চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ব্যর্থতার পর ওয়ানডে ক্রিকেটকে বিদায় বললেন ৩৭ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান।
Published : 05 Mar 2025, 11:27 PM
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ব্যর্থতার পর নানা আলোচনা-সমালাচনার পথ ধরে শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললেন মুশফিকুর রহিম। ওয়ানডে ক্রিকেটকে বিদায় বলে দিলেন বাংলাদেশের অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান।
সামাজিক মাধ্যমে বুধবার রাতে বিদায়ের ঘোষণা জানান ৩৭ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান।
"আজকে থেকে ওয়ানডে সংস্করণ থেকে অবসরের ঘোষণা দিচ্ছি আমি।"
"সবকিছুর জন্য আলহামদুলিল্লাহ। বৈশ্বিক পর্যায়ে আমাদের অর্জন হয়তো সীমিত, তবে একটি ব্যাপার ছিল নিশ্চিত, প্রতিবার দেশের জন্য যখন মাঠে নেমেছি, নিবেদন ও সততার সঙ্গে নিজের শতভাগের বেশি দিয়েছি।"
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে বিদায় নিয়েছিলেন তিনি এভাবেই সামাজিক মাধ্যমে জানিয়ে। ওয়ানডে থেকে তার বিদায়ে শেষ হলো বাংলাদেশ ক্রিকেটের একটি অধ্যায়ের। সেখানে গৌরব, অর্জন, প্রাপ্তি যেমন আছে, তেমনি আছে কিছু ব্যর্থতা আর হতাশার ছোঁয়াও।
এবারের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে প্রথম ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে প্রথম বলেই আউট হন মুশফিক। পরের ম্যাচে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে বিদায় নেন ২ রানে। সেই ম্যাচে তার আউট হওয়ার ধরন প্রবল প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয় দেশের ক্রিকেটে। প্রথম দুই ম্যাচ হেরে টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে যায় বাংলাদেশ।
দলের ব্যর্থতায় আঙুল ওঠে অভিজ্ঞতম ব্যাটসম্যান মুশফিকের দিকে। এই টুর্নামেন্টেই শুধু নয়, বেশ কিছুদিন ধরেই প্রত্যাশার প্রতিফলন পড়ছিল না তার পারফরম্যান্সে। সবশেষ ১৪ ইনিংসে তার ফিফটি স্রেফ একটি। এর সাতটিতেই আউট হয়েছেন দু অঙ্ক ছোঁয়ার আগে।
ওয়ানডেতে সবশেষ সেঞ্চুরিটি করেছেন তিনি ২০২৩ সালের মার্চে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে। এরপর পেরিয়ে গেছে ২৭ ইনিংস।
অভিজ্ঞতার কারণে তবু চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিল দল। কিন্তু বৈশ্বিক আসরে ব্যর্থতার পর তার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে প্রবলভাবে। ২০২৭ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় পরবর্তী বিশ্বকাপের সময় তার বয়স হবে ৪০। বিসিবির কেন্দ্রীয় চুক্তিতে তাকে রাখা হবে কি না, দল গোছানোর জন্য সামনে তাকানো উচিত কি না, গত কিছুদিন ধরেই দেশের ক্রিকেটে এসব ছিল আলোচিত প্রসঙ্গ। গত সোমবার বিসিবির সভা শেষে ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান নাজমুল আবেদীন এসব প্রশ্নের জবাবেই বলেন, আগামী বিশ্বকাপ পর্যন্ত মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহর খেলা কঠিন। বোর্ডের মনোভাবের আভাস মিলে যায় সেখানেই।
সেই ধারাবাহিকতায় এলো মুশফিকের এই সিদ্ধান্ত। তার বিদায়ী বার্তায় ফুটে উঠল, সময়ের ডাক শুনতে পারছিলেন তিনিও।
"গত কয়েক সপ্তাহ আমার জন্য ছিল ভীষণ চ্যালেঞ্জিং এবং উপলব্ধি করতে পেরেছি যে, এটিই আমার নিয়তি।"
"সবশেষে আমি গভীরভাবে ধন্যবাদ জানাতে চাই আমার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও ভক্তদের, যাদের জন্য গত ১৯ বছর ধরে ক্রিকেট খেলেছি।"
শেষটা ভালো না হলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেশ উজ্জ্বল ক্যারিয়ার মুশফিকের। বাংলাদেশ ক্রিকেটের বাঁক বদলের নায়কদের একজন তিনি।
বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ২৭৪ ওয়ানডে খেলার রেকর্ড তার। ৩৬.৪২ গড়ে রান করেছেন ৭ হাজার ৭৯৫। রানের তালিকায় তার ওপরে আছেন কেবল তামিম ইকবাল (৮ হাজার ৩৫৭)। সেঞ্চুরির সংখ্যাতেও মুশফিকের (৯টি) ওপরে আছেন কেবল তামিম (১৪টি)। তার ব্যাট থেকে ফিফটি এসেছে আরও ৪৯টি।
ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ ইনিংসটি খেলেছিলেন তিনি ২০১৮ সালের এশিয়া কাপে। দুবাইয়ে সেদিন প্রচণ্ড গরমে পাঁজরে ব্যথা নিয়ে ১৪৪ রানের যে ইনিংসটি তিনি উপহার দিয়েছিলেন, অনেকের মতেই তা বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাসের সেরা ইনিংস।
ওয়ানডেতে এরকম স্মরণীয় ইনিংস তার ব্যাট থেকে এসেছে আরও অনেক। ২০১৮ এশিয়া কাপেই সেমি-ফাইনালে রূপ নেওয়া ম্যাচে ৯৯ রান, ২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে স্মরণীয় সেই জয়ে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ৭৭ বলে ৮৯, ২০১৫ সালে মিরপুরে পাকিস্তানের বিপক্ষেই ৭৭ বলে ১০৬, ২০১৯ বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে জয়ের ম্যাচে ৮৭ বলে ৮৩, ভারতের বিপক্ষে ২০০৭ বিশ্বকাপে ইতিহাস গড়া জয়ে অপরাজিত ৫৬, ২০১২ এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষেই জয়ে ২৫ বলে ৪৬, তার ব্যাটের সৌজন্যে মনে রাখার মতো উপলক্ষ বাংলাদেশের ক্রিকেটে এসেছে অনেক।
উইকেটকিপিংয়ে তিনি নিজের রেকর্ড তিনি নিয়ে গেছেন দেশের সবার ধরাছোঁয়ার অনেক বাইরে। তার ২৪১ ক্যাচ, ৫৬ স্টাম্পিং আর মোট ২৯৭ ডিসমিসাল, সবই বাংলাদেশের রেকর্ড।
এই সংস্করণে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি ৩৭ ম্যাচে। সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায় নিঃসন্দেহে ২০১২ এশিয়া কাপের ফাইনালে খেলা।
২০০৫ সালে লর্ডস টেস্ট দিয়ে আন্তর্জাতিক আঙিনায় পা রাখার পর ওয়ানডেতে অভিষেক হয় তার পরের বছর। ক্রমে এই সংস্করণকেই তিনি আপন করে নেন সবচেয়ে বেশি। এখানেই তাকে সেরা চেহারায় পাওয়া গেছে সবচেয়ে বেশি। সেই পথচলা অবশেষে থেমে গেল এবার।
টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডে থেকে বিদায়ের পর তার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার পরিচয় টিকে রইল শুধুই টেস্টে। এখানে বড় এক মাইলফলক তার অপেক্ষায়। দেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ১০০ টেস্ট খেলার কীর্তি গড়তে আর ছয়টি টেস্ট খেলতে হবে তাকে। সব ঠিকঠাক থাকলে তা হয়ে যেতে পারে এই বছরই। তবে এখানেও পারফরম্যান্সের চ্যালেঞ্জ থাকবে তার সামনে। সবশেষ ১০ টেস্ট ইনিংসে দেখা পাননি ফিফটির।