গতবারের মতো চামড়ার দর না পড়ায় খুশি মৌসুমি ব্যবসায়ী ও মাদ্রাসা শিক্ষকরা।
Published : 30 Jun 2023, 11:43 PM
ঢাকা ও আশপাশে কোরবানির পর মাদ্রাসা-মক্তব বা মৌসুমী ফঁড়িয়ার হাতে যে কাঁচা চামড়া গিয়েছিল, তার বেশির ভাগই এখন লালবাগের পোস্তার আড়তে।
কম দাম নিয়ে গতবারের মতো অভিযোগ না থাকায় এবার বিপুল পরিমাণ চামড়া প্রবেশ করেছে কাঁচা চামড়ার এই বৃহৎ আড়তে।
ঈদের প্রথম দিন বৃহস্পতিবার রাতে পোস্তার ব্যবসায়ীরা সর্বোচ্চ এক হাজার ২০০ টাকায় চামড়া কিনেছেন।
কম দামের কারণে আগেরবার সরবরাহ কমে গিয়েছিল, সেই পরিস্থিতিতে শেষ রাতে তখন দর উঠেছিল সর্বোচ্চ ১৩৫০ টাকায়।
এবার খুচরা পর্যায়ে ঢাকার গুলশান, বাড্ডা, বনশ্রী, মালিবাগ, যাত্রাবাড়ী, ধানমণ্ডি, সেন্ট্রাল রোড এলাকায় প্রতিটি চামড়া ৭০০ থেকে ১০৫০ টাকায় কিনেছিলেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
আড়তদাররা জানিয়েছেন, ঈদের প্রথম দিন ও পরদিন শুক্রবার মিলিয়ে তারা আড়াই লাখের বেশি চামড়া সংগ্রহ করেছেন, আগেরবার যেখানে এই সংখ্যা ছিল ৭৫ হাজারে।
আগেরবারের ধারণায় এবার কাঁচা চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য ঠিক করে লবণ সংগ্রহ করেছিলেন তারা। তবে চামড়াবাহী ট্রাক বেশি প্রবেশ করায় শেষের দিকে মজুত লবণ ফুরিয়ে যায় আড়তে আড়তে।
চামড়া সংরক্ষণের কাজে শ্রমিক সংকটও দেখা দেয়। চামড়া প্রতি লবণ মেশানোর মজুরি সন্ধ্যায় যেখানে ছিল ৪০-৫০ টাকা, রাত ১২ টার পর তা ধীরে ধীরে বেড়ে গিয়ে ওঠে ১০০ টাকায়।
তার পরও চাহিদার বিপরীতে শ্রমিক না মেলায় অনেক আড়তদার আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতদের সহযোগিতা নিতে বাধ্য হন।
পোস্তায় চামড়ার গাড়ির সারি দেখে অর্ধযুগ আগে হারানো ‘জৌলুস’ ফেরার ইঙ্গিত দেখতে পাওয়ার কথা জানাচ্ছেন আড়তদাররা।
সেখানকার আনোয়ারুল ওহাব অ্যান্ড ব্রাদার্সের পরিচালক তারিক ইবনে আনোয়ার পান্না বলছিলেন, “চামড়া এতো বেশি আসছে যে পুরনো দিনের কথা মনে করাইয়া দিল। মনে হয় পোস্তা আগের জায়গায় যাইতে পারে, লবণ শ্যাষ হওনে অনেক চামড়া ফেরত দিছি।
“৫০ টাকা প্রতি পিস লবণ মাখানোর শ্রমিক ১০০ টাকা দিয়েও পাইনি।’’
বাংলাদেশে পশুর চামড়ার যে চাহিদা, তার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই পূরণ হয় কোরবানির পশু থেকে। ২০১৬ সালেও এই মৌসুমে কোরবানির প্রথম দিন সন্ধ্যা থেকে চামড়ার গাড়ি ভিড় করতো পোস্তায়, সারি চলে যেত পলাশী পর্যন্ত।
পরের দিন সূর্যের আলো ফোঁটার পর থেকে কমতে শুরু করতো লালবাগ এলাকার আশাপাশের সড়কে গাড়ির জট। এলাকায় গাড়ি ঠাসা থাকায় মানুষ চলাচল করতো কেবল হেঁটে। প্রয়োজন ছাড়া বাসিন্দারা ঘর থেকে বের হতেন না।
সাভারে ট্যানারি সরিয়ে নেওয়ার পর জৌলুস হারাতে বসে পোস্তার আড়ত, বছর ঘুরলেই কমছে ব্যবসার পরিধি।
বিপুল চামড়া সংগ্রহ
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সারা দেশে এবার মোট ১ কোটি ৪১ হাজার ৮১২ টি গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে, যেখানে চাহিদা ধরা হয়েছিল হয়েছিল ১ কোটি ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৭৩৯টি।
সরকারি হিসাবে গত বছর পশু কোরবানি হয়েছিল ৯৯ লাখ, আর চাহিদা ছিলো এক কোটি ২১ লাখ।
পোস্তায় চারটি আড়ত আছে সারওয়ার্দী অ্যান্ড ব্রাদার্সের। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন বলেন, “প্রতিটিতে চার হাজারের বেশি চামড়া সংরক্ষণ করতে পেরেছি। লবণ শেষ হওয়ায় আরও বেশি চামড়া রাখতে পারিনি।”
ঈদের দ্বিতীয় দিন মিলিয়ে এবার বিপুল সংখ্যক চামড়া পোস্তায় এসেছে জানিয়ে পোস্তায় ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আফতাব খান বলেন, ‘‘শুধু পোস্তায় না, জায়গা না থাকায় অনেকেই চামড়ায় লবণ মাখিয়ে নদীর ওপারে কেরাণীগঞ্জ, জাজিরা, নারায়ণগঞ্জে সংরক্ষণ করেছেন।’’
লক্ষ্যের বেশি চামড়া সংরক্ষণ হওয়ায় শনিবার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসলে চামড়ার প্রকৃত মজুত সম্পর্কে জানা যাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
লবণের বাড়তি দর
লবণ উৎপাদনে ব্যবহৃত পলিথিন ও পানি সেচের ডিজেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে পরিবহন খরচ বাড়ায় এবার শিল্প লবণের দামও বেড়েছে।
গতবার ৭৪ কেজি ওজনের লবণের বাস্তার দাম ছিল এক হাজার থেকে ১০৫০ টাকা; এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৩০০ টাকায়।
লবণের দাম বৃদ্ধির কারণ ব্যাখ্যায় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশেনের (বিসিক) লবণ সেলের প্রধান সরোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টেয়োন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘গতবারের চেয়ে এবার চার লাখ টন বেশি লবণ উৎপাদন হয়েছে। সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই।
“লবণ উৎপাদনের প্রধান উপকরণ পলিথিনের দাম বেড়েছে আমদানি পণ্য হওয়ার কারণে। আর পানি সেচের জন্য ব্যবহৃত ডিজেলের দামও বেড়েছে।”
‘প্রতি চামড়া সংরক্ষণে খরচ ৩০০ টাকা’
ঈদের মৌসুমে অপেশাদার শ্রমিক কাজ করায় লবণের পরিমাণ বেশি লাগে। ৭৪ কেজির এক বস্তা লবণ দিয়ে গড়ে ১০টির মতো চামড়া সংরক্ষণ করা যায়।
সাধারণ সময়ে এর চেয়ে কম লবণ লাগে উল্লেখ করে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, চুক্তি নিয়ে দলবদ্ধ হয়ে শ্রমিকরা চামড়ায় লবণ মেশানোর কাজটি করে থাকেন। প্রতি চামড়ায় লবণ মেশাতে মজুরি এবার ৪০-৫০ টাকা থেকে শুরু হলেও রাতে শ্রমিক সংকটে তা গিয়ে ঠেকে ১০০ টাকায়।
আর চামড়া ট্রাক থেকে নামানো এবং আড়ত ঘরে পৌঁছে দেওয়া বাবদ প্রতি চামড়ায় ১০-১৫ টাকা নিয়ে থাকেন থাকেন শ্রমিকরা।
এসবের সঙ্গে পানি, তদারকি, ঘর ভাড়া, ব্যবস্থাপনা, লবণের খরচ মিলিয়ে প্রতি চামড়ার পেছনে ৩০০ টাকার বেশি খরচ হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক টিপু সুলতান।
তিনি জানান, কাঁচ চামড়া সংগ্রহ করার পর দ্রুত লবণ মিশিয়ে সংরক্ষণ করেন পোস্তার ব্যবসায়ীরা। সপ্তাহ খানেক পর এই চামড়া ট্যানারিতে যেতে শুরু করবে।
চামড়ার দর কেমন
ঈদের প্রথম দিন সহজে চামড়া সংগ্রহ করতে পোস্তার প্রবেশমুখের বাইরে প্রধান সড়কের পাশে চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসেন হারুন এন্টারপ্রাইজের পরিচালক মোহাম্মদ হারুন। সংগৃহীত চামড়া সড়কের উপর স্তুপ করে রেখে সুবিধা মতো তিনি পাঠিয়ে দেন নিজের আড়তে।
হারুন বিডিনউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘এবার চামড়া এসেছে বেশি। দাম আগের বারের চেয়ে বেশি হলেও আকার ভেদে গড়ে ৭০০ টাকা থেকে শুরু করে ১১০০ টাকায়ও নিয়েছি।’’
গতবারের মতো চামড়ার দর না পড়ায় খুশি মৌসুমি ব্যবসায়ী ও মাদ্রাসা শিক্ষকরা। ঢাকার মিরপুর থেকে চামড়া সংগ্রহ করে পোস্তায় নিয়ে আসেন ফঁড়িয়া উজ্জল হোসেন।
১৫০টি চামড়া পরিচিত আড়তে দেওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘এবার একটু লাভ হয়েছ। যা হইছে, তাই ভালো।’’
ঈদকে কেন্দ্র করে পশুর চামড়া সংগ্রহের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার; ঢাকায় গরুর চামড়ার দাম গতবারের চেয়ে ৩ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪ টাকা বেড়েছে।
ট্যানারি ব্যবসায়ীদেরকে এবার ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া কিনতে হবে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়, গত বছর এই দাম ছিল ৪৭ থেকে ৫২ টাকা। ঢাকার বাইরে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম হবে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা, গত বছর যা ৪০ থেকে ৪৪ টাকার মধ্যে ছিল।
এছাড়া সারা দেশে লবণযুক্ত খাসির চামড়া গত বছরের মতই প্রতি বর্গফুট ১৮ থেকে ২০ টাকা, আর বকরির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
কোরবানির ঈদের সময়ে চামড়া ব্যবসায়ীদের অর্থ সরবরাহ বাড়িয়ে দিতে এবারও ব্যাংকগুলোকে ঋণ দিতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি মিলিয়ে এবার ১২টি ব্যাংককে সর্বোচ্চ ২৫৯ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করতে বলা হয়েছে। গত বছর রাষ্ট্রায়ত্ত ৪টি ও বেসরকারি ৭টি ব্যাংকে মোট ৪৪৩ কোটি টাকার ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।