বিভিন্ন ব্র্যান্ডের স্বত্বাধিকারী ও ডিজাইনারা বলছেন, তরুণদের কথা চিন্তা করে এবার বেশিরভাগ পোশাকে আধুনিক কাট ও মিনিমাল নকশা করা হয়েছে। এছাড়া থিমভিত্তিক পোশাকও এবারের ঈদের অন্যতম আকর্ষণ।
Published : 21 Mar 2024, 08:33 AM
তামান্না আফরিন ঈদের পোশাক কিনতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলোতে। প্রতিটি শোরুমেই ক্রেতাদের ভিড় থাকলেও ক্লান্তি বা বিরক্তি নেই তার চোখেমুখে।
ঈদের দিনের জন্য দেশীয় ব্র্যান্ডের শাড়ি ও সালোয়ার কামিজ পছন্দ তামান্নার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী মনে করেন, ভারতীয় বা অন্য দেশের পোশাকের ট্রেন্ড থাকে অল্প কিছু দিন।
“অনেক বছর ধরেই ঈদে দেশীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ডের পোশাক কিনছি। দেশীয় নকশাবিদদের ডিজাইন করা পোশাকই ভালো লাগে। হঠাৎ ট্রেন্ডে আসা কাপড় বেশিদিন পরা যায় না। কিন্তু দেশীয় পোশাকের নকশা, কাটিং, রঙ সবই দীর্ঘমেয়াদি ফ্যাশনের কথা মাথায় রেখে করা হয়। ঈদ পোশাকে আধুনিক ডিজাইন ও ভিন্নধর্মী থিমের ব্যবহার ভালো লাগে।”
তামান্নার মত ব্যাংক কর্মকর্তা জুঁই আক্তারও ঈদে প্রিয়জনের জন্য দেশি ব্র্যান্ডের পোশাক পছন্দ করেন। নিজের জামা ও শাড়ি, বাবার পাঞ্জাবি, শাশুড়ির জন্য শাড়ি, বাচ্চাদের পোশাক সবই দেশীয় ব্র্যান্ডের চাই তার। এমনকি তার পরিবারের সবারই পছন্দ আরামদায়ক ও দেশে তৈরি পোশাক।
“আড়ং ছাড়াও দেশে এখন বহু ব্র্যান্ড তৈরি হয়েছে। যারা সাধারণ মানুষের পছন্দকে প্রাধান্য দিয়েই পোশাক ডিজাইন করে। আবার সালোয়ার কামিজ, শাড়ি, পাঞ্জাবির মত ট্র্যাডিশনাল পোশাকের পাশাপাশি পশ্চিমা ধাঁচের পোশাকও পাওয়া যায় বড় ব্র্যান্ডগুলোর শোরুমে,” বলেন জুঁই।
ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, বসুন্ধরা সিটি শপিং মলে দেশীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর প্রতিটি শোরুমই সেজেছে নারী, পুরুষ আর শিশুদের পোশাকে। ঈদ উপলক্ষে আধুনিক ও স্বতন্ত্র নকশার পোশাকের পসরা নিয়ে এসেছে প্রতিটি ফ্যাশন ব্র্যান্ড।
বিভিন্ন ব্র্যান্ডের স্বত্বাধিকারী ও ডিজাইনারা বলছেন, তরুণদের কথা চিন্তা করে এবার বেশিরভাগ পোশাকে আধুনিক কাট ও মিনিমাল নকশা করা হয়েছে। এছাড়া থিমভিত্তিক পোশাকও এবারের ঈদের অন্যতম আকর্ষণ।
দেশীয় জনপ্রিয় ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে অন্যতম পুরনো ব্র্যান্ড আড়ং প্রতিবারের মত এবারও দুই ধরনের পোশাক এনেছে, যার একটি রেগুলার ও অন্যটি এক্সক্লুসিভ।
দেশীয় সিল্ক, মসলিনের মতো দামি ফেব্রিকের সালোয়ার-কামিজ, শাড়ি, পাঞ্জাবি সবই রয়েছে এই কালেকশনে। ঈদে এক্সক্লুসিভ কালেকশনের অন্যতম আকর্ষণ হাতের সূচিকর্ম।
ঈদের জন্য করা এই কালেকশনে মেয়েদের সালোয়ার কামিজে আধুনিকতার ছোঁয়া আনতে লেয়ারিং ডিজাইনকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। আর পোশাকে ভিন্নধর্মী রঙের মিশেলও রেখেছে আড়ং।
পরিচিত রঙ বাদেও ওশান ব্লু, বেগুনি, ফিরোজা, ম্যাজেন্টা, ল্যাভেন্ডার, টিল, প্লাম, মিন্ট গ্রিন, ডাস্টি পিংক, আইভরি, অলিভ, পিকক ব্লু, পিচ, প্যাস্টালের মতো ভিন্নধর্মী রঙগুলো শাড়ি ও মেয়েদের পোশাকে বেশি ব্যবহার হয়েছে।
ছেলেদের পাঞ্জাবিতেও হালকা রঙ এবং বয়সভিত্তিক ডিজাইনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। গরম ও আধুনিক মিনিমাল থিমকে প্রাধান্য দিয়ে তরুণদের জন্য খুব হালকা নকশার পাঞ্জাবি ডিজাইন করা হয়েছে। অনেক পাঞ্জাবিতে শেডের ব্যবহার হয়েছে।
প্রতিবারের মতো এবারও দেশি ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘রঙ বাংলাদেশ’ থিমভিত্তিক পোশাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।
‘রঙ বাংলাদেশের’ প্রধান নির্বাহী সৌমিক দাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবারে ঈদের পোশাক ডিজাইন করা হয়েছে ‘ক্লাসিক্যাল ফোর এলিমেন্টস’ থিমে।
প্রতিষ্ঠানটির শোরুম ঘুরে দেখা গেছে, ঈদের পোশাকে মাটি, আগুন, পানি ও বাতাসের বিভিন্ন রূপ ও বৈচিত্র্যের মিশ্রণ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সব ধরনের পোশাকের নকশায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় আবহকে। আর পোশাকে আধুনিকতা ধরে রাখতে বেশকিছু আন্তর্জাতিক ট্রেন্ডও অনুসরণ করা হয়েছে।
ঈদে বাড়বে গরম, তাই পোশাকে তৈরিতে হালকা ওজন ও বাতাস চলাচল করতে পারে এমন ফেব্রিক বেশি ব্যবহার হয়েছে। কটন, স্লাব কটন, জ্যাকার্ড কটন, লিনেন, হাফসিল্ক, জর্জেট, ভিসকস, বারফির মতো কাপড় দিয়ে ঈদ পোশাকগুলো ডিজাইন করা হয়েছে। আর পোশাকের মূল রঙ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে মেরুন, নীল, ফিরোজা, আকাশী, খয়েরি, লাল, হালকা কমলা, কফি ও গাঢ়ো সবুজকে।
ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘টুয়েলভ ক্লোদিংয়ে’ কথা হয় শিউলি আক্তারের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ঈদের জন্য তিনি খুব ছিমছাম ও হালকা ডিজাইনের পোশাক কিনবেন। মোহাম্মদপুরের রিং রোডে অবস্থিত ‘টুয়েলভ ক্লোদিংয়ের’ স্টোরটি ঘুরে তিনি পেয়েও গেলেন তার পছন্দের পোশাক।
এই ব্র্যান্ডটির ঈদ সংগ্রহ নিয়ে তিনি বললেন, “পোশাকে প্রিন্ট, এমব্রয়ডারি ও কারচুপি, স্ক্রিনপ্রিন্ট ও ডিজিটাল প্রিন্টের ব্যবহার বেশি। ফলে পোশাক ভারি লাগে না আর পরেও আরাম।”
একই ব্র্যান্ডের ছেলেদের বিভাগে কেনাকাটা করতে এসেছেন শামীম হোসেন। ছেলেদের জন্য টু-পিসের কম্বো সেট আর থ্রি-পিসের ফুল সেট ডিজাইন করেছে ‘টুয়েলভ ক্লোদিং’। যেখানে আছে পাঞ্জাবি, পায়জামা ও কোটি। এ ছাড়া রয়েছে মেনস ও কাবলি কালেশন।
পেশায় ব্যবসায়ী শামীম শোরুম ঘুরে ঈদের দিনের সকালের জন্য কিনলেন টু পিস কম্বো সেট থেকে পাঞ্জাবি ও পায়জামা। আর মেনস কালেকশন থেকে প্যান্ট ও সুতি শার্ট।
টুয়েলভ ক্লোদিংয়ে ঈদ সংগ্রহের নাম ‘রয়্যাল ডেলিকেসি’। পোশাকে রাজকীয়তা ও আধুনিক স্টাইল দুটোরই মিশেল রাখা হয়েছে। মেয়েদের জন্য কো-অর্ড সেট, থ্রি-পিস সেট, এথনিক গাউন, টু-পিস সেট, এথনিক টপ ও ফিউশন কুর্তি দিয়ে সাজানো হয়েছে তাদের ঈদ আয়োজন।
‘সারা লাইফস্টাইলের’ এবারের ঈদ পোশাকের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে স্ক্রিন প্রিন্ট, ডিজিটাল প্রিন্ট, ম্যানুয়াল এমব্রয়ডারি, মেশিন এমব্রয়ডারি, কারচুপি, ট্র্যাডিশনাল হ্যান্ড এমব্রয়ডারি, টাই-ডাইয়ের মতো মাধ্যম। আর মোটিফ হিসেবে ফুটিয়ে তোলা উঠেছে স্থাপত্যশৈলীর সৌন্দর্য।
ব্র্যান্ডটির প্রধান ডিজাইনার শামীম রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঈদের পোশাকে এ লাইন, সিমেট্রিক, এসিমেট্রিক প্যাটার্ন থাকছে। আর তরুণদের পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে ভাইব্রেন্ট রঙগুলো বেশি ব্যবহার হয়েছে। তবে গরম বাড়তে পারে বলে রয়েছে হালকা রঙের পোশাকও।”
বরাবরের মতো এবারও দেশীয় ঘরানার পোশাকে সাজানো হয়েছে ‘দেশালের’ ঈদ আয়োজন।
এই ব্র্যান্ডের শোরুম ঘুরে দেখা গেছে ঈদের বেশিরভাগ পোশাক ডিজাইন করা হয়েছে সুতি কাপড়ে। হাতের কাজ, ব্লক, এমব্রয়ডারি, বিভিন্ন ধরনের প্রিন্টের ব্যবহারে পোশাকে আনা হয়েছে ভিন্নতা। পরিবারের সবার জন্য চাইলেই যেন এক শোরুম থেকে কেনাকাটা করা যায় তাই বয়স বুঝে পোশাক ডিজাইন করেছেন ‘দেশালের’ নকশাবিদরা।
ঈদ আয়োজনে তরুণীদের জন্য রয়েছে কাফতান কাটিংয়ের কো-অর্ড সেট, স্কার্ট, ফ্লেয়ার ড্রেস। এ বছর এক রঙা ও গলায় হাতের সেলাই করা চিকন বর্ডারের পাঞ্জাবি বেশ ট্রেন্ডি। ‘দেশালের’ পাঞ্জাবি কালেকশনের একটি বড় অংশ এই স্টাইলেই ডিজাইন করা হয়েছে।
স্লো ও পরিবেশবান্ধব ফ্যাশন নিয়ে কাজ করে ‘ফ্রেন্ডশিপ কালারস অব চারস’। কয়েক বছর আগে যাত্রা করা ফ্যাশনহাউজটি তরুণ ও মাঝ বয়সীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ঈদ সংগ্রহে সুতি ও সিল্ক কাপড়ের শাড়ি, পাঞ্জাবি এবং এক্সক্লুসিভ জামদানি এনেছে ব্র্যান্ডটি।
সুতি, খাদি, অ্যান্ডি কটন কাপড়ে তৈরি শাড়ি ও পাঞ্জাবিতে সাজানো হয়েছে ‘খুঁতের’ ঈদ আয়োজন। কাতান মোটিফ ও পাট রংয়ের শেড সুতার সুতির শাড়ি ঈদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করেছে ‘খুঁত’।
এছাড়া লা রিভ, ক্লাব হাউজ, ওটু, কিউরিয়াস, নয়ের ক্লোদিং, রাইজ, অঞ্জন’স, বিশ্ব রঙ, কে ক্রাফট, বিবিয়ানা, সাদাকালো, ইনফিনিটি, ইয়ালো, সেইলর, তানজিমের মতো নামিদামি ব্র্যান্ডগুলো ঘুরে দেখা গেছে ঈদ আয়োজনে প্রাধান্য পেয়েছে থিমনির্ভর হালকা নকশা, আধুনিক কাটিং ও আরামদায়ক সুতি, ভিসকস, সিল্ক ফেব্রিক।