সব নিয়ম প্রতিপালনে যে খরচ বেড়ে যাবে, তা তুলে ধরে পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার তাগিদ দিচ্ছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা।
Published : 23 Jan 2024, 11:41 PM
রপ্তানিমুখী কারখানায় শ্রমিক অধিকার ও পরিবেশ সুরক্ষা নিয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে পাস হওয়া নিয়মগুলো (ডিউ ডিলিজেন্স) যথাযথভাবে প্রতিপালন করা না হলে জরিমানা বা নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে সেই কারখানার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদে ইউরোপীয় ক্রেতাদের বাধ্য করা হতে পারে বলে সতর্ক করেছে ঢাকায় ইইউর রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি।
মঙ্গলবার ঢাকায় ইইউর ‘ডিউ ডিলিজেন্স ল’ এর ওপর ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশ (আইবিএফবি) আয়োজিত এক সেমিনারে তার এই সতর্কবার্তা আসে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের ব্যবসায়ীরাও সেমিনারে বক্তব্য দেন। ‘ডিউ ডিলিজেন্স ল’ অনুযায়ী নিয়মগুলো প্রতিপালনে যে খরচ বেড়ে যাবে, তা তুলে ধরে পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার তাগিদ দেন তারা।
হোয়াইটলি বলেন, যে ডিউ ডিলিজেন্স আইন করা হয়েছে, তা শুধু ক্রেতা–বিক্রেতার বিষয় নয়; সরবরাহ শৃঙ্খলে যুক্ত সবার পালনের জন্যই তা করা হয়েছে। এ নিয়মের শিশুশ্রম, বাধ্যতামূলক শ্রম, দাসত্ব (স্লেভারি), বন ধ্বংস, পরিবেশ দূষণ, ইকোসিস্টেমের ক্ষতি করা এবং মানবাধিকারের মত বিষয় রয়েছে।
“সুতরাং এসব শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়নের একার স্বার্থ নয়, এর সঙ্গে বৈশ্বিক স্বার্থ যুক্ত।”
পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি ডিউ ডিলিজেন্স আইন পাস করা হয়েছে, বেশিরভাগই ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে এসেছে। সবগুলো আইনের সারমর্ম প্রায় একই। তবে প্রতিটি নিয়মের জন্য একাধিকবার অডিট রিপোর্ট করতে হয়। এটি সময় ও আর্থিক দিক থেকে টেকসই নয়।
“বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে নৈতিক চর্চা পালন করা হচ্ছে। তবে এটি একপাক্ষিকভাবে সম্ভব নয়। এই প্রক্রিয়াকে সফল করতে হলে ক্রেতা–বিক্রেতা উভয়ের সমর্থন প্রয়োজন। ক্রেতাদের মধ্যে পণ্যের দাম কম দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে।”
ঢাকায় ইইউ মিশনের ডেপুটি হেড বার্নড স্প্যানিয়ার বলেন, স্থানীয় নিয়মের দুর্বলতা এবং কম দামে ক্রয়াদেশ নেওয়ার ‘অসুস্থ প্রতিযোগিতার’ কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ খাতে অনেকেই স্বেচ্ছায় নিয়ম–কানুন মেনে চলেন না।
“আমরা বাংলাদেশে রানা প্লাজা ধসের ঘটনা এবং কোভিড মহামারীর সময় কিছু ব্র্যান্ড ও ক্রেতার দায়িত্বহীন আচরণ দেখেছি। এসব ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠাগুলো স্বেচ্ছায় নিয়ম–কানুন মানছে না। এ জন্য সরবরাহ খাতে সুশাসন থাকা প্রয়োজন। এই বাস্তবতায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিছু অবশ্যপালনীয় আইন বা ডিউ ডিলিজেন্স ল বাস্তবায়ন করছে।”
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “দাম নিয়ে সব সময়ই আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। ক্রেতা দেশগুলোর বিভিন্ন আইনের জন্য কয়েক ধরনের অডিট পদ্ধতি মেনে চলতে হয় উৎপাদকদের। এতে বাণিজ্যের সময় ও খরচ অনেক বেড়ে যায়। অপ্রয়োজনীয় এসব অডিট পদ্ধতিকে ইউনিফায়েড করা প্রয়োজন।”
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, “কমপ্লায়েন্স মানতে আমাদের মূলত ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকেই সনদ নিতে হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য এটা বড় ধরনের ব্যবসা। আমরা সব ধরনের শর্ত মানলেও পণ্যের ন্যায্য দাম পাই না। সুতরাং সব কমপ্লায়েন্স মানার শর্ত দিলে, এই ভারী বোঝা বহনের শক্তিও আমাদের দিতে হবে। অর্থাৎ, পণ্যের ন্যায্য দাম দিতে হবে।”
কী শাস্তি?
শ্রমঅধিকার ও পরিবেশ সুরক্ষার মত বিষয়গুলোতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের তৈরি করা নিয়মগুলো না মানলে উৎপাদক, ক্রেতা ও ব্র্যান্ড— যে কাউকে বড় ধরনের জরিমানা করা হতে পারে, এমনকি নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া হতে পারে।
বার্নড স্প্যানিয়ার বলেন, ডিউ ডিলিজেন্স বাধ্যবাধকতা দুইভাবে বাস্তবায়ন করা হবে।
প্রথমত ডিউ ডিলিজেন্স অনুযায়ী মানবাধিকার ও পরিবেশ সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হলে ভুক্তভোগী যে কেউ নির্দিষ্ট কোম্পানির বিরুদ্ধে ইউরোপীয় আদালতে ক্ষতিপূরণ চাইতে পারবেন।
দ্বিতীয়ত ইইউর তদারককারী কর্তৃপক্ষগুলো নিজেরাই পর্যবেক্ষণ করবে কোনো কোম্পানি নিয়ম ভাঙছে কিনা। যথাযথভাবে নিয়ম না মানলে ইইউ কর্তৃপক্ষ নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে, যার পরিমাণ ওই কোম্পানির বৈশ্বিক টার্নওভারের ৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।