নিজের ঘোষিত নীতিমালা কেন্দ্রীয় ব্যাংক মানছে না বলে সংস্থাটির ভাষ্য।
Published : 23 Apr 2024, 09:56 PM
দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে সবল ব্যাংকের একীভূতকরণে আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত নীতিমালা অনুসরণ করা হচ্ছে না বলে মনে করছে দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
মঙ্গলবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংস্থাটি বলেছে, “ব্যাংকিং খাতের দুর্বল ব্যাংকগুলো রক্ষার নামে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একীভূতকরণের পথে হাঁটতে শুরু করেছে, যা আর্থিক খাতে সংকট মোকাবিলায় বৈশ্বিক চর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিবেচিত হওয়ার কথা।
“কিন্তু সংবেদনশীল ও জটিল এই কাজটি করতে আন্তর্জাতিকভাবে অনুসৃত মানদণ্ড ও রীতিনীতি এবং এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজের ঘোষিত নীতিমালা না মেনে তড়িঘড়ি করা হচ্ছে।”
দেশে ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনতে গত কয়েক বছর ধরেই তাগিদ দিয়ে আসছেন অর্থনীতিবিদরা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও ব্যাংক খাতের সংস্কারের বিষয়টি তাদের সর্বশেষ নির্বাচনি ইশতেহারে রেখেছে।
সেই ধারাবাহিকতায় দুর্বল ও ঝুঁকিতে থাকা ব্যাংকগুলোকে সবলের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আড়াই বছরের ‘রোডম্যাপ (কর্ম কৌশল)’ ঠিক করার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে এক বছর সময় দিয়ে ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন’ বা পিসিএ নীতি ঘোষণা করা হয়েছে।
সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১০ ব্যাংক ‘স্বেচ্ছায়’ একীভূত হতে চাইছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তরফে বলা হলেও টিআইবি বলছে ভিন্ন কথা।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জমান বলেন, “গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, একটি দুর্বল ব্যাংক ছাড়া কোনো ব্যাংকই নিজ উদ্যোগে একীভূত হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি, আবার এ প্রক্রিয়ায় নাম আসা সবল ব্যাংকগুলো স্বীয় উদ্যোগে স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে এতে যুক্ত হতে সম্মত হয়েছে তাও নয়। অর্থাৎ পুরো প্রক্রিয়াটি প্রথম থেকেই স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, যা ঘোষিত নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
“তাছাড়া, দুর্বল ব্যাংকের সম্পদ ও দায়-দেনার পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন ছাড়া আপাত সবল ব্যাংকের ঘাড়ে একীভূতকরণের নামে ঋণখেলাপি ও জালিয়াতির বোঝা চাপিয়ে দেওয়া কতোটুকু যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত? অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, যা ঘটছে তা ক্যান্সার চিকিৎসায় প্যারাসিটামল প্রয়োগের নামান্তর।”
গত ৪ এপ্রিল ব্যাংক একীভূত করার বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তার আগেই বেসরকারি পদ্মা ব্যাংককে শরিয়াভিত্তিক এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার ঘোষণা আসে। ব্যাংক দুটি ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন পেয়ে সমঝোতা চুক্তিও করেছে।
নীতিমালা জারির পর রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে বিডিবিএল একীভূত করার বিষয়ে অনুমোদন দিয়েছে দুই কোম্পানির পর্ষদ। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংককে বেসরকারি সিটি ব্যাংকের সঙ্গে এবং ন্যাশনাল ব্যাংককে ইউসিবির সঙ্গে একীভূত করার বিষয়ে আলোচনা চলছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে।
এর বাইরে রাষ্ট্রায়ত্ত বিশেষায়িত ব্যাংক বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জমান বলেন, “একীভূতকরণের আলোচনায় সরকারি-সরকারি, বেসরকারি-সরকারি এবং বেসরকারি-বেসরকারি তিন ধরনের ব্যাংকই রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোন বিবেচনায় এই ব্যাংকগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একীভূত করার জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে, কিংবা কোন সবল ব্যাংকের সঙ্গে কোন দুর্বল ব্যাংক একীভূত হবে, তা কীভাবে ঠিক করা হয়েছে- তাও স্পষ্ট নয়।
“আবার একীভূত হওয়ার আলোচনার বাইরে থাকা বেশ কয়েকটি ব্যাংককে তারল্য সহায়তা দিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে দুর্বল দুটি ব্যাংকের দায়িত্ব নিতে যাওয়া সবল বলে পরিচিত সরকারি দুটি ব্যাংকের নিজেদের খেলাপি ঋণের পরিমাণও বেশ বড়। এমন বাস্তবতায় ব্যাংকিং খাতের মূল সমস্যা মোকাবিলায় কার্যকর জবাবদিহি-ভিত্তিক সুশাসন নিশ্চিত করা ছাড়া, শুধু একীভূত করলেই সংকট মোকাবিলা করা যাবে বা গ্রাহক স্বার্থ রক্ষা পাবে কিংবা খেলাপি ঋণ কমে আসবে- এমন ভাবনা সত্যিই অলীক।”
একীভূতকরণ নীতিমালায় দুর্বল ব্যাংকের পরিচালকদের ৫ বছর পর একীভূত হওয়া ব্যাংকের পর্ষদে ফেরত আসার যে সুযোগ রাখা হয়েছে তার সমালোচনা করেন টিআইবির ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি বলেন, “এ বিধান দুর্বল ব্যাংকের সংকটের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির বদলে পুরস্কৃত করা এবং এক ধরনের দায়মুক্তি দেবার বিধান। পাশাপাশি দুর্বল ব্যাংকের নিরীক্ষাকালে নতুন কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতির চিত্র উঠে এলে সে বিষয় গোপন রাখার যে বিধান নীতিমালায় রাখা হয়েছে, তা শুধু আর্থিক অনিয়মের চিত্রকেই ধামাচাপা দেবে না, একই সঙ্গে দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির মুখোমুখি করার প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হবে। যা এক কথায় অন্যায়কে সুরক্ষা দেওয়ার শামিল।”
বিবৃতিতে টিআইবি বলেছে, প্রত্যাশিত ফল পেতে সংশ্লিষ্ট খাতে সুখ্যাতিসম্পন্ন নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞগণের মতামতের ভিত্তিতে এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও অভিজ্ঞতার আলোকে ব্যাংক একীভূতকরণ নীতিমালায় প্রয়োজনীয় সংস্কার ও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।
পাশাপাশি ইতোমধ্যে একীভূতকরণের নামে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের বাস্তবায়ন স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি।
যা বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক
মোটাদাগে দুটি উদ্দেশ্যে একীভূতকরণ নিয়ে কাজ করার কথা বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
মঙ্গলবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, "২০২৬ সালে বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। ফলে উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে কার্যকর ব্যাংকিং সেবা প্রদানের জন্য দেশে অধিক সক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন হবে, যাতে করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিনিয়গের ক্ষেত্রে কোনোরূপ বাধার সৃষ্টি না হয়।"
দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে, "অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংকের বিদ্যমান সমস্যা সমাধান এবং একইসাথে অপেক্ষাকৃত সবল ব্যাংকের কার্যক্রম উন্নয়নের মাধ্যমে আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করা; যাতে করে জনস্বার্থে একীভূত ব্যাংক-কোম্পানি অধিকতর সেবা প্রদান করতে পারে।"
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, একীভূতকরণে প্রক্রিয়াধীন ব্যাংকগুলোতে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের জমাকৃত আমানত সম্পূর্ণ নিরাপদ ও সুরক্ষিত থাকবে।
একীভূতকরণের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পরও স্ব স্ব ব্যাংকের হিসাবধারীদের বর্তমান হিসাব চলমান থাকবে।