জীবনযাত্রায় বছরজুড়েই গুনতে হল চড়া দাম

নতুন বছরেও নেই স্বস্তির আভাস।

শাহরিয়ার নোবেলবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Dec 2022, 02:53 PM
Updated : 31 Dec 2022, 02:53 PM

নিত্যপণ্যের বাজারে ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধের যে ঝাপটা লেগেছিল ২০২২ সালের শুরুতে, তার রেশ কাটলো না বছর শেষেও।

এই আঁচ কখনও লেগেছে তেলে, কখনও আটা-ময়দায়, কখনও চাল-ডাল-চিনির মত প্রতিদিনের ভোগ্যপণ্যে। দ্রব্যমূল্য নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যকার বচসাও যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এরমধ্যেই বিদায় নিচ্ছে ২০২২; আর নতুন বছরে নিত্যপণ্য নিয়ে স্বস্তির পরিস্থিতি তৈরি হবে- এমন আভাসও মিলছে না।

বিক্রেতারা সবসময়ের মতই বছরের শেষে এসে বলছেন, বাজারে যখন যে দামে তাদের কাছে পণ্য সরবরাহ করা হয়ে থাকে, তখন সেই দামেই তারা বেচে থাকেন। মুনাফা তারা কিছু করছেন; তবে সেজন্য তাদেরও বেগ পেতে হচ্ছে। কেননা উচ্চমূল্যের কারণে তাদের পুঁজি খাটাতে হচ্ছে দ্বিগুণ, সেই পুঁজির জোগান দিতে করতে হচ্ছে ধার-দেনা।

অপরদিকে সীমিত আয়ের ক্রেতাদের অনেকেই বলছেন, কোনোরকমে জীবন চলছে তাদের। পকেটে যে পয়সা ঢুকছে তা নিয়ে পরিবারের চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না।

যুদ্ধের প্রভাবকে পুঁজি করে বিদায়ী বছরে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে কারসাজির ঘটনা ঘটলেও তেমন কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগও করেছেন কেউ কেউ।

শনিবার নবদম্পতি সেতু ইয়াসমিন ও ওয়াহিদ এসেছেন ঢাকার মিরপুরের শাহ আলী মার্কেটে। ভালো মানের খাসির মাংস খুঁজে দামদর করেও কিনতে পারলেন না। জানালেন, নতুন জীবন সাজিয়ে নেওয়ার বছরে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বেশ ভুগিয়েছে। সামনের বছরেও যে তা কাটবে সেটাও মনে করছেন না।

সেতু ইয়াসমিন হতাশার সুরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “প্রত্যাশা করে আর কী হবে? দাম বাড়বে এটাই জানি, আশা করি- যাই করি, কমবে না কখনও। ৩০ টাকা বেড়ে পাঁচ টাকা কমাকে কমা বলে না।“

খাসির মাংসের দোকানি আলমের কণ্ঠেও হতাশা- বললেন, “এ বছর ভালো গেল না একেবারেই। মালের (মাংস) দাম হাজার টাকা কেজি, এত দাম হলে মানুষ কীভাবে নিবে? সামনের বছরের প্রত্যাশা কিছু নেই।“

বছরের শেষদিনেও উত্তাপ টের পাওয়া গেল বাজারে। আগের মতই বাড়তি দামে বিক্রি হতে দেখা গেছে ডাল, চিনি, আটা-ময়দা। প্রতি কেজি মুগ ডাল ১৮০ টাকা, কাঁচা মুগ ডাল ১৪০ টাকা, আটা ৭২ টাকা, ময়দা ৮৫ টাকা, খোলা চিনি ১১০ টাকা, বোতলের এক লিটার সয়াবিন তেল ১৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়।

তবে শীতকালীন সবজিতে স্বস্তি ছিল বছরের শেষদিকে, কিছু কিছু সবজির ক্ষেত্রে দাম কমেছে গত কয়েকদিনে ৫ থেকে ৭ টাকা।

তবে থার্টি ফার্স্টের আয়োজনকে সামনে রেখে চাহিদা বাড়ার প্রভাব দেখা গেছে মুরগির বাজারে। নানা জাতের মুরগির দাম কেজিতে ৫-১০ টাকা বেড়েছে। অপরিবর্তিত রয়েছে গরু ও খাসির দাম। গরুর মাংস প্রতি কেজি ৭০০-৮০০ টাকা, খাসির মাংস ৯৫০-১০৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

সপ্তাহের ব্যবধানে পরিবর্তন আসেনি ডিমের দামেও। প্রতি হালি ডিম ৩৬ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

আমন ওঠা শুরু হলেও চালের দাম কিছুটা বেড়েছে। প্রতি কেজি আটাশ চাল ৫৬ টাকা, বাসমতি ৮২ টাকা, পোলাও ১৪০ টাকা, ভালো মানের মিনিকেট ৮০ ও নাজিরশাইল ৮৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

সবজি বাজারে লাউ কিনতে আসা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী হায়দার আলীর কাছে বিদায়ী বছরের বাজারদর নিয়ে মূল্যায়ন জানতে চাইলেই বললেন, ‘বিরক্তিকর’।

তার কথায়, “সবকিছুর দাম বেশি। সাধারণের নাগালে কিছুই নেই। নতুন বছরেও এগুলাই হবে, সামনে তো আরও কঠিন দিন আসছে।“

সবজি ব্যবসায়ী আব্দুর রশিদেরও বছরটা ভালো যায়নি। আলাপচারিতায় বললেন, “কাস্টমার থাকলে মাল আসে না, মাল আসলে কাস্টমার থাকে না। গত দুই-তিন বছর ধরেই এই অবস্থা। সামনে আর কী হবে, সবার যেদিকে হাল যাবে- আমারও সেদিকেই যাবে।“

বিক্রেতারাও ঋণের ফাঁদে

মিরপুরের শাহ আলী পাইকারি বাজারের মসলা বিক্রেতা মো. আসাদুজ্জামানকে জিনিসপত্রের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খাটাতে হয়েছে বাড়তি পুঁজি। সেজন্য উপায় না থাকায় ঋণ নেওয়ার কথা জানালেন তিনি।

“আমাদের যে জিনিস আগে ১০০ টাকা কেজি ছিল, তা এখন ১৫০-১৬০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। আমার পুঁজি বেশি লাগছে। কিন্তু লাভের অঙ্ক বেড়ে যায় নাই। বাড়তি পুঁজির যোগান দিতে গিয়ে আমার ঋণ হয়েছে। পরিচিতজনের কাছে, ব্যাংকের কাছ থেকে আমার দেনা করতে হয়েছে।“

একই অবস্থা পদ্মা রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী মো. শরিফুল আলমের। তার কাছেও বছরটা ছিল শুধুই হারানোর।

তিনি বলেন, “চালের বাজারের নিয়ন্ত্রণ এখন বড় বড় কোম্পানির হাতে। তারা অনেক বেশি রেটে চাল বাজারে ছাড়ে। লাভ তো হয়ই না। কখনও সমান সমান হয়। আবার কখনও লসে থাকি।

“বেশি দামে বিক্রি করলে প্রশাসন আসে, কিন্তু লসের ভাগিদার কেউ হয় না। বছর শেষে দেখা যায়, হিসাব করতে গেলে দেনাই বেশি থাকে। এইসব মেটাতে গিয়ে পরিবার, বড় ভাই, ব্যাংকের কাছে হাত পাতা লাগে। পুরা বছরটাই মন্দা গেছে।“

তার ভাষ্য, “নতুন বছরে চালের বাজারকে বড় কোম্পানির সিন্ডিকেট থেকে বের করতে না পারলে বাজারে অস্থিরতা কমবে না।“

শাহ আলী মার্কেটের পাশের এশিয়ান মার্কেটের মুদি দোকান মানিক অ্যান্ড ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারীও একই সুরে বললেন, “দাম-দর সবই বেশি। লাভের হার কমেছে। পুঁজি বেশি লেগেছে। কাস্টমারের সাথে আজকাল অনেক কথা বলতে হয়।

“তারা এসে যখন শোনে ১২০ টাকার পেস্ট ১৯০ টাকা, তখন তো তারা উত্তেজিত হয়ে যায়। নতুন বছরে আশা করি এইসব কমবে। আমরা একটু শান্তিতে ব্যবসা করতে পারব।“

কেনা কমেছে, বিক্রেতার বেড়েছে হতাশা

শুটকি ব্যবসায়ী আল-হাদিসের সঙ্গে আলাপে উঠে এল ভোক্তাদের কেনার হার কমে যাবার কথা। তার ভাষ্য, “ট্যাক্সসহ নানা কারণে শুটকির দাম বেড়েছে। পুরো বছরেই ব্যবসা মন্দা গেছে। মানুষ আগে যেখানে এক কেজি নিত, সেখানে এখন আধা কেজি নিচ্ছে।“

ব্যবসার এই অস্থিরতার ঢেউ ছাড় দেয়নি চারাগাছ ব্যবসায়ী বয়োবৃদ্ধ আবুল কালামকেও। তিনি বললেন, “বছরের শুরুটা তো ভালোই গেছিল। এখন তেমন আর কাস্টমার নাই।“

আলু-পেঁয়াজের বাজারে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী মোশতাকুর রহমানের কণ্ঠেও মিলল নাভিশ্বাসের ছাপ।

তিনি বললেন, “বছর সবার যেমন গেছে, আমারও তেমন গেছে। সাধারণ ক্রেতা এখন বাজারে এলে নাভিশ্বাস উঠে যায়, মোটের উপর কেউ ভালো নেই। মধ্যবিত্তের জন্য দিন চালানো খুবই কঠিন।

“আমরা তো আশায় বুক বাঁধি, সামনের বছর ভালো হবে, কিন্তু সেই ভালোটা তো আমাদের আর আসে না।“

মাছের বাজারে ইলিশ বিক্রি করেন হীরা লাল। তারও বেচাকেনা কম। বললেন, “যেভাবে বছর গেছে, সামনের বছরও যদি এভাবে চলে- তাহলে তো আমাদের পরিস্থিতি ভালো যাবে না।“

এ বাজারের ক্রেতা বেসরকারি চাকরিজীবী এস এম মহসিন বলছিলেন, “বাজারের যা অবস্থা গেছে, তাতে ৬০ শতাংশ মানুষের কেনার ক্ষমতা থাকলেও ৪০ শতাংশ মানুষেরই তা নেই।“

ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা যে বেশ কমেছে তা স্পষ্ট বিক্রেতাদের কথাতেও। তেলাপিয়া, নলা, বাটা মাছ বিক্রেতা স্বপনের কথায়, “বছরটা ভালো শুরু হয়েও পরে খুব খারাপ গেল। আমি যে মাছ বেচি- তার বিক্রেতা সব গরিব মানুষ। এখন আর কেউ বেশি কিনে না। কেউ কেউ পুরা এক কেজি না কিইনা পিস কিনে।“

বাজারে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই অভিযোগ করে মুদি দোকানি আব্দুল খালেক বললেন, “সব জায়গায় সিন্ডিকেট। হুট করে দাম বেড়ে যায়।

“যে পোলাও চাল ৯৫ টাকা ছিল, আজকে বছরের শেষদিনে তা ১৪২ টাকা। এভাবে দাম বাড়লে ক্রেতারা অনেক রাগারাগি করে।“

বছর ভালো যায়নি পান-সুপারি দোকানি মো. আলমগীর কিংবা দেশ ফল বিক্রেতা মো. ইউনুছ আলীরও। ইউনুছের ভাষায়, “বছরটা জোয়ার ভাটার মত কেটে গেছে।“

বিদায়ী বছরে বাজারের দাম নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করলেন চিকিৎসক ফরহাদ হোসেনও। ছেলেকে নিয়ে এসে বড় একটি দেশি পাঙ্গাস কিনে বললেন, “দামদর আর সাধ্যের মধ্যে নেই।”

‘রাজনৈতিক অস্থিরতা যেন না থাকে’

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতির মাঠ যেন অস্থির না হয়ে ওঠে, সেই প্রত্যাশার কথা জানালেন বিক্রেতারা।

পেঁয়াজের আড়তদার সেলিম আহম্মেদ বলেন, “গেল বছর তো ভালো গেল না। শুধু পেঁয়াজ না সব ব্যবসাই খারাপ গেছে। সামনে বছরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো থাকলে আশা করি ব্যবসা ভাল হবে।

“করোনার পর যুদ্ধ, এটা-সেটার জন্য এ বছরেও ব্যবসা করা গেল না, সামনে বছর আবার রাজনৈতিক কারণে নষ্ট হলে ব্যবসায়ীদের পথে বসতে হবে।“

একান্নবর্তী পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য আমেনা বেগম বললেন, “দেশের ক্ষমতায় যেই আসুক, সবাইকে নিয়েই দেশ ঠিক করে চালাতে হবে। শুধু সরকার বা ব্যবসায়ী না, সাধারণ মানুষ যারা আছি- তাদেরও দেশ ভালো যেন থাকে, সেজন্য কাজ করতে হবে। তাহলেই সব ঠিকঠাক চলবে।“