দেশের স্বাস্থ্য খাতের অনেক রোগ দেখিয়ে দিয়েছে যে মহামারী, তার দুই বছর পূর্ণ হল তুলনামূলকভাবে কম সংক্রমণ আর টিকাদানে স্বস্তির এক সময়ে।
Published : 08 Mar 2022, 01:04 PM
প্রথম বছরের তুলনায় দ্বিতীয় বছরে এসে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে দেড়শ শতাংশের বেশি, মৃত্যুও বেড়েছে কাছাকাছি হারে। তবে সেজন্য মূলত এ ভাইরাসের অতি সংক্রামক ও প্রাণঘাতী নতুন ভ্যারিয়েন্টকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশে মহামারীর প্রথম বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই করোনাভাইরাসের টিকাদান শুরু করেছিল সরকার। প্রাথমিক সরবরাহ সঙ্কট কাটিয়ে দেশের তিন চতুর্থাংশ মানুষকে ইতোমধ্যে অন্তত এক ডোজ টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে, দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ পেয়েছেন দুই ডোজ টিকা।
সংক্রমণ কমিয়ে আনতে এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তাদের বিচারে মহামারী মোকাবেলায় সাফল্য-ব্যর্থতায় বাংলাদেশের অবস্থান ‘মাঝামাঝি’।
সংক্রমণের শুরুতে, অর্থাৎ প্রথম বছরে বাংলাদেশে দক্ষিণ আফ্রিকা ও যুক্তরাজ্যের দুটি ভ্যারিয়েন্ট দাপিয়ে বেড়ালেও ২০২১ এর মাঝামাঝি থেকে প্রাণঘাতি ‘ডেল্টা’ এবং পরের দিকে আসা অতি সংক্রামক ‘ওমিক্রন’ ভ্যারিয়েন্টের আগ্রাসন সব ওলটপালট করে দেয়।
মূলত এ দুই ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবেই মহামারীর দ্বিতীয় বছরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়েছে। তবে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের তুলনায় তা কম।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজীর আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মহামারী মোকাবেলায় বাংলাদেশের সাফল্য-ব্যর্থতা দুটোই আছে। বাংলাদেশ মহামারী মোকাবেলায় প্রকৃতির অনেক সহায়তাও পেয়েছে।”
চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে নতুন এক করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের খবর আসে। এরপর কয়েক মাসের মধ্যে সেই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে মহামারী ঘোষণা করে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশও মহামারী ঠেকাতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছিল। কিন্তু চোখে না দেখা সেই শত্রুকে রুখে দেওয়া সম্ভব হয়নি।
২০২০ সালের ৮ মার্চ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা (আইইডিসিআর) প্রতিষ্ঠানের সে সময়ের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, বাংলাদেশে ইতালিফেরত তিন জনের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে।
এর পর থেকে নিয়মিতভাবে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে, প্রথম মৃত্যুর খবর আসে ১৮ মার্চ।
সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার ওই বছরের ২৬ মার্চ থেকে সারাদেশে 'সাধারণ ছুটি' ঘোষণা করে, অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কারখানা, মার্কেট বন্ধ করে দিয়ে যান চলাচলেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। বিশ্বের আর সব দেশের মত বাংলাদেশেও সেই ছুটি ‘লকডাউন; নাম পায়।
জনজীবনে বিপুল পরিবর্তন আনা সেই বিধিনিষেধেও সংক্রমণের বিস্তার ঠেকানো যায়নি।
>> প্রথম বছর (৮ মার্চ ২০২০ থেকে ৭ মার্চ ২০২১): করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ৫ লাখ ৫০ হাজার ৩৩০ জন; মৃত্যু ৮ হাজার ৪৬২ জনের।
>> দ্বিতীয় বছর (৮ মার্চ ২০২১ থেকে ৭ মার্চ ২০২২): করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ১৩ লাখ ৯৭ হাজার ৩৭২ জন; মৃত্যু হয় ২০ হাজার ৬২৭ জনের।
>> প্রথম বছরের তুলনায় দ্বিতীয় বছর রোগী বেড়েছে ৮ লাখ ৪৭ হাজার ৪২ জন, বা ১৫৩ দশমিক ৯২ শতাংশ। আর মৃত্যু বেড়েছে ১৪৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীরের মতে, মহামারীর দ্বিতীয় বছরে সংক্রমণ বা মৃত্যু বাড়ার কারণ দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা নয়। বরং প্রথম বছরের তুলনায় কোভিড পরীক্ষার সক্ষমতা বাড়ায় দ্বিতীয় বছরে এসে সংক্রমণ এবং মৃত্যুর সংখ্যা বেশি জানা গেছে।
“দ্বিতীয় বছরে ডেল্টা এবং ওমিক্রনের মতো হাই স্প্রেডিং, সুপার স্প্রেডিং ভ্যারিয়েন্ট মোকাবেলা করেছি। আমাদের ডায়াগনস্টিক ক্যাপাবিলিটিও বেড়েছে। ফলে টেস্টের সংখ্যা বেড়েছে, রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে। ডেল্টার প্রভাবে সংক্রমণ সীমান্ত এলাকা থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে গেল। আর ওমিক্রন তো অনেক বেশি ছড়ানোর ক্ষমতা।
“ডেল্টার সিভিয়ারিটি বেশি ছিল, এ কারণে হাসপাতালে বেশি ভর্তি হতে হয়েছে। আক্রান্ত হলে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষ মারাই যাবে। বিশেষ করে যাদের কোমরবিডিটি আছে।”
মহামারী মোকাবেলায় ‘কিছু ব্যর্থতা’ থাকলেও টিকাদান, রোগী ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ ‘তুলনামূলকভাবে’ ভালো করেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেন, এই দুই বছরে নতুন ভ্যারিয়েন্টের প্রবেশ ঠেকানো, বিদেশফেরতদের কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশনসহ কিছু বিষয়ে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে ছিল।
“বাইরে থেকে যেন ভাইরাসটি না আসে, সেজন্য বিমান বন্ধ করে দেওয়া যায়নি। বিমান চলাচল বন্ধ করে দিয়ে অনেক দেশই ডেল্টা ঠেকাতে পেরেছে। যারা বিদেশ থেকে এসেছেন, তাদের কোয়ারেন্টিন করা, যারা আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের আইসোলেশন করা- আমরা পারিনি। কাজেই পাবলিক হেলথের অনেকগুলো কাজ আমরা আদৌ করতে পারিনি। এদিক থেকে আমাদের পারফরমেন্স খারাপ।”
তিনি বলেন, নমুনা পরীক্ষাতেও বাংলাদেশ পিছিয়েছে ছিল; যা নমুনা পরীক্ষা করার কথা তার দশভাগের একভাগও করা যায়নি।
হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় ডাক্তার-নার্সদের ভূমিকার প্রশংসা করে চিকিৎসক ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেন, একটি গাইডলাইন তৈরি হওয়া এবং দেশের একটা অংশকে টিকার আওতায় আনা মহামারীর এই দুই বছরের সাফল্য।
“আমাদের ডাক্তার-নার্সরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেছে। এক সময় তাদের জন্য পর্যাপ্ত পিপিই ছিল না। ব্যবস্থাপনা আস্তে আস্তে ভালো করেছে। আর লকডাউনটাও দীর্ঘসময় ধরে দিলেও সংক্রমণ মোকাবেলায় তা কাজে দিয়েছে।”
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, 'মহামারী মোকাবেলা প্রস্তুতি', 'মানুষের কাছে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেওয়া', 'মহামারী মোকাবেলায় গৃহীত পদেক্ষেপে মানুষের মানুষের আস্থা অর্জন'-এই তিন বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো ছিল।
“বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবেলায় বাংলাদেশের পারফর্মেন্স মাঝামাঝি পর্যায়ে আছে। বাংলাদেশে জনসংখ্যা অনুযায়ী মৃত্যুর হারটা অনেকের চেয়ে কম। তবে আমাদের চেয়ে ভালো অবস্থানেও বিশ্বের অনেক দেশ আছে।”