জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের ছাত্রী কাজী ফারজানা মিমের মুখোমুখি হলেন বিভাগের চেয়ারম্যান জুনায়েদ আহমেদ হালিম ও শিক্ষক আবু শাহেদ ইমন।
মিম এই দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়ন ও পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের শরণাপন্ন হওয়ার পরদিন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে এই ঘটনা ঘটে।
বুধবার দুই শিক্ষককে গোয়েন্দা কার্যালয়ে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশিদের কক্ষে নেওয়া হয়। সেখানে দুই পক্ষের বক্তব্য শোনেন তিনি। মিমের সঙ্গে ছিলেন তার বাবাও।
গত সোমবার মিম গোয়েন্দা কার্যালয়ে গিয়ে দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ জমা দেন। তিনি এও জানান, তাকে তুলে নেওয়ার পাশাপাশি হাত-পা কেটে হত্যা এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের হুমকিও দেওয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার সেই ছাত্রী লিখিত আবেদন জমা দেন বঙ্গভবনে। তাতে ‘বুলিং ও যৌন নিপীড়নের দৃষ্টান্তমূলক বিচার’ চেয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে তার জীবনটাকে ‘পুনরুদ্ধার করার’ আকুল আর্জি জানিয়েছেন।
আবেদনটির ‘রিসিভড কপি’ হাতে নিয়ে বঙ্গভবনের সামনে দাঁড়িয়ে একটি ছবি তুলেছেন মিম। সেখানে বঙ্গভবন নিরাপত্তা বিভাগের উপ পুলিশ কমিশনার কার্যালয়ের সিল ও সই দেখা যায়।
বঙ্গভবন নিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত উপ কমিশনার শচীন ভৌমিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ সংক্রান্ত একটি আবেদন গ্রহণ করে যথাযথ প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট শাখায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
বেলা ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত সবার সঙ্গে কথা বলা শেষে গোয়েন্দা কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, “মিম আমাদের কাছে অভিযোগ করে বলেছেন তিনি যেন স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পরেন, কেউ যেন ডিস্টার্ব না করে। আমরা তাকে সে ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছি।
“দুই শিক্ষক আমাদের বলেছেন, তারা মিমকে কখনো হুমকি দেননি, আগামীতেও দেবে না এবং চলাফেরায় কোন বাধা দেবেন না।”
যদি মিম স্বাধীনভাবে চলাফেরায় বাধার সম্মুখীন হন, কেউ তাকে সমস্যা করছে বলে জানালে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তাকে আশ্বস্ত করা হয়েছে বলেও জানান গোয়েন্দা কর্মকর্তা।
মিমের যৌন হয়রানির যে অভিযোগ এনেছেন, সে বিষয়ে হারুন বলেন, “তারা বিষয়টি তদন্ত করছেন। তদন্ত শেষ হলেই পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হবে।”
শিক্ষক আবু শাহেদ ইমন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিভাগের চেয়ারম্যান ও তার বিরুদ্ধে তিন চার বছর আগের ঘটনার কথা উল্লেখ করে যে অভিযোগ আনা হয়েছে এটা ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন’।
মিমকে ভয়ভীতি বা হুমকি দেওয়ার অভিযোগও সত্য নয়-বলছেন তিনি।
“আমাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের কোনো প্রমাণ নেই মিমের কাছে। তাছাড়া মিমের অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় যে তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রতিবেদন দিয়েছিল, তাও উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত”, বলেন তিনি।
উচ্চ আদালতের নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষ নতুন করে তদন্ত করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই তদন্ত চলার সময় মিম বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ দিয়ে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ করছে।”
নিরাপদ বোধ করছেন মিম
মিম সাংবাদিকদের বলেন, গোয়েন্দা কর্মকর্তা হারুন তার অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ায় তিনি নিরাপদ বোধ করছেন, মনোবল পেয়েছেন।
“অতিরিক্ত কমিশনার হারুন আমাকে আশ্বস্ত করেছেন। দুই শিক্ষক নানাভাবে যে ভয়ভীতি এবং হেনস্তা করছিলেন, তারা যেন সেটি না করেন, সে ব্যাপারে তাদেরকে আমার সামনে বলে দিয়েছেন।”
যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে রয়েছে। তারাই দেখছে, তদন্ত করছে।”
শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মিম যৌন নিপীড়নের অভিযোগ এনেছেন তার কোর্স শিক্ষক আবু শাহেদ ইমনের বিরুদ্ধে।
আর বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জুনায়েদ আহমদ হালিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ফেল করিয়ে দিয়েছেন তিনি।
মিম বলেন, প্রভাষক আবু শাহেদ ইমন ২০২১ সালে অ্যাকাডেমিক কাজে তাকে নিজের কক্ষে ডাকেন এবং সে সময় ‘যৌন হয়রানি’ করেন।
“সেদিন তিনি আমাকে কুপ্রস্তাব দেন। কুপ্রস্তাব দিয়েই ক্ষান্ত ছিলেন না। প্রস্তাব দেওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি আমাকে হেনস্তা করার চেষ্টা করেন। আমাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করতে চান। আমি সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে তাৎক্ষণিকভাবে এই আচরণের প্রতিবাদ করি।”
এই শিক্ষার্থীর ভাষ্য, ওই ঘটনা নিয়ে তিনি যখন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন, তখন থেকে তাকে নানাভাবে হেনস্তা করা শুরু হয়।
“অভিযোগ দেওয়ার পর থেকে বিভাগের চেয়ারম্যান জুনায়েদ আহমেদ হালিম ও শিক্ষক আবু সাহেদ ইমন আমাকে সেটি তুলে নিতে নানাভাবে চাপ দিতে থাকেন। এতে আমি রাজি না হওয়ায় তারা আমাকে হাত-পা কেটে হত্যা করাসহ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের হুমকি দেন। আমাকে একঘরে করে দেওয়া হয়। আমাকে বিভিন্ন পরীক্ষায় শূন্য নম্বর দিয়ে ফেল করানো হয়। অনার্সের ফাইনাল ভাইভায় আমাকে ফেল করানো হয়।”
মিম বলেন, “যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছি তারা আমার গ্রামের বাড়িতে পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। আমার বাবা-মা অসুস্থ, তাদের ওপর প্রেশার করেছে অভিযোগ প্রত্যাহার করার জন্য। অভিযোগ প্রত্যাহার না করায় আমাকে বিভাগের রুমে কোনো মহিলা শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে দরজা আটকে জোর জবরদস্তি করা হয়েছে।”
অভিযোগ করেও কেনো প্রতিকার না পাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি আজীবন পড়াশোনা ছাড়া অন্য কিছু করিনি। কোনো সংগঠনের সঙ্গেও জড়িত নই, আমি সাধারণ একজন ছাত্রী। আমি প্রতিবাদ করেছি বলেই আজ অনার্স ফেল।
“কুপ্রস্তাবে রাজি না হয়ে অন্যায় করেছি বলে এখন আমার মনে হয়। আমি হয়ত অবন্তিকার মত সাহসী না, তাই হয়ত আত্মহত্যা করতে পারিনি। কে জানে এর পর আমি বেঁচে থাকব কি না। কিন্তু মূল্যহীন হয়ে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।”
শিক্ষকরা কী বলছেন
মিমের অভিযোগ ‘পুরোপুরি ভিত্তিহীন’ দাবি করে প্রভাষক আবু শাহেদ ইমন বলেন, “অবন্তিকার মৃত্যুতে তার সহানুভূতিকে পুঁজি করে সে (মিম) গণমাধ্যমের মনোযোগ পাওয়ার চেষ্টা করছে।”
মিম অভিযোগ করার পর তদন্ত কমিটি আবু শাহেদ ইমনের বিরুদ্ধে প্রতিবেদনও দিয়েছিল। এই শিক্ষক তখন উচ্চ আদালতে যান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এরকম একটা বিষয় আদালতের বিচারাধীন থাকা অবস্থা মিম কীভাবে মিডিয়ায় কথা বলতে পারে তা আমার জানা নেই। তবে আমি এ ব্যাপারে বেশি মন্তব্য করতে চাই না।”
তদন্তের দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ে আবু শাহেদ ইমন বলেন, “ঠিক এই জায়গায় আমিও মীমের সঙ্গে একমত। এমন একটা বিষয় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে কেন দুই বছরের অধিক সময় লাগবে? আমিও চাই খুব দ্রুত এ বিষয়টি মিটমাট হোক।”
মিমকে ফেল করিয়ে দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে তার বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক জুনায়েদ হালিম বলেন “মিম ক্লাসই করত না। যেখানে ৬০ ভাগ ক্লাসে উপস্থিত না থাকলে একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় বসতে পারে না, সেখানে মিম পরীক্ষা দিয়েছে। ক্লাসে উপস্থিত না থাকলে তাকে নম্বর দেওয়ার তো কোনো সুযোগই নাই।”
আরও পড়ুন