‘কিছু না কিছুর’ দাম বাড়ছেই: ‘হিসাব করেও পারা যাচ্ছে না’

সপ্তাহজুড়ে উত্তাপ ছড়ানো ডিম-মুরগি নিম্নমুখী হলেও নতুন করে বেড়েছে চাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, আলুর দাম।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 August 2022, 02:33 PM
Updated : 19 August 2022, 02:33 PM

কিছু পণ্যের লাগামহীন মূল্য বাড়ার রেশ না কাটতেই বাজারে সরু চালের দাম কেজিতে গড়ে আরও তিন টাকা করে বেড়ে বেশি বিক্রি হওয়া নাজিরশাইল ৮০ টাকা ও মিনিকেট ৭৬ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।

আর সপ্তাহজুড়ে উত্তাপ ছড়ানো ডিম ও মুরগির দাম গত দুদিনে সামান্য নিম্নমুখী হলেও নতুন করে বেড়েছে সয়াবিন তেল, চিনি, পেঁয়াজ, আলুসহ আরও কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম।

শুক্রবার রাজধানীর শান্তিনগর, রামপুরা, মালিবাগ, মগবাজার, উত্তর বাড্ডাসহ বেশ কিছু খুচরা বাজার ঘুরে খাদ্যপণ্যের এমন বাজারদরের সঙ্গে ক্রেতাদের হতাশা, ক্ষোভ ও মন খারাপের চিত্রও উঠে এসেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায়।

কাঁচাবাজারে আসা ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলার সময় বেশির ভাগই তাদের হতাশা আর ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন। প্রতি সপ্তাহেই কোনো না কোনো পণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে বাজারে এসে কেনাকাটায় খেই হারিয়ে ফেলার কথা বলছেন সীমিত আয়ের লোকজন।

বৈশ্বিক পরিস্থিতি, ডলার ও জ্বালানি তেলের নজিরবিহীন দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রভাবে গত কয়েক মাস ধরে ‘অস্বাভাবিকভাবে’ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। এতে বাজার সদাইয়ে যে বাড়তি অর্থ বেরিয়ে যাচ্ছে সেই চিত্র পাওয়া গেলে পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী মো. আসাদুলের কাছ থেকে।

চলতি সপ্তাহেও নতুন করে কিছু জিনিসের দাম বাড়ায় হতাশা প্রকাশ করে তিনি জানান, শুক্রবার শান্তিনগর বাজার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকার কেনাকাটা করেছেন তিনি। মাছ-মুরগি, তেল, ডালসহ কিছু সবজি কিনতে এত টাকা গুণতে হয়েছে তাকে।

সবকিছুর দাম চড়া জানিয়ে তিনি বলেন, দুই-তিন বছর আগেও এমন পরিস্থিতি ছিল না।

“আগে যখন চার/পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে বাজারে যেতাম তখন পুরো মাসের বাজার-সদাই মোটামুটি কেনা যেত। এখন একই টাকার সদাই মাসের অর্ধেক সময়ও যাবে কি না সন্দেহ হয়। পকেট খালি, কিন্তু বাজার খুব অল্প। এভাবে যদি আরও কিছুদিন চলে তখন হয়ত না খেয়ে থাকতে হবে। ব্যবসাও মন্দা চলছে, এ কথা বলব কাকে?”

একই বাজারে কেনাকাটা করতে এসে বিড়বিড় করে নিজে নিজেই কিছু একটা বলছিলেন খান আফজাল হোসেন নামে এক প্রৌঢ়।

সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কী নিয়ে কথা বলছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এ কথা কাউকে বলে লাভ নাই, কে শুনবে আমাদের কথা? পরিস্থিতি হল এই- আজকে দাম বাড়ছে, কাল এর ওপর আরও বাড়বে। এখন আমি বাজারে এসে কি নিব?

“আমাদের জনগণের কথা এদের কাছে পৌঁছে না, এক তরফা যা ইচ্ছে তাই করছে।”

রামপুরা বাজারে কেনাকাটা করতে এসেছেন স্থানীয় বাসিন্দা রাসেল সামছুল আলম। বাসায় অনুষ্ঠান থাকায় বেশি তেল কিনতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, পাঁচ লিটারের সরিষার তেলের বোতলে গেল এক হাজার ২৫০ টাকা। একই দোকান থেকে একই পরমাণ সয়াবিন তেলের জন্য দিতে হল ৯১০ টাকা।

“যে তেল আজকে ২২শ টাকা দিয়ে কিনলাম, এখানেই বেশি গুণতে হল ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা! এভাবে তো সবকিছুর দামই বেড়েছে।”

শান্তিবাগের বাসিন্দা রুমা রাণী ঘোষ সবজি বিক্রেতাকে লাউ, কুমড়ো, টমেটো, পটলসহ কয়েকটি সবজি দিতে বলেন। দোকানি ব্যাগে ভরে সবজি দেওয়ার সময় চাইলেন ৩১০ টাকা।

তিনি বলেন, “দেখেন পাঁচ জাতের সবজি, এক প্রকার শাক কিনলাম, তাতেই ৩১০ টাকা হয়েছে। আরও তো বাকি আছে মাছ-মুরগি, চাল-ডাল। বাজারে এমন কিছু নেই যে দাম বাড়েনি, সব কিছুতেই চড়া। আমাদের কেনার সামর্থ থাকছে না।”

স্কুল শিক্ষক রুমা বলেন, “সংসার চালানো অনেক কষ্ট হয়ে যাচ্ছে, হিসাব করেও আর পারা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে সংসার, বাচ্চাদের প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই কেনা সম্ভব হচ্ছে না।”

ভোক্তাদের অভিযোগ, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ছাড়িয়ে গেছে। জিনিসপত্রের দাম দিন দিন বাড়ার কারণে অনেকের কাছে বাজারদরের বিষয়ে কথা বলতে গেলেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন, লাভ কী কথা বলে। কোনো ‘ফল তো বয়ে আনবে না’ বলে মন্তব্য তাদের।

দোকানিরাও জানান, প্রতি সপ্তাহেই নিত্য পণ্যের দামে হেরফের হচ্ছে। তবে কমার বদলে ‘লাগামহীনভাবে’ বাড়ছেই বেশি। দুই/তিন দিন যেতে না যেতেই বাড়তি নতুন মূল্যহার দিয়ে কোম্পানি থেকে মালামাল সরবরাহ করা হচ্ছে।

রামপুরা বাজারের মুদি দোকানি মাইদুল ইসলাম মাহিন জানান, শুক্রবার পর্যন্ত একটি ব্র্যান্ডের পাঁচ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের খুচরা মূল্য ৯১০ টাকায় বিক্রি করেছেন। এদিনই নতুন করে আরেকটি ব্র্যান্ড যে তেল বাজারে ছেড়েছে সেটির দর ধরা হয়েছে ৯৮০ টাকা।

একইভাবে খোলা চিনি ৮৮ এবং প্যাকেটজাত ৯০ টাকার নতুন রেট দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এক সপ্তাহে চিনিতে কেজিপ্রতি ৫ থেকে ৭ টাকা বেড়েছে।

এদিকে বাজারে আলু কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা বেড়ে ৩০ টাকা এবং পেঁয়াজ ৫ টাকা বেড়ে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

দাম কমেছে ডিম ও মুরগির

বেশ কিছু জিনিসের দাম বাড়লেও কমেছে ডিম ও ব্রয়লার মুরগির দাম। এক দিনের ব্যবধানে ফার্মের ডিম ডজনে ২০ থেকে ৩০ টাকা কমে ১২০ থেকে ১৩০ টাকায় নেমেছে। একই সঙ্গে ব্রয়লার মুরগি কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা কমে ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

এছাড়া সোনালী মুরগি কেজিতে ২০ টাকা কমে ২৮০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে এই মুরগি ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

ডিম ব্যবসায়ী আমনউল্লাহ জানান, প্রতি ডজন ফার্মের ডিম ১২০ টাকা বিক্রি হচ্ছে, যা গতকাল ১৪০ টাকা ছিল। এছাড়া হাঁস ও সোনালী মুরগির ডিম ১৯০ টাকা ডজন বিক্রি হচ্ছে।

এদিকে চাহিদা কমে যাওয়ায় এবং সরবরাহ বাড়ায় ব্রয়লার মুরগির দাম পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে কমেছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

কাপ্তান বাজারের মুরগির পাইকারি ব্যবসায়ী মেসার্স ফারুক ট্রেডার্সের মালিক ওমর ফারুক বলেন, “মানুষ মুরগি খাওয়া কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে। একদিকে চাহিদা কমেছে, অন্যদিকে বাজারে সরবরাহ বেড়েছে। এ কারণে দাম কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা কমেছে।”