প্রথাগত পদ্ধতির অংশ হয়ে নয়, বরং অনেক চ্যালেঞ্জের পথ পেরিয়ে সম্ভাবনার ঝলক দেখিয়ে মনের কোণে বড় স্বপ্ন নিয়ে প্রথমবার বিসিবির কার্যক্রমের অংশ হলেন মেহেদী হাসান ও হাবিবুর রহমান।
Published : 23 May 2024, 04:22 PM
একে একে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছিলেন হাই পারফরম্যান্স ইউনিটের (এইচপি) ক্রিকেটাররা। নাম ও খেলার ধরন বলার পর হাবিবুর রহমান সোহানের কাছে কিছু একটা জানতে চাইলেন সামনে বসা বিসিবি কর্তা ও নির্বাচকরা। তা শুনে হাসির রোল উঠল কক্ষে। লাজুক হাসিতে উত্তর দিয়ে আসনে বসলেন হাবিবুর। প্রায় একইভাবে স্বাগত জানানো হলো মেহেদী হাসানকেও।
মিরপুরে বিসিবি একাডেমি ভবনে গত বুধবারের ঘটনা এটি। যে ২৫ জন উঠতি ও সম্ভাবনাময় ক্রিকেটারকে নিয়ে এবার এইচপির ক্যাম্প শুরু হয়েছে, সেখানে আলাদা লেগ স্পিনার মেহেদী ও ওপেনার হাবিবুর। অন্যরা বয়সভিত্তিক ধাপ পেরিয়ে কিংবা আগেও এইচপির ক্যাম্প করে এলেও, এই দুজন সুযোগ পেয়েছেন পুরোপুরি বিসিবির নিয়মিত কাঠামোর বাইরে থেকে।
তাই বলে বাকিদের কাছে তারা নতুন কিংবা অপরিচিত কেউ নন। সবশেষ ঢাকা প্রিমিয়ার লিগসহ ঘরোয়া ক্রিকেটে পথচলা শুরু হয়ে গেছে মেহেদী ও হাবিবুরের। বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগের ওয়ানডে সংস্করণ ও প্রিমিয়ার লিগে সম্ভাবনার ছাপ রেখেই মূলত এবার প্রথম বিসিবির কোনো কার্যক্রমে ডাক পেলেন তারা দুজন।
দুজনের জন্যই এখন সুযোগ মানসম্পন্ন প্রথাগত কোচিংয়ে নিজেদেরকে আরও শাণিত করে তোলার।
স্বীকৃত ক্রিকেটে কোনো রকমের অভিজ্ঞতা ছাড়াই গত বছরের বিপিএলে খুলনা টাইগার্সে সুযোগ পান হাবিবুর। সেবার শেষ ম্যাচে ৯ বলে ৩০ রানের ক্যামিওতে দলকে জিতিয়ে আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের ঝলক কিছুটা দেখান তরুণ ব্যাটসম্যান।
এর আগের বছর রাজশাহীর একটি স্থানীয় টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে আলো ছড়ান হাবিবুর। দেশ-বিদেশি বেশ তারকা ক্রিকেটারদের নিয়ে আয়োজিত ওই টুর্নামেন্টে সবাইকে চমকে দিয়ে সর্বোচ্চ রান করেন হাবিবুর। রাইমা রেঞ্জার্সকে চ্যাম্পিয়ন করে তিনিই জেতেন টুর্নামেন্ট সেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার।
ওই টুর্নামেন্টে ভালো করার সৌজন্যেই মূলত বিপিএলে দল পান তরুণ ওপেনার। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে হাবিবুর বললেন, রাজশাহীর ওই টি-টোয়েন্টি লিগ এখন পর্যন্ত তার এগিয়ে চলায় রেখেছে বড় ভূমিকা।
“রাজশাহীর টি-টোয়েন্টি লিগটিতে অনেক বড় বড় ক্রিকেটার খেলেছিলেন। সিকান্দার রাজা, থিসারা পেরেরাসহ আমাদের জাতীয় দলের ইমরুল কায়েস ভাই, আফিফ ভাইরা খেলেছেন। ওখান থেকে অনেক কিছু শিখতে পেরেছি। আর ওখানে রান করার পর অনেকেই মোটামুটি আমাকে চিনেছে। সেটাকেই বলা যায় একটা টার্নিং পয়েন্ট।”
হাবিবুরের ৩১ লিস্ট ‘এ’ ও ১১ টি-টোয়েন্টি ম্যাচের ক্যারিয়ারে রয়েছে আরও একটি ‘টার্নিং পয়েন্ট।’ গত বছর বিসিএলের ওয়ানডে সংস্করণে তিনি উত্তরাঞ্চলের হয়ে স্রেফ ৪৯ বলে করেন সেঞ্চুরি। লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের এটিই দ্রুততম শতকের রেকর্ড। সেদিন ৯টি করে চার-ছক্কায় ৬১ বলে ১১৭ রান করেন হাবিবুর।
গত এক বছরে ঘরোয়া ক্রিকেটে এমন আগ্রাসী ব্যাটিং প্রায় নিয়মিতই করেছেন হাবিবুর। এই ঘরানার ব্যাটিংয়ে ঝুঁকি থাকে সবসময়ই। তেড়েফুঁড়ে খেলতে গিয়ে প্রায়ই আউট হতে হয় অল্প রানে। তবু ৩১ ম্যাচের লিস্ট ‘এ’ ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত ৫টি পঞ্চাশছোঁয়া ইনিংস খেলেছেন ২৪ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান, ২ ফিফটির সঙ্গে করেছেন ৩টি সেঞ্চুরি। স্ট্রাইক রেট অবিশ্বাস্য, ১৪১.৫৩!
২০১৫ সালের শেষ দিক থেকে ক্রিকেট বলে অনুশীলন শুরু করেন হাবিবুর। এর আগে টেপ টেনিসে মারকুটে ব্যাটিং করতেন তিনি। সেখান থেকেই মেরে খেলার চর্চাটা গড়ে ওঠে তার।
“আগ্রাসী ব্যাটিংটা আমার সহজাত। আমি ছোটবেলায় অনেক টেপ টেনিস খেলতাম। সেখানে বড় বড় ছক্কা মারার অভ্যাসটা ছিল। ওখান থেকে ব্যাট সুইং বা আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের অন্যান্য বিষয়গুলো এসেছে।
“রাজশাহীতে ২০১৫-১৬ মৌসুমে ক্রিকেট বলে অনুশীলন শুরু করি। পরের বছর ঢাকায় চলে আসি। বিভিন্ন ক্লাবে ঘুরেছি, কিন্তু তেমন পারফর্ম করতে পারছিলাম না কোথাও। কয়েকটি ক্লাব ঘুরে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবে অনুশীলনের জন্য যাওয়ার পর একটা স্থিতিশীলতা আসে। তারপর সেখান থেকেই ধীরে ধীরে এখন পর্যন্ত আসা।”
প্রথাগত কাঠামোর মধ্য থেকে উঠে না আসায় ব্যাটিংয়ের কিছু জায়গায় ঘাটতি তার আছে। হাবিবুর নিজেও জানেন সেসব। এইচপিতে নিজের দুর্বলতা নিয়ে কাজ করে আরও বড় স্বপ্ন ছোঁয়ার আশা এই তরুণের।
“অবশ্যই জাতীয় দল তো (খেলার স্বপ্ন থাকেই)... এখানে (এইচপি) ভালো করার চেষ্টা করব। আমার খেলায় তো অনেক ভুল আছে, অনেক কিছুতে কাজ করার জায়গা আছে। এখানে কোচরা আছেন। তাদের থেকে শিখে যত দ্রুত উন্নতি করতে পারব তত ভালো জায়গায় যেতে পারব।”
হাবিবুরের মতো মেহেদী ঘরোয়া ক্রিকেটে এখনও পর্যন্ত নজরে পড়ার মতো তেমন কিছু করতে পারেননি। খুব বেশি সুযোগও তিনি পাননি। গত বছরের বিসিএলের ওয়ানডে সংস্করণে তার লিস্ট ‘এ’ অভিষেক। আর সবশেষ প্রিমিয়ার লিগে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের হয়ে খেলেন দুটি ম্যাচ। সব মিলিয়ে ৩ ম্যাচে তার শিকার ২ উইকেট।
তবে বেশ কয়েক বছর ধরে মিরপুরে নিয়মিতই নেট বোলিং করছেন তরুণ এই লেগ স্পিনার। গত বছরের জুলাইয়ে আফগানিস্তান সিরিজের সময় নেট বোলিং করতে এসে বাংলাদেশের প্রধান চান্দিকা হাথুরুসিংহের চোখে পড়েন মেহেদী। এরপর প্রায় নিয়মিতই জাতীয় দলের নেটে দেখা যায় তাকে।
হাথুরুসিংহের চাওয়াতেই পরে বাংলা টাইগার্সের ক্যাম্পের শেষ দিকে নেওয়া হয় মেহেদীকে। জেমি সিডন্সের তত্ত্বাবধানে সেবার অল্প কিছুদিনের জন্য প্রথম বিসিবির কোনো আয়োজনে শেখার সুযোগ পান তিনি। এবারই প্রথম ডাক পেলেন পূর্ণাঙ্গ কোনো ক্যাম্পে।
বিসিবির বয়স ভিত্তিক ক্রিকেটের নানা ধাপ পেরিয়ে উঠে আসতে পারতেন তিনিও। কিন্তু অনূর্ধ্ব-১৮ পর্যায়ের একটি টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়ে মারাত্মক গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়েন তিনি। হাত ও পায়ে গুরুতর চোট পেয়ে সেবার ইয়ুথ ক্রিকেট লিগ খেলতে পারেননি। ফলে সুযোগ হয়নি অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়েও।
“২০১৮-১৯ মৌসুমে আমি ঢাকা ডিভিশন দক্ষিণের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৮ পর্যায়ে খেলি। সেখানে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেই। ফাইনালে ৪ ওভারে ৬ রান দিয়ে ৬ উইকেট নেই। জাতীয় প্রতিযোগিতায় প্রথম দুই ম্যাচে নেই ১৪ উইকেট।”
“এরপর বরিশালে আমাদের দলের গাড়ির দুর্ঘটনা ঘটে। আমার হাতের আঙুল মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পা গাড়ির নিচে পড়ে। ওই দুর্ঘটনার কারণে আর ইয়ুথ ক্রিকেট লিগ খেলতে পারিনি। সেখান থেকে অনেকটাই পিছিয়ে পড়ি।”
পিছিয়ে পড়লেও অবশ্য হাল ছাড়েননি। ক্রিকেটের টানে পরিবারকে না জানিয়েই ২০১৬ সালে ঢাকায় চলে আসে মাদারিপুরের কিশোর। আলতাফ ক্রিকেট ফাউন্ডেশনে ভর্তি হয়ে যায় সে মূলত পেস বোলিং অলরাউন্ডার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। শেন ওয়াটসনকে আদর্শ মেনে চলতে থাকে অনুশীলন।
সেখান থেকে লেগ স্পিনার হওয়ার গল্পটা বেশ মজা করেই শোনালেন ২২ বছর বয়সী মেহেদী।
“ঢাকায় আসার পর শুরুতে পেসার ছিলাম। একদিন ব্যাটিং করে খুব ক্লান্ত হয়ে যাই। তাই নেট সেশন পুরোটা শেষ না করেই বের হয়ে আসছিলাম। তখন আমার কোচ ইউসুফ কবির স্যার বলেন যে, ঢিল ছুড়ে হলেও নেট সেশন শেষ করতে হবে। তখন নেটে আরেক বড় ভাই লেগ স্পিন করছিলেন। তাকে দেখে আমিও মজার ছলে কয়েকটা লেগ স্পিন করি।”
“ওই ভাই আমার বল দেখে অবাক হয়ে যান। তিনি ভেবেছিলেন, আমি হয়তো অনেক বছর ধরে লেগ স্পিন করি। কিন্তু সেদিনই আমি প্রথম লেগ স্পিন করি। তখন সবাই অনেক উৎসাহ দেন যে, লেগ স্পিনটা ভালো হচ্ছে। এটা চেষ্টা করতে পারো। তারপর থেকেই লেগ স্পিন নিয়ে কাজ শুরু করি। ধীরে ধীরে এই পর্যন্ত এলাম।”
ঢাকায় আসার পর ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ারও চেষ্টা করেছিলেন মেহেদী। কিন্তু ওই বয়সে ভর্তি প্রক্রিয়ার কিছুই জানতেন না বলে ভেতরেই ঢুকতে পারেননি তিনি। এখনও বিভিন্ন টুর্নামেন্টের ম্যাচ খেলতে বিকেএসপিতে গেলে সেই সময়ের কথা মনে পড়ে তার।
মাদারিপুরের শিবচরের মফস্বল এলাকা থেকে উঠে আসা ছেলেটির প্রতিবন্ধকতাও কম ছিল না তার। ব্যয়বহুল খেলা হওয়ায় চারপাশের লোকের কথা শুনে তার বাবা প্রথমে সায় দেননি ক্রিকেটার হওয়ার ইচ্ছায়। তবে শুরু থেকেই তাকে আগলে রাখেন মা। নিজের জমানো টাকা ছেলের হাতে তুলে দেন স্বপ্ন পূরণের জন্য।
সেই কথা বলতে গিয়ে কিছুটা আবেগি হয়ে পড়েন মেহেদী।
“আমার সব কিছুর মূলে আমার মা। মায়ের জন্যই আমি এই পর্যন্ত আসতে পেরেছি। শুরুতে তো বাসা থেকে দিতেই চায়নি। মফস্বল এলাকার একটা ছেলে ক্রিকেট খেলবে। ক্রিকেট তো ব্যয়বহুল খেলা। পাড়া-প্রতিবেশিরা বলত যে, পরিবারের সব তো এক ছেলের পেছনেই চলে যাবে। অনেক প্রতিবন্ধকতা ছিল।”
“শুরুতে বাবা পক্ষে ছিলেন না। মা-ই তখন সব কিছু চালান। বাবা শুরুর দিকে ভেবেছিলেন যে, মায়ের টাকা শেষ হলে হয়তো আমি বাড়িতে ফিরে যাব। কিন্তু কিছুতেই যখন আমি আর ফিরিনি, তখন বুঝে গেছে আর ফেরানো যাবে না। এখন অবশ্য পরিস্থিতি বদলেছে। বাবা-মা দুজনই উৎসাহ দেন।”
মায়ের সমর্থন ও অনুপ্রেরণায় যাত্রা শুরুর পর দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এখন জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন পূরণের পথে একটি সিঁড়িতে পা রেখেছেন মেহেদী। এইচপিতে ভালো কিছু করতে পারলেই খুলবে সামনের দুয়ার। ধীরে ধীরে এগোবেন বড় স্বপ্নের পথে।
এইচপিতে সুযোগ পেয়ে বিসিবির প্রতি কৃতজ্ঞ তরুণ এই লেগ স্পিনার।
“আমি আর আরও একজন (হাবিবুর) আছে, যারা বিসিবির কাঠামোর বাইরে থেকে এসেছি। আমি মনে করি, এটাও ক্রিকেটে উন্নতির একটা দিক যে, বিসিবি শুধু বয়সভিত্তিক ক্রিকেটেই নজর দেয় না। সব দিকেই তারা পর্যবেক্ষণ করে। যারা বাইরে আছে তাদের পারফরম্যান্সও বিবেচনা করে। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ ও অন্যান্য খেলা দেখেই হয়তো আমাদের নেওয়া হয়েছে। বিসিবির প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা।”