অন্য দেশগুলোতে যেখানে সুপার শপে পণ্য মেলে কম দামে, সেখানে বাংলাদেশে বেশি দামে কিনতে হয়।
Published : 11 Sep 2022, 12:59 AM
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুদি দোকানের চেয়ে সুপার শপ বা চেইন শপে কম দামে পণ্য মিললেও দেশে ‘ভালো মানের নামে’ উল্টো বাড়তি টাকা গুণতে হচ্ছে ক্রেতাদের।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বলছে, সুপার শপগুলোর ‘অতিমুনাফার’ কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে খোলা বাজারেও। বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে ‘হস্তক্ষেপ’ করা হবে বলেও জানিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি।
সম্প্রতি বিভিন্ন সুপার শপের বিপণন কেন্দ্র পরিদর্শন করে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যে ১৮ থেকে ২৯ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফার নজির পান।
অন্যদিকে সাধারণ দোকানে মোড়কে লেখা দামের চেয়ে কিছু কম রাখতে পারেন দোকানি। কিন্তু সুপার শপে একই কোম্পানির পণ্য সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যেই বিক্রি হয়। তার উপর যোগ হয় মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট।
দেশের সুপার শপগুলোতে ‘নানা কৌশলে’ পণ্যের মূল্য ‘বাড়িয়ে দেওয়া’ নিয়ে সম্প্রতি শুরু হয়েছে আলোচনা।
এ ধরনের বিপণিগুলোয় অতিরিক্ত মূল্যের পেছনে মধ্যস্বত্বভোগী বা ‘ভেন্ডরদের’ ভূমিকার কথা বলছেন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- ক্যাবের অনলাইন সাময়িকী ভোক্তা কণ্ঠের সম্পাদক কাজী আব্দুল হান্নান।
তিনি বলেন, পাইকারি বাজার থেকে সরাসরি না কিনে সুপার শপগুলো ‘ভেন্ডরদের’ হাতে পণ্য সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়ায় তারাও একটি মুনাফা করছে, যার বোঝা চাপছে ক্রেতার ঘাড়ে।
হান্নান বলেন, “সাধারণত খাদ্যপণ্যে সরকারের নীতি হচ্ছে উৎপাদক, ফড়িয়া, পাইকারি বিক্রেতা হয়ে খুচরা বিক্রেতার হাতে আসবে। কিন্তু এরা এখানে আরেকটা স্তর বাড়িয়ে দিল ভেন্ডর নামে। ফলে তাদের পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে।
“তারা নিজেরাই যদি পাইকারি বাজার থেকে পণ্য কিনে আনত, তাহলে ভেন্ডরকেন্দ্রিক খরচটা কমে যেত।”
তিনি বলেন, “বিদেশে সুপার শপে সাধারণত ট্র্যাডিশনাল দোকান থেকে দাম কম থাকে। কারণ ওগুলো থাকে চেইন শপ। একই কোম্পানির অনেক আউটলেট থাকে।
“তারা পাইকারি দরে প্রচুর পণ্য কেনে। ফলে সাধারণ দোকানিদের চেয়ে কম দামে নিতে পারে। পরিবহন ব্যয়, পরিচালন ব্যয় এগুলো কম হয়।”
বিভিন্ন দেশে সুপার শপে দাম কেমন?
প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন শহরে সুপার শপগুলোতে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের (এমআরপি) চেয়েও পণ্যভেদে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যছাড়ে পণ্য কিনতে পারেন ভোক্তারা।
ভারতের বেঙ্গালুরু শহরে গত ১৪ বছর ধরে বসবাস করছেন রাজা সিংহ। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, শহরে মোর, স্পার, রিলায়েন্স, লুলু মার্টসহ বেশ কিছু সুপার শপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
“প্রতিযোগিতার বাজারে এখানে ক্রেতা আকর্ষণ করার জন্য মূল্যহ্রাসের প্রতিযোগিতা চলে।”
একটি সুপার স্টোরের লিফলেট হাতে নিয়ে এর মূল্য তালিকা তুলে ধরে তিনি জানান, দাওয়াত বিরিয়ানি ব্র্যান্ডের বাসমতি চালের প্যাকেটের গায়ে দাম লেখা ২২০ রুপি; কিন্তু বিক্রি হবে ১৭৫ রুপিতে।
ট্রপিকানা জুসে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের (এমআরপি) চেয়ে ২০ শতাংশ ছাড় রয়েছে। একইভাবে বুলেট রাইস ৫ কেজির এমআরপি ৯৫০ রুপি হলেও বিক্রি করছে ৭০০ রুপিতে। আশির্বাদ আটা ১০ কেজির প্যাকেট ৫৫২ রুপি; কিন্তু বিক্রি হবে ৪৩৯ রুপিতে।
কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এখানে ব্যবসা, বেচাবিক্রি অনেক বেশি প্রতিযোগিতামূলক হয়ে গেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এদেশে অনেক অ্যাপভিত্তিক সুপার শপ হয়ে গেছে। সেখানে সুপার শপের প্রায় সব ধরনের পণ্যই পাওয়া যায়।
“অর্ডার করার ১৫/২০ মিনিটের মধ্যে পণ্য বাসায় চলে আসে। তাদের যেহেতু প্রদর্শনী কেন্দ্রের খরচ নেই, তাই তারা অনেক কম দামে পণ্য দিতে পারে। এই জেট্রো, বিগ বাসের মতো এমন অনেক কোম্পানি গড়ে উঠেছে এখানে।”
কম দামে পণ্য বিক্রির আরও কিছু উদাহরণ দিয়ে রাজ সিংহ জানান, হেড অ্যান্ড শোল্ডার্স শ্যাম্পুর এমআরপি ৪৫০ রুপি থাকলেও সুপার শপগুলো তা দিয়ে দিচ্ছে ২৫০ রুপিতে।
“এধরনের প্রসাধনী পণ্যে রয়েছে বাই ওয়ান গেটওয়ান ফ্রির প্রচুর অফার। তারা কিন্তু লোকসানে বিক্রি করছে না। নিশ্চয় সামান্য হলেও লাভ করছে,”- বলেন তিনি।
একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন গবেষণার কাজে তিন বছর ধরে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দিদার ইসলাম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ব্রিটেনে এখন ব্যাপক মূল্যস্ফীতি চলছে। সেখানোর লিডস শহরে টেসকো, মরিসন ছাড়াও এধরনের বিভিন্ন নামের সুপার শপগুলো বেশ জনপ্রিয়।
“সাধারণ মুদি দোকানগুলোর তুলনায় এখানে সুপার শপগুলোতে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে পণ্য পাওয়া যায়। লোকজন প্রয়োজনীয় বাজার সুপারশপ থেকেই কেনে। কালেভাদ্রে পাড়ার মুদি দোকানে যায়,” বলেন দিদার।
তিনি জানান, এক লিটার সানফ্লাওয়ার অয়েলের খুচরা মূল্য ৫ পাউন্ড হলেও সুপার শপে তা আড়াই পাউন্ডেই পাওয়া যাচ্ছে। ৫ কেজি চালের প্যাকেটে সুপার শপ থেকে বাইরের দোকানে আধা পাউন্ড পার্থক্য থাকে সব সময়।
“যেই শপ যত বড় সেখানে দাম তত কম। এছাড়া সুপার শপে কেনাকাটায় বোনাস পয়েন্ট, ভাউচারসহ বিভিন্ন রকম প্রতিযোগিতামূলক অফার আছে। রয়েছে মেম্বারশিপ কার্ড, যা দাম কমাতে সহায়তা করে।”
ইউরোপের আরেক দেশ জার্মানিতেও সুপার শপগুলো ভোক্তাকে বাজারের চেয়ে কম দামে পণ্য দিচ্ছে বলে জানান জার্মানির বন শহরে অবস্থানরত বাংলাদেশি মারুফ মল্লিক।
তিনি বলেন, “তবে জার্মানিতে প্রচলিত দোকানের চেয়েও কম দামে পণ্য বিক্রি হওয়া সুপার শপ রয়েছে। আবার কিছু কিছু সুপার শপে দাম তুলনামূলক বেশি। সেটা তাদের পরিচালন ব্যয়ের কারণে।
“কিন্তু বিষয় হচ্ছে এখানে এমন মেকানিজম করা আছে, যাতে কেউ চাইলেও অতিমুনাফা করতে পারবে না।
ঢাকার একটি সুপার শপ
গত অগাস্টে বাজার তদারকি চালিয়ে গুলশানের একটি সুপরিচিত সুপার শপের বিপণন হওয়া পণ্যগুলোর একটি মূল্যতালিকা প্রকাশ করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
সেখানে দেখা যায়, কাজী ফার্মের এক ডজন ডিম ১৩৬ টাকায় কিনে ১৫৫ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে, যাতে লাভ হয়েছে ১৮ শতাংশ। প্যারাগন কোম্পানির ব্রাউন ডিম ১৬২ টাকায় কিনে ১৮৫ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে, মুনাফা থাকছে ২২ শতাংশ।
খোলা ডিম প্রতিটি ৯ টাকা ১৮ পয়সায় কিনে ৯ শতাংশ লাভে ১০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। ঢাকার বাজারে ডিমের নিয়মিত দাম প্রতিটি ১০ টাকা থেকে ৯ টাকার মধ্যে।
এমন মুনাফার বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সফিকুজ্জামান বলেন, “আপনারা বিজনেস করবেন, প্রফিট করবেন সেটা ঠিক আছে। কিন্তু ২০ শতাংশ মুনাফা মেনে নেওয়া যায় না।
“২০ শতাংশ বা ৩০ শতাংশ মুনাফা করাটা আমার দৃষ্টিতে অত্যধিক। এটার নেতিবাচক প্রভাব হচ্ছে- এর প্রভাবে সাধারণ বাজারে এর প্রভাব পড়ে।
“এসব বিবেচনায় আমরা সুপার শপের মুনাফা প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করব। খোলা ডিমে ৯ শতাংশ আবার প্যাকেট ডিমে আপনারা ২০ শতাংশ মুনাফা করছেন।”
গুলশানের ওই সুপার শপে চাষী ব্র্যান্ডের চিনিগুঁড়া চালের ৫ কেজির প্যাকেট ৫৩৩ টাকায় কিনে ২২ শতাংশ লাভে ৬৫০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। আড়ংয়ের প্যাকেট বিক্রি করা হচ্ছে ৫৭১ টাকা থেকে ২১ শতাংশ বাড়িয়ে ৬৯০ টাকায়।
ঢাকায় চড়া মূল্যের সময়ে মিনিকেট চালের কেজি যখন ৭০ টাকা, তখন সুপারশপগুলোতে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নাম দিয়ে এ ধরনের সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা থেকে ৮৫ টাকায়।
এসিআই আয়োডিনযুক্ত লবণ প্রতি কেজি ৩০ টাকায় কিনে ২৫ শতাংশ লাভে ৩৮ টাকা। ফ্রেশ ব্র্যান্ডের লবণ ২৯ টাকায় কিনে ২৮ শতাংশ মুনাফায় ৩৮ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।
পাড়ার মুদি দোকানেও প্যাকেট লবণের কেজি ৩৮ টাকা। আবার বড় আকারের পাইকারি মুদি দোকানে প্যাকেট লবণ বিক্রি হয় ৩৫ টাকায়। মুদি দোকানে এ ধরনের লবণ বিক্রি করে লাভ হয় সর্বোচ্চ ৫ টাকা।
বাংলাদেশের সুপার শপগুলোর অতিমুনাফার ব্যাখ্যা দিয়ে ভোক্তা কণ্ঠের সম্পাদক কাজী আব্দুল হান্নান বলেন, “তাদের প্রধান কৌশল হচ্ছে বাজারকে ম্যানিপুলেট করে ফেলা এবং মিথ্যা ঘোষণা বা মিস ডিকলারেশন।
“মিলার যেখানে প্যাকেজিং করার কথা সেখানে আরেকটি কোম্পানি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। তারা মিল থেকে চাল কিনে নিজেদের নামে প্যাকেজিং করছে। চালের বিভিন্ন নাম দিয়ে নতুন নতুন মূল্য বসাচ্ছে। এভাবে নতুন নতুন ভ্যালু যুক্ত করা হচ্ছে।”
কী বলছে সুপার শপগুলো?
পণ্যের বাড়তি দামের বিষয়ে আগোরার বিজনেস অ্যান্ড করপোরেট অ্যাফেয়ার্স বিভাগের প্রধান আব্দুস সবুর খান দাবি করেন, তারা সরকারের নির্দেশনা মেনেই ব্যবসা করছেন।
“প্যাকেটের গায়ে যে এমআরপি লেখা থাকে, এর বেশি আমরা নিচ্ছি না। আমরা সব সময় সরকারের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মূল্যতালিকা মেনে চলতে চেষ্টা করি। তবুও সরবরাহ সংকট দেখা দিলে অনেক সময় পণ্যের দাম বেড়ে যায়।”
সুপার শপ স্বপ্নের করপোরেট অ্যাফেয়ার্স বিভাগের কর্মকর্তা তামিম খান বলেন, উৎপাদনকারী ও প্যাকেটজাতকারী কোম্পানি মূল্য নির্ধারণ করে। সেক্ষেত্রে আমাদের কোম্পানির খরচগুলো বিবেচনায় নিয়ে তারা মার্জিন ঠিক করে।
“কিন্তু আমাদের পক্ষ থেকে তাদের কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয় না। তিন ধরনের খরচ, ফিক্সড কস্ট, প্রামোশনাল কস্ট ও ভেরিয়েবল কস্ট বিবেচনায় নিয়ে তারা এমআরপি ঠিক করে। এমআরপির বেশি মূল্য আমরা রাখি না।
“আমরা সবাইকে মান সম্মত পণ্য দেওয়ার চেষ্টা করি। যেই পণ্য নিয়ে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয় সেই পণ্যে আমরা ছাড় দেওয়ার চেষ্টা করি। চাহিদা আছে বিধায় পণ্যগুলো বিক্রি হচ্ছে। কেনা না কেনা সেটা কাস্টমারের ব্যাপার।”
অবশ্য তাদের এসব দাবি নাকচ করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সফিকুজ্জামান বলেন, “সুপার শপগুলো কোম্পানিকে এমআরপি কত লিখতে হবে সেটা বলে দিচ্ছে। সুতরাং মূল্যবৃদ্ধির এই দায়টা সম্পূর্ণ তাদের।
“চিনিগুঁড়া চাল প্রতিকেজি কারখানায় ১০৫ টাকা হলে খুচরায় সেটা ১১০ টাকা পর্যন্ত উঠতে পারে। আর সুপার শপ সেটাকে প্যাকেট করার নামে এমআরপি লিখে ১৩৫ টাকা। অথচ প্যাকেটের জন্য তাদের হয়তো ২ টাকা খরচ হতে পারে।
সাধারণ বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “সুপার শপের এভাবে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব সরাসরি বাজারে পড়ে যাচ্ছে। খোলা বাজারের পণ্যগুলোও সুপার শপের রেফারেন্সে দাম বেড়ে যাচ্ছে।”
সুপার শপে উচ্চমূল্যের চাল সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমরা খোঁজ পেয়েছি চালগুলো একই উৎস থেকে আসলেও প্রিমিয়াম কোয়ালিটি, সুপার প্রিমিয়াম কোয়ালিটি নাম দিয়ে আপনারা দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
“এবিষয়ে ভোক্তাদেরও সচেতনতার অভাব আছে। তারা মনে করে বেশি দাম দিয়ে কিনলেই মনে হয় ভালো জিনিস কিনলাম। এই ধারণাকে পুঁজি করে আপনারা দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন।”
কিছু কিছু ব্র্যান্ড কেবল সুপার শপেই পাওয়া যায় উল্লেখ করে সফিকুজ্জামান বলেন, “এর মানে কী? সুপার শপে বেশি দামে বিক্রি করার জন্যই এগুলো প্যাকেজিং করা হয়েছে। এটাও এক ধরনের মনোপলি আচরণ।”
আরও পড়ুন: