উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন ক্রমশ ধূসর

গ্রামের দরিদ্র পরিবার থেকে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়াই ছিল তাদের জন্য একটি সংগ্রাম; সেই স্বপ্ন জয়ের লড়াইকে বহুগুণ কঠিন করে দিয়েছে করোনাভাইরাসের মহামারী।

সাবিকুন্নাহার লিপিসাবিকুন্নাহার লিপিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Sept 2021, 07:25 PM
Updated : 8 Sept 2021, 08:12 PM

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সজীব হোসেন পড়ালেখা চালাতেন টিউশনি করে। মহামারীর শুরুতে গত বছরের মার্চে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেল, তার টিউশনগুলোও আর থাকল না।

হল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আর সবার মত সজীবকেও ফিরে যেতে হয় তার গ্রামের বাড়িতে। কিছুদিন পর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস শুরু হয়। কিন্তু সেখানে ইন্টারনেটের গতি দুর্বল বলে ঠিকমত ক্লাসও করতে পারছিলেন না।

প্রায় আট মাস পর ঢাকায় ফিরে মেসে ওঠেন সজীব। কিন্তু তার টিউশনিগুলো ফেরেনি। স্কুল বন্ধ থাকায় এবং ভাইরাসের ভয়ে অভিভাবকরা বাসায় টিউটর রাখছেন না।

এদিকে হল বন্ধ থাকায় সজীবকে থাকতে হচ্ছে মেসে। ফলে মাসের খরচ আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। আগে যেখানে হাজার পাঁচেক টাকায় মাস পার করা যেত, এখন নয় হাজারেও হতে চায় না।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “অনেক কষ্টে একটা কোচিংয়ে ক্লাস ম্যানেজ করেছি, সেখানে এখন ক্লাস করছি। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও টিউশনি পাইনি। আমার অবস্থাটা খারাপ, অভিভাবকদের অবস্থাও সবার ভালো না। বাসায় টিউটর রাখতে অনেকের ভয় আছে, অর্থনৈতিক সমস্যাও বেড়েছে অনেকের।”

কোচিং থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে নিজের খরচ চালাতে না পারায় এখন বাড়ি থেকে টাকা আনতে হচ্ছে শিক্ষার্থীকে। এখন তিনি আশায় আছেন, সামনে হল খুলে দিলে তার খরচ কিছু কমবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্য সেন হলের ক্যাফেটেরিয়ার সামনে বাস্কেটবল খেলার মাঠে জমেছে শুকনো পাতা, পানি জমে শ্যাওলাও হয়েছে। কারণ শিক্ষার্থীদের আনাগোনা নেই।

সরকার এর আগে ১৭ মে হল এবং ২৪ মে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু তাতে বাদ সাধে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ।

এখন সংক্রমণ কমায় আগামী ১২ সেপ্টেম্বর স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের টিকা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ও শিগগিরই খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে সরকার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রথম ধাপে অনার্স চতুর্থ বর্ষ ও মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক হল খুলে দেওয়ার কথা জানিয়েছে।

তাদের পরীক্ষা শেষ হলে নভেম্বরে দ্বিতীয় ধাপে অনার্স প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের হলে তোলা হবে বলে পরিকল্পনা করা হয়েছে।

সবার জন্য দ্রুত হল খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়ে সজীব বলেন, “এমন না আমরা বাসায় আছি। বাইরে বের হতেই হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া হোক।”

সজীবের মত সঙ্কটে পড়া আরেক শিক্ষার্থী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ইমাম হোসেন। এক অর্থে তার সঙ্কট আরও বেশি, কারণ টিউশনির টাকায় নিজের পড়ার খরচ চালানোর পাশাপাশি বাড়িতেও তিনি কিছু টাকা পাঠাতেন।

মহামারীর শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলে তিনিও গ্রামের বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু পরিবারের যা আর্থিক অবস্থা, তাতে তার বয়সী ছেলের ঘরে বসে থাকার জো নেই। বিশ্ববিদ্যালয় না খুললেও এ বছরের শুরুতে কাজের সন্ধানে তাকে আবার ঢাকায় ফিরতে হয়েছে।

ইমাম হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “লেখাপড়ায় সাপোর্ট দেওয়ার মতো অবস্থা আমার ফ্যামিলির নাই। যখন অর্থনৈতিক আর মানসিক চাপ আসে, তখন লেখাপড়া করে কিছু করব- সেটা ভাবাও আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যায়।”

সেই চাপ মাথায় নিয়ে মহামারীর মধ্যে ঢাকায় ফিরেও সুবিধা করতে পারছেন না ইমাম। আগের টিউশনিগুলো ফিরে পাননি, আপাতত একটি কোচিংয়ে ক্লাস নিচ্ছেন।

“আগে যে রকম চলার মত একটা টাকা হত, এখন সেরকম হচ্ছে না, চলতে হচ্ছে ধার করে। মেসের ভাড়া, খাওয়ার মিল বাকি থেকে যায়।”

পরিবারের আর্থিক অবস্থার কথা তুলে ধরে এই শিক্ষার্থী বলেন, “আগে আমি নিজের খরচ মিটিয়ে কিছু টাকা পাঠাতে পারতাম। সে কারণে মাস শেষে তাদেরও চাহিদা থাকত যে, ছেলের কাছ থেকে দেড়-দুই হাজার টাকা আসবে। বাবা অনেক বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। তাদের প্রত্যাশার জায়গা থেকে এখন আর কিছু পাচ্ছেন না। সেজন্য তারা বাধ্য হয়েই চাকরি বাকরি করতে বলেন।”

ইমামের পরিচিত আরও অনেকেই এমন সঙ্কটের মধ্যে পড়েছেন মহামারীর মধ্যে। বিশ্ববিদ্যালয় খুললেও আয়ের পথ না থাকলে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া তাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে।

“একদিন এক বন্ধু ফোন করে বললো গার্মেন্টেসে কাজ করবে। আর আমরা গ্রামের কাজগুলোও শিখিনি, সেজন্য সেখানেও কাজ পাচ্ছি না। তবে আমার দুইজন বন্ধু সেই কাজও করেছে। এক বন্ধু ওর বাবার সাথে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে ধান কেটেছে।”

গত বছরের জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে মেস ভাড়া সঙ্কট নিরসনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কমিটি শিক্ষাবৃত্তি ১০ গুণ বাড়ানোর সুপারিশ করে। পরে বিভিন্ন বিভাগ থেকে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের তালিকা করে তাদের সহায়তা দেওয়া হয়।  

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৫ হাজার একশ টাকা পেয়েছেন জানিয়ে ইমাম বলেন, “মেস ভাড়াই লাগে আড়াই হাজার টাকা। অন্যান্য খরচ বাদে থাকা এবং খাওয়ার পেছনে সাত হাজার টাকা চলে যায় প্রতি মাসে। বিশ্ববিদ্যালয় কিছুটা সহায়তা দিলেও আমাদের কষ্টটা আসলে থেকেই যাচ্ছে।”      

ক্লাস খুলে দেওয়ার দাবিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকশ শিক্ষার্থী গত ফেব্রুয়ারিতে উঠে পড়েছিলেন হলে। পরে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার তারিখ ঘোষণা করে তাদের ফেরত পাঠানো হলেও সেই তারিখে আর ক্লাস শুরু করা যায়নি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জুলাই মাস থেকে ভার্চুয়ালি শুরু হয় স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের চূড়ান্ত পরীক্ষা। নিজের ভালো ডিভাইস না থাকায় শিক্ষার্থী ফারহান সিকদার কিছু পরীক্ষা দিয়েছেন অন্যের মোবাইল ধার করে।

মহামারীর আগে তিনি হলে থাকতেন, নিয়মিত যেতেন ক্লাসে, টিউশনি করে নিজে চলার পাশাপাশি পরিবারকেও সহায়তা করতেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে ফারহান বলেন, “স্মার্টফোন না থাকায় অনলাইন ক্লাসও করতে পারিনি। ডিপার্টমেন্ট থেকে বলছিল লোন নিয়ে ফোন কিনতে। টাকাটা আবার ফেরত দিতে হবে, সে কারণে লোন নিইনি। সেই সামর্থ্য আমার নাই।”

এই বিপদের সময়ে ফরহানের সঙ্কট আরও গভীর করে তুলেছে মায়ের অসুস্থতা। চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে পরতে হয়েছে ঋণে। পরিস্থিতি সামাল দিতে গ্রামে বর্গা চাষী বাবার সাথে মানুষের জমিতে কাজ করছেন ফারহানও।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী আশফার রহমান নবীন গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে মেসে থাকছেন। এর একটি কারণ গ্রামের বাড়িতে ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক ভালো না। তবে তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কারণ পরিবারের অর্থনৈতিক সঙ্কট।

“আমরা যে টিউশনি করে শুধু হাত খরচ চালাই ব্যাপারটা এমন না। অনেকের এমনও হয় যে, টিউশনি করে ফ্যামিলিকে সাপোর্ট করতে হয়।”

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আয় কমার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের খরচ বেড়ে গেছে বলে জানালেন এই শিক্ষার্থী। আগে তিনি টিউশনি করাতে যেতেন ক্যাম্পাসের বাসে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় যেতে হচ্ছে নিজের খরচে।

“হলে থাকতে অল্প টাকায় স্বাস্থ্যসম্মত খাবারটা পেতাম। এখন বেশি খরচে হোটেলের খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। পরিবারকে তো সাহায্য করতেই পারছি না, আমাদেরই খুব টানাটানির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। অনেকেই আছে ধার হয়ে গেছে এরমধ্যে।”

হল না খুলেই শিক্ষার্থীদের শারীরিক উপস্থিতিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের চূড়ান্ত পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে।  

শিক্ষার্থীদের শারীরিক উপস্থিতিতে চলছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের চূড়ান্ত পরীক্ষা। তবে বন্ধ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক সুবিধা ও নিজস্ব পরিবহন শাটল ট্রেন।

পরীক্ষা দিতে উত্তরবঙ্গ থেকে চট্টগ্রামে এসে মেসে উঠেছেন চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মিনহাজ হাসান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বাড়ি থেকে এখানে আসা যাওয়ার ভাড়াই পরে দুই আড়াই হাজার টাকা। ফরম ফিলাপের বড় একটা টাকা- সব মিলিয়ে চাপে পড়ে গেছি। চলব যে, টিউশনিও পাচ্ছি না।”

হল বন্ধ থাকায় পরীক্ষা দিতে আসা শিক্ষার্থীরা ভিড় করছেন বিভিন্ন মেসে। ফলে তৈরি হয়েছে সিটের সঙ্কট।

 “আগে যে সিট সাত থেকে আটশ টাকায় পাওয়া যেত, সেটা এখন দেড় হাজার টাকা। খাবারের খরচ তো আছেই। ধার জমে যাচ্ছে। পরিবারের অবস্থাও ভালো না, বন্ধুদের থেকে ধার নিতে হচ্ছে। সামনে কী হবে, কতটা কী পারব, সবই এখন অনিশ্চিত।”