মন্ত্রী বলেন, “যারা অপপ্রচার চালিয়ে এটাকে একটি আন্দোলনে রূপ দেয়ার চেষ্টা করছেন, তারা মূলত কোচিং ব্যবসায়ী। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নোট-গাইড বইয়ের ব্যবসায়ীরা।”
Published : 30 Oct 2023, 04:51 PM
নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে কোচিং ও গাইড ব্যবসায়ীরা অপপ্রচারে নেমেছে বলে অভিযোগ আনলেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। তিনি মনে করেন, এর পেছনে রাজনৈতিক একটি প্রতিপক্ষের ইন্ধনও আছে।
সোমবার রাজধানীর সেগুনবাগিচার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটে সংবাদ সম্মেলন করে মন্ত্রী নতুন শিক্ষাক্রমের বিরুদ্ধে উঠা ‘সব সমালোচনার’ জবাবও দেন।
তিনি বলেন, “আমরা দেখেছি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন আইডি থেকে যারা অপপ্রচার চালিয়ে এটাকে একটি আন্দোলনে রূপ দেয়ার চেষ্টা করছেন, তারা মূলত কোচিং ব্যবসায়ী।
“তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নোট-গাইড বইয়ের ব্যবসায়ীরা। কারণ, এরা মনে করছেন, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হলে তারা ব্যবসায় মার খাবেন।”
গত ১৯ অক্টোবর নতুন শিক্ষাক্রম সংস্কার ও পরীক্ষা পদ্ধতি চালুর দাবিতে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনের সড়কে মানববন্ধন হয় ‘অভিভাবকদের’ ব্যানারে।
তাদের দাবিগুলো হল: নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল, ৫০-৬০ নম্বরের অন্তত দুটি সাময়িক লিখিত পরীক্ষা চালু রাখা, ত্রিভুজ-বৃত্ত-চতুর্ভুজসহ সব ধরনের চিহ্নভিত্তিক ফল পদ্ধতি বাতিল করে নম্বর ও গ্রেডিং ভিত্তিতে মূল্যায়ন, শিখন ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক ক্লাসের সব খরচ স্কুলকে বহন, স্কুল পিরিয়ডেই সব প্রজেক্টের কাজ করা, শিক্ষার্থীদের দলগত কাজে মোবাইলসহ ডিভাইসমুখী হতে নিরুৎসাহিত করে অধ্যয়নমুখী করা, প্রতি বছর সব ক্লাসে রেজিস্ট্রেশন ও সার্টিফিকেট প্রদানের সিদ্ধান্ত বাতিল এবং সব শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের আগে অবশ্যই তা মন্ত্রিপরিষদ ও জাতীয় সংসদে উত্থাপন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সংবাদ সম্মেলনে আসেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, “বিদ্যালয়গুলো আমাদের সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছে, তাদের কোনো অভিভাবক সেখানে ছিল না। একটি বিদ্যালয় জানিয়েছে, তাদের কয়েকজন অভিভাবককে ২ হাজার টাকা করে দিয়ে সেখানে আনা হয়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে কোন ইস্যু না পেয়ে এটিকে ইস্যু বানানোর চেষ্টা করছেন। রাজনৈতিক একটি প্রতিপক্ষের এতে ইন্ধন আছে।”
‘নতুন শিক্ষাক্রমে পড়াশোনা নেই’, ‘পরীক্ষা নেই’, ‘শিক্ষার্থীরা কিছু শিখছে না’ – বলে যেসব কথা ছড়ানো হচ্ছে, সেগুলো সঠিক নয় জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “শিক্ষার্থীরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি পড়বে, নিজেরা সক্রিয়ভাবে পড়বে, শিখবে। দলগত কাজ করে আবার তা নিজেরাই উপস্থাপন করবে, শুধু জ্ঞান নয়, দক্ষতাও অর্জন করবে।
“আর মূল্যায়ন হবে প্রতিটি কাজের। আবার ষান্মাসিক মূল্যায়ন এবং বার্ষিক মূল্যায়নও হবে। কাজেই পরীক্ষা ঠিকই থাকছে, কিন্তু পরীক্ষার ভীতি থাকছে না। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া এবং না হওয়া আছে শুধু তাই নয়, পারদর্শিতার ৭টি স্কেলে তাদের রিপোর্ট কার্ডও আছে।”
প্রচুর উপকরণ কিনতে হবে জানিয় ব্যয় বেড়ে যাওয়া নিয়েও ভুল তথ্য দেয়া হচ্ছে বলে জানান মন্ত্রী। তিনি বলেন, “স্থানীয়, সহজলভ্য ও পুনঃব্যবহারযোগ্য কাগজ ও উপকরণ ব্যবহারের নির্দেশনা বার বার দেওয়া হয়েছে। ফলে ব্যয় বাড়ার কোনো কারণ নেই। আর নোট বই কিংবা কোচিংয়ের খরচ তো লাগবেই না।”
গ্রামের স্কুল উপকরণ পাবে না বা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কেনার সামর্থ্য নেই ফলে বৈষম্য বাড়বে বলেও যে কথা বলা হচ্ছে, সেটিও ‘সঠিক না’ বলে জানান তিনি।
মন্ত্রী বলেন, “তৃণমূল পর্যায়ে সহজলভ্যতা নিশ্চিত করেই উপকরণ, শিখন-শেখানো পদ্ধতি ইত্যাদি নির্বাচন করা হয়েছে এবং প্রতি ক্ষেত্রেই বিকল্প উপায় রাখা হয়েছে। ফলে বৈষম্য তো নয়ই বরং গ্রামের বিদ্যালয়গুলো ভালো করছে। তাছাড়া কোচিং, গাইড বইয়ের ব্যয় লাগছে না, ফলে বৈষম্য কমছে এবং দরিদ্র শিক্ষার্থীরা ভালো করছে।”
বাসায় গিয়ে দলগত কাজ করতে হয়, যা বাস্তবে সম্ভব না হওয়ায় ডিভাইস নির্ভরতা বাড়ছে -এমন ধারণার প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, “সকল দলগত কাজ বিদ্যালয়ে করার নির্দেশনা দেওয়া আছে। বাড়িতে কোনো দলগত কাজ দেওয়া হয় না।”
নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীরা লিখছে না, ফলে বানান-ব্যাকরণ-এসব শিখছে না- এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “যে কোনো সময়ের চেয়ে শিক্ষার্থীদের এখন বেশি লিখতে হচ্ছে। কারণ, প্রতিটি বিষয়ের প্রতিটি অভিজ্ঞতায় তাদের বিভিন্নভাবে প্রায়োগিক লেখার সুযোগ রাখা হয়েছে। ফলে শুধু বানান বা ব্যাকরণ নয়, শিক্ষার্থীরা এখন স্বতঃস্ফূর্ত নিজের প্রয়োজনে লিখতে পারছে।
“প্রতিটি গণিতের ধারণা এখন প্রায়োগিক ক্ষেত্রে বাস্তব পরীক্ষা ও ব্যাপক অনুশীলনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা করছে।”
ধর্মশিক্ষায় লিখিত পরীক্ষা রাখা হয়নি – এমন অপপ্রচারের বিষয়ে তিনি বলেন, “সব বিষয়ের জন্য একই পদ্ধতিতে মূল্যায়ন ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে লিখিত মূল্যায়ন অন্তর্ভুক্ত আছে।”
‘যে কোনো পরিবর্তনই মেনে নিতে কষ্ট হয়’
অভিভাবকদের ‘অপপ্রচারে’ বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক নিয়ে মিথ্যাচার হচ্ছে। এরা চায় না শিক্ষার্থীরা স্বাধীনভাবে শিখতে, চিন্তা করতে শিখুক, অনুসন্ধিৎসু হোক, মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার চর্চা করুক।
“অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে নিজে যাচাই করুন, সঠিক তথ্য জানার চেষ্টা করুন। স্বার্থান্বেষী কোনো মহলের ফাঁদে পা দেবেন না।”
এগিয়ে যাওয়ার জন্য রূপান্তর অবশ্যম্ভাবী উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, “যে কোনো পরিবর্তনই মেনে নিতে, খাপ খাইয়ে নিতে কষ্ট হয়। আর রূপান্তরকে মেনে নেওয়া আরও কষ্টকর। কিন্তু বুঝতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। একমাত্র বিকল্প হল পিছিয়ে পড়া, নতুন প্রজনের জীবনকে ব্যর্থ করে দেওয়া। যা আমরা কিছুতেই হতে দিতে পারি না।”
রূপান্তর প্রক্রিয়ার যথাযথ বাস্তবায়ন, শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবে দাবি করে তিনি বলেন, “অভিভাবকরা সন্তানের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের কথা ভাবুন, তাদের যে কোনো পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিয়ে উৎকর্ষ লাভের কথা ভাবুন। একবার ভীষণ প্রতিযোগিতার চিন্তা থেকে বেরিয়ে সহযোগিতার, সহমর্মিতার চর্চার মধ্য দিয়ে সন্তানের ভালো মানুষ হওয়ার কথা ভাবুন।”
পরিবর্তন আসবে ভর্তি ও নিয়োগ পরীক্ষাতেও
নতুন শিক্ষাক্রমের সঙ্গে মিল রেখে ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়া হবে বলেও জানান শিক্ষামন্ত্রী।
তিনি বলেন, “নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন। তারা মহাচিন্তায় পড়ে গেছেন যে, তাদের বাচ্চারা কীভাবে চাকরি পাবে। শিক্ষাজীবনের কোনো ফলাফল তাদের সন্তানদের চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে কাজে আসবে না- এমনটাও অনেকে বলে বেড়াচ্ছেন। তদের বলতে চাই, চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে পারদর্শীতার মূল্যায়ন করা হবে। পারদর্শীতার মূল্যায়নের ভিত্তিতেই নিয়োগ হবে।
“বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষা, চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার কাঠামোয়ও পরিবর্তন আসবে। এই শিক্ষাক্রমের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। আর সরকারি নিয়োগের বাইরে বেসরকারি জগতে এখন সনদের চাইতে দক্ষতা বা যোগ্যতা বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
রোববার বিএনপি ও জামায়াতের ডাকা হরতালে অনেক পরীক্ষা স্থগিত হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “এখন প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষার সময়, মূল্যায়নের সময়। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সব শেষ করার জন্য আমরা নির্দেশনা দিয়েছি।”
বিরোধী দলের উদ্দেশে তিনি বলেন, “যারা এমন সহিংসতা করছে, তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যারা আছেন, তারা সবাই ভোটার। লক্ষ লক্ষ ভোটার আছে। তাদের শিক্ষাজীবন নষ্ট করে দিয়ে তাদের অনিশ্চয়তায় ফেলে আপনারা কী লাভবান হবেন?”