বাংলাদেশ-আফগানিস্তান সিরিজ
আগের চার ম্যাচে চরমভাবে ব্যর্থ অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান এবার চাপের মধ্যে দুর্দান্ত এক ইনিংস উপহার দিয়ে মনে করিয়ে দিলেন তার ক্যারিয়ারের সেরা সময়কে।
Published : 11 Nov 2024, 08:53 PM
ইনিংসের শেষ বলে নাটকীয় কণ্ঠে বেশ একটা উত্তেজনা জমিয়ে তুললেন টিভি ধারাভাষ্যকার, “মাহমুদউল্লাহর সেঞ্চুরি নাকি আজমাতউল্লাহর ৫ উইকেট, কোনটি হবে…?” চার উইকেট শিকার করা আজমাতউল্লাহ ওমারজাই ছুটলেন বল হাতে। ৯৭ রান নিয়ে স্ট্রাইকে মাহমুদউল্লাহ। কিন্তু ‘অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স’, শেষ পর্যন্ত হলো না কোনোটিই।
ফুল লেংথ বলটিতে গায়ের জোরে মারতে চাইলেও টাইমিং করতে পারলেন না মাহমুদউল্লাহ। বল গেল স্কয়ার লেগ সীমানার দিকে। একটি রান নিতে পারলেও ক্লান্ত শরীরে দ্বিতীয় রানটি নিতে পারলেন না। ৯৮ রানে রান আউট হয়ে গেলেন বাংলাদেশের অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান।
ফেরার সময় তার চোখেমুখে হতাশার ছাপ ছিল স্পষ্ট। এমন একটা ইনিংসের গন্তব্য হয়তো শতরানের ঠিকানায় পৌঁছানোটাই প্রাপ্য। তবে খামতি বলতে এটুকুই। রেকর্ড বইয়ে এটি শতরান নয়, কিন্তু কার্যকারিতায় কোনো অংশে কমও নয়। তার ইনিংসটিই তো দলকে নিয়ে গেল এমন জায়গায়, যেখান থেকে সিরিজ জয়ের আশা প্রবলভাবেই করা যায়।
৭ চার ও ৩ ছক্কায় ৯৮ বলে ৯৮, স্রেফ সংখ্যার বিচারেই শারজাহর এমন উইকেটে দারুণ ইনিংস। তবে সংখ্যাই শেষ কথা নয়। আফগানিস্তানের বিপক্ষে এ দিন যেভাবে ব্যাট করলেন মাহমুদউল্লাহ, যেভাবে দলের ভার নিজের কাঁধে বয়ে নিলেন, ক্যারিয়ারের এই গোধূলিবেলায় যেন তিনি ফিরে গেলে মধ্যগগণে।
অথচ এই ম্যাচে তাকে নিয়ে সবচেয়ে বড় কৌতূহল ছিল, তিনি ৪ রানে আটকে যান কি না!
হ্যাঁ, এটিই সত্যি। আগের চার ওয়ানডে ইনিংসে তার রান ছিল ০, ১, ২ ও ৩। এবার তিনি ৪ রানে আউট কি না, এমন কৌতূহল তো থাকারই কথা।
মজার ব্যাপার হলো, ৪ রানে বেশ কিছুটা সময় আটকে রইলেন তিনি। সেভাবে স্ট্রাইকই পাচ্ছিলেন না। যখন স্ট্রাইক পেলেন, একটি বল খেলতে গিয়ে টান লাগল পিঠের নিচের অংশে। মাঠেই চিকিৎসা নিতে হলো। সব মিলিয়ে ‘৪’-এর শঙ্কা ঠিকই উঁকি দিচ্ছিল।
তিনি যদি সত্যিই দ্রুত আউট হতেন, দল পড়ে যেত গভীর খাদে। ৫৩ রানের উদ্বোধনী জুটির পরও হুট করে পথ হারিয়ে বাংলাদেশের রান হয়ে যায় ৪ উইকেটে ৭২। দল তখন মাহমুদউল্লাহর দিকে তাকিয়ে। তার অভিজ্ঞ ব্যাট এ দিন আর হতাশ করেনি দলকে।
চার রানে তাকে আটকে থাকতে হয় চার ওভারের বেশি। স্ট্রাইক পান ওই সময়টায় স্রেফ তিন বল। পরে নানগেলিয়া খারোটের লেগ স্টাম্পের বাইরের বলে সুইপ করে চার মেরে ছুটতে শুরু করেন তিনি। খারোটের পরের ওভারে আরেকটি চার আসে তার ব্যাট থেকে।
মাহমুদউল্লাহর সাবলীল ব্যাটিং দেখে নিজের করণীয় বুঝে যান মেহেদী হাসান মিরাজ। বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মনোযোগ দেন উইকেট আঁকড়ে রাখায়। গড়ে ওঠে কাঙ্ক্ষিত জুটি।
একটু থিতু হওয়ার পর রানের গতি বাড়ান মাহমুদউল্লাহ। ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে ছক্কায় উড়িয়ে দেন মোহাম্মাদ নাবিকে। মিরাজের আগেই পঞ্চাশে পৌঁছে যান তিনি ৬৩ বল খেলে।
৪০ ওভার পেরিয়ে মাহমুদউল্লাহর ব্যাটের ধারও বাড়ে। আরেকটি ছক্কা মারেন তিনি নাবিকে। ছাড় পাননি প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের ব্যাটিং ধসিয়ে দেওয়া আল্লাহ মোহাম্মাদ গাজানফারও। কেবল রাশিদ খানকেই একটু সাবধানে খেলছিলেন তিনি। এর মধ্যে অবশ্য সুইপ করে চার মারেন এই লেগ স্পিনারকেও।
মিরাজের সঙ্গে তার জুটিতে রান আসে ১৪৫। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডেতে সব দল মিলিয়েই পঞ্চম জুটির রেকর্ড। মিরাজের বিদায়ের পর জাকের আলি, নাসুম আহমেদরাও দ্রুত আউট হয়ে যান। শেষ দিকে রান বাড়ানোর কাজটি করেন মাহমুদউল্লাহই। ফাজালহাক ফারুকির স্লোয়ার ডেলিভারি তিনি আছড়ে ফেলেন গ্যালারিতে।
শেষ ওভারটি তিনি শুরু করেন ৯৬ রান নিয়ে। প্রথম বলে একটি রান আসে লেগ বাই থেকে। আবার তিনি স্ট্রাইক পান চতুর্থ বলে। এক রানের বেশি নিতে পারেননি। পঞ্চম বলে শরিফুল ইসলাম সিঙ্গেল নেওয়ায় শেষ বলে মাহমুদউল্লাহ শেষ সুযোগ পেয়ে যান সেঞ্চুরি ছোঁয়ার। কিন্তু হলো না।
বাংলাদেশের হয়ে ওয়ানডেতে নব্বই ছুঁয়ে শতরানের আগে রান আউট হওয়ার অভিজ্ঞতা আগে কেবল একজনেরই ছিল। ২০০৬ সালে কেনিয়ার বিপক্ষে বগুড়ায় ৯১ রানে রান আউট হয়েছিলেন শাহরিয়ার নাফিস।
গর্ব করার মতো একটি রেকর্ড অবশ্য ফিফটি করেই হয়ে গেছে মাহমুদউল্লাহর। ৩৮ বছর ২৮১ দিন বয়সে ইনিংসটি খেললেন তিনি। বাংলাদেশের হয়ে ৩৮ পেরিয়ে ওয়ানডেতে পঞ্চাশ ছোঁয়া ইনিংস নেই আর কারও। গত বছর বিশ্বকাপে ৩৭ বছর ২৬৯ দিন বয়সে ফিফটি করে আগের রেকর্ড ছিল তারই।
তবে সেঞ্চুরি হলে নিশ্চয়ই তার তৃপ্তি আরও অনেক বেশিই থাকত। যদিও এমন ইনিংসের ওজন স্রেফ তিন অঙ্ক দিয়ে মাপা যায় না। তার নিজের ফর্মহীনতা, দলের বাজে অবস্থা, সব মিলিয়ে ইনিংসটি মনে করিয়ে দিয়েছে তার সেরা সময়কে। তার ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংসগুলির মধ্যেও থাকবে এটি। তবে এটিও ঠিক, তিনি যে জায়গায় ব্যাটিং করেন, শতরানের সুযোগ সবসময় আসে না। তাই আক্ষেপ কিছুটা থাকবে।
সেই ব্যথা হয়তো ভুলে যেতে পারেন, যদি ম্যাচ শেষে জয়ের সুখটা মেলে!