ঢাবিতে পাকিস্তানি সংগঠনের সেমিনার, ক্ষুব্ধ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা

বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের একজন শিক্ষকের ব্যবস্থাপনায় ওই সেমিনার হয়।

রাসেল সরকারঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Jan 2023, 07:19 PM
Updated : 12 Jan 2023, 07:19 PM

পাকিস্তানের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-সংস্কৃতি বিনিময় বন্ধ থাকার পরও ক্যাম্পাসে সেমিনার করেছে ‘দাওয়াতে ইসলামী’ নামের এক পাকিস্তানভিত্তিক ধর্মীয় সংগঠন, যা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ‌শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

গত ৩ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার থিয়েটার ভবনের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে ‘দাওয়াতে ইসলামীর শিক্ষা বিভাগ, ঢাবি' ব্যানারে ওই সেমিনার করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল-মারুফের ব্যবস্থাপনায় ওই সেমিনার আয়োজন করা হয়। সেমিনারের জন্য মিলনায়তনও ভাড়া নেওয়া হয় তার তত্ত্বাবধানে।

তবে বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হলে তিনি তা অস্বীকার করে ‘শ্রোতা’ হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বলে দাবি করেন।

সেমিনারে প্রধান বক্তা ছিলেন দাওয়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় পর্ষদের প্রধান, পাকিস্তানি মাওলানা হাজী ইমরান আত্তারী। তিনি সেখানে উর্দু ভাষায় বক্তব্য দেন। 

২০১৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় পাকিস্তানের সাথে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্নের সিদ্ধান্ত হয়। 

ওই সিদ্ধান্তের কার্যবিবরণীতে বলা হয়, “একাত্তরে গণহত্যার জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা না করা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজ থেকে পাকিস্তানের সাথে বিদ্যায়তনিক, গবেষণামূলক, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়াকেন্দ্রিক সকল প্রকার যোগাযোগ ও সম্পর্ক ছিন্ন করছে।

“এখন হতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষক কিংবা ছাত্র-ছাত্রীদের কোনো প্রতিনিধি দল পাকিস্তান সফরে যাবে না ও পাকিস্তানের সাথে কোনো শিক্ষা বিনিময় কার্যক্রম পরিচালিত হবে না।”

বিষয়টি নজরে আনা হলে অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ১৯৭১ সালের গণহত্যা নিয়ে পাকিস্তানের মিথ্যাচারের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ঠিক হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে পাকিস্তানের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহযোগিতামূলক কার্যক্রম থাকবে না এবং  পাকিস্থানের কোনো ছাত্র-ছাত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত কোনো  প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারবে না।  পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো অ্যাকাডেমিক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম কোনো কিছুই করতে পারবে না।

“এখন যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটে, তাহলে আমি মনে করি এটা অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং দুঃখজনক। যারা করেছে, তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক যথাযথ শাস্তির আওতায় আনা জরুরি।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদাররা হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ করে বাংলাদেশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। আমাদের ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে, ২ লক্ষের বেশি মা-বোনের সম্ভ্রমহানি করে। সেই পাকিস্তানের একটি মৌলবাদী সংগঠনকে এনে যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র প্রাঙ্গণে সেমিনার করে, তা অবশ্যই ধৃষ্টতাপূর্ণ, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সভায় পাকিস্তানের সঙ্গে শিক্ষা-সংস্কৃকি-ক্রীড়া সকল ক্ষেত্রে সম্পর্ক না রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া আছে। ফলে এই ধরনের ধৃষ্টতাপূর্ণ কাজের সঙ্গে যারাই জড়িত হয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এগুলো জানার পরেও কোনো শিক্ষক যদি এটা করেন, তাহলে তা অপ্রত্যাশিত ও অগ্রহণযোগ্য। অ্যাকাডেমিক অঙ্গনে এ ধরনের নিষিদ্ধ জিনিসকে নিয়ে যারা কাজ করে, আমি মনে করি তাদের কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার।

“এধরনের কার্যকলাপ আমাদের সামগ্রিক চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে যায় না এবং শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষার উদ্দেশ্য কারো সাথেই সম্পর্কিত নয়। সুতরাং এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে বলে আমি প্রত্যাশা করি।”

এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতও।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সব সময় প্রগতিশীলতার চর্চা করে। এখানে ধর্মীয় রাজনীতির সুযোগ নাই। একইভাবে পাকিস্তানি কোনো সংগঠন ধর্মের মোড়কে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করা, এটা আমরা কোনোভাবে কামনা করি না।

“আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আর. সি মজুমদার মিলনায়তনের মত একটা জায়গায় তারা কীভাবে ভাড়া নেয়? সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন লাগে। এই অনুমোদন ম্যানেজ করল কীভাবে?”

আরবি বিভাগের এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল-মারুফ দাওয়াতে ইসলামীর শিক্ষা বিভাগ- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার প্রধান। সেমিনারে উনি ওই পরিচয়ে বক্তব্যও দিয়েছেন।

তবে ওই আয়োজনের সাথে সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল-মারুফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার উদ্যোগে এই আয়োজন হয়নি। আমি ছিলাম শ্রোতা। ভাড়া দিয়েছেন আর্টস ফ্যাকাল্টির ডিন স্যার। এটা আমার কোনো বিষয় না। এই সংগঠনের সঙ্গে আমি কোনোভাবেই জড়িত নই, এমনকি পরিচিতও না।”

“বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা পাকিস্তানের কোনো সেমিনারে দাওয়াত পেলেও যাই না। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের সাথে পাকিস্তানের সকল ধরনের সম্পর্ক আছে। তাবলীগ জামায়াতেও পাকিস্তান থেকে লোকেরা আসে। তারাও তো সেখানে উর্দুতে কথা বলে। কিন্তু এই বিষয়টা নিয়ে পানি ঘোলা করছে কিছু লোক।”

নিজেকে আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সদস্য দাবি করে তিনি বলেন, “আমি অবাক হচ্ছি, আমার মতো মানুষ কি স্বাধীনতা বিরোধী লোকদের প্রশ্রয় দেব? আমার পরিচয় তো সবাই জানে। মুক্তিযু্দ্ধ পরিবারের  সন্তান।  আমরা তো কখনোই আমাদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কাউকে প্রশ্রয় দেব না।”

সেমিনারের জন্য মিলনায়তন ভাড়া করার বিষয়টি অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল-মারুফ অস্বীকার করলেও কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আবদুল বাছির বলছেন ভিন্ন কথা।

তিনি বলেন, “ওই নামে কোনো সংগঠন আমাদের কাছে অনুমতি নেয়নি। আমাদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছেন আরবি বিভাগের একজন টিচার। উনার নাম আব্দুল্লাহ আল মারুফ। আমরা টিচারদের অনুমতি দিই, কারণ তারা অনেক সময় শিক্ষার্থীদের নিয়ে নানা ধরনের প্রোগ্রাম করেন।

“টিচাররা চাইলে আমরা দিই, আমাদের নিয়মের মধ্যে আমরা দিয়েছি। কিন্তু টিচার কাদের নিয়ে প্রোগ্রাম করেছে, সেটা আমাদের জানায়নি। আমাদের সঙ্গে এটার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।”

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এটা নজরে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমি ডিন সাহেবের কাছে জানতে চেয়েছি, এরা কারা? জানতে পারলাম আরবি বিভাগের এক শিক্ষক এখানে এই ধরনের একটা প্রোগ্রাম করেছে।

“এই বিশ্ববিদ্যালয় ধর্ম প্রচারের জায়গা না, এটা জ্ঞান চর্চার জায়গা। সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান এখানে নাই। এখানে ধর্ম নিয়ে জ্ঞানচর্চা হতে পারে, কিন্তু প্রচার-প্রসারের জায়গা এটা না। এই কথাটা তাকে বলা হয়েছে এবং ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করা হয়েছে।”

সিন্ডিকেটের নিয়ম লঙ্ঘন করায় ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে কিনা, এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিষয়টি এড়িয়ে যান উপাচার্য।