। ফিফটির পর তিনটি ছক্কা তিনি মেরেছেন, তবে প্রচুর বল ছেড়েছেনও। সব মিলিয়ে টেস্ট মেজাজের ব্যাটিংই করেছেন।
দিনের আরেক সেঞ্চুরিয়ান ১৪১ রানে অপরাজিত থাকা ডি জর্জির সঙ্গে তার জুটি ছিল ২০১ রানের।
নিজের সেঞ্চুরির জন্য উইকেটে লম্বা সময়ের সঙ্গী ডি জর্জির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুললেন না স্টাবস।
“আমি এমনকি দেখিওনি যে এইডেন (মার্করাম) কীভাবে আউট হলো। শুরুতে সত্যিই খুব নার্ভাস ছিলাম। তবে টনির (ডি জর্জি) সঙ্গ ব্যাট করাটা ছিল দারুণ। সে খুব স্থির ছিল, দারুণভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল। তাকে বিশাল কৃতিত্ব দেব আমি।”
“লাঞ্চের পর তার পায়ে ক্র্যাম্প করেছিল। তার পরও চালিয়ে গেছে। সারাদিন ব্যাট করার অবিশ্বাস্য মানসিক শক্তি সে দেখিয়েছে। আমরা পরস্পরকে মনে করিয়ে দিচ্ছিলাম, কোনো কিছুই প্রাপ্য ধরে নেওয়া যাবে না। তার সঙ্গে ব্যাট করা সত্যিই ছিল উপভোগ্য।”
তিনি যেভাবে এগোচ্ছেন, সামনের অনেক বছর হয়তো তার ব্যাটিং উপভোগ করবে গোটা ক্রিকেটবিশ্ব।