হ্যান্ডসেট: পাল্লা দিয়ে উৎপাদন, আমদানি কমেছে তারও বেশি

বিদেশি ব্র্যান্ডের মেইড ইন বাংলাদেশ স্মার্টফোন যেমন চাহিদা মেটাচ্ছে, তেমনি দেশি ব্র্যান্ডগুলোও বাজারে ভালো অবস্থান করে নিয়েছে।

ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Feb 2023, 07:49 PM
Updated : 4 Feb 2023, 07:49 PM

বাড়তে থাকা বাজারের সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশে মোবাইল ফোন কারখানা স্থাপনের সুফল পেতে শুরু করেছে দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো; আমদানি কমে মেইড ইন বাংলাদেশ হ্যান্ডসেটের উৎপাদন ও বিক্রি বাড়ছে তড়তড়িয়ে।

স্মার্ট ও ফিচার- উভয় ধরনের ডিভাইসের চাহিদার বড় অংশের যোগান আসছে এখন দেশে স্থাপিত ১০ এর অধিক ছোট বড় কারখানা থেকে।

সুপরিচিত বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো যেমন বাংলাদেশের কারখানায় উৎপাদিত স্মার্টফোনের মাধ্যমে চাহিদা মেটাচ্ছে, তেমনি দেশি চালু ব্র্যান্ডগুলোর ফোনও বাজারে ভালো অবস্থা করে নিয়েছে।

স্থানীয়ভাবে তৈরি হওয়ায় সুলভ মূল্যেই উচ্চ ও মাঝারি কনফিগারেশনের হ্যান্ডসেট কেনার সুযোগ তৈরির পাশাপাশি কম বাজেটের ক্রেতাদেরও স্মার্টফোন ব্যবহারের ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির তথ্যেও সেই চিত্র মিলছে। গত কয়েক অর্থবছরের আমদানি ও উৎপাদনের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ধীরে ধীরে আমদানির পরিমাণ কমে দেশে ফোন তৈরি ও সংযোজনের পরিমাণ বাড়ছে।

তবে এক্ষেত্রে এখনও বাধা হয়ে রয়েছে অবৈধভাবে দেশে আসা ফোনের বড় একটি বাজার। ব্যাগেজ রুলের আওতায় আনা ফোনের সংখ্যাও কম নয় বলে বিভিন্ন সময়ই বলে আসছেন উদ্যোক্তা ও আমদানিকারকরা।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে দেশের কারখানাগুলোতে এক কোটি ২৯ লাখ ৬ হাজার মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদন হয়েছে। এসময়ে আমদানি হয়েছে মাত্র ৫০ হাজার হ্যান্ডসেট।

পঞ্জিকা বর্ষের হিসাবে ২০২২ সালে মোট তিন কোটি ১৪ লাখ ৭২ হাজার ফোন দেশের কারখানাগুলোতে উৎপাদন হয়েছে। এসময়ে আমদানি হয়েছে মাত্র তিন লাখ ৫ হাজার ৯৫২টি হ্যান্ডসেট। অর্থাৎ সরকারি হিসাবে বাজারে আসা মোট মোবাইল ফোনের মধ্যে আমদানি হ্যান্ডসেটের পরিমাণ ১ শতাংশেরও (০.৯৬২৭%) কম।

একইভাবে ২০২১-২০২২ অর্থবছরের হিসাব বলছে, বাজারে আসা মোট সাড়ে চার কোটি হ্যান্ডসেটের মধ্যে আমদানি করা সেটের পরিমাণ ছিল এক কোটি। দেশে উৎপাদন হয়েছিল সাড়ে তিন কোটি সেট।

এর আগে ২০২০-২০২১ অর্থবছর চার কোটি ১০ লাখ ফোন বাজারে এসেছিল, যার মধ্যে আমদানি হয়েছিল দেড় কোটি। দেশে উৎপাদিত হয়েছিল ২ কোটি ৬০ লাখ।

আরেকটু পেছনের তথ্য ঘাটলে দেখা যায়, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে মোট ২ কোটি ৯৪ লাখ মোবাইল হ্যান্ডসেটের মধ্যে দেশে উৎপাদন ও আমদানির পরিমাণ ছিল প্রায় সমানে সমান। মোট এক কোটি ৪৯ লাখ ফোন আমদানির বিপরীতে দেশে উৎপাদন হয়েছিল এক কোটি ৪৫ লাখ।

মূলত এ সময় থেকেই দেশে ফোন উৎপাদনের পথ সুগম হয় স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপের অংশ হিসেবে আমদানিতে শুল্ক বাড়িয়ে এবং কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক রেয়াত দেওয়ার মাধ্যমে।

বাংলাদেশে দক্ষিণ কোরিয়ার ব্র্যান্ড স্যামসাং এর মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদনে যুক্ত কোম্পানি ফেয়ার ইলেক্ট্রনিক্সের হেড অব মার্কেটিং মেসবাহ উদ্দিন বর্তমান বাজার চিত্র তুলে ধরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছে। চাহিদার প্রায় পুরোটা যোগান দিতে পারায় গত ছয় মাস ধরে মোবাইল হ্যান্ডসেট তেমন একটা আমদানি করতে হচ্ছে না।

তবে আমদানি কমে যাওয়ার পেছনে ডলারের উচ্চমূল্য এবং আমদানি নিয়ন্ত্রণে ঋণপত্র খুলতে শতভাগ মার্জিন আরোপও বড় কারণ বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

Also Read: মোবাইল ফোনের সিংহভাগই তৈরি হচ্ছে দেশে: টিপু মুনশি

Also Read: মোবাইল হ্যান্ডসেট আমদানির ‘দিন ফুরোচ্ছে’

Also Read: ভারতে তৈরি প্রথম বিমানবাহী রণতরীর যাত্রা শুরু

পথ খুলল ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ নীতিমালা

দেশে ৩০ শতাংশ মূল্য সংযোজন সুবিধা দিয়ে ২০১৭ সালে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ নীতিমালা করে সরকার। এতে আমদানি করা হ্যান্ডসেটের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে দেওয়ার পর দেশি-বিদেশি ১৪টি ব্র্যান্ড ও কোম্পানি কারখানা স্থাপনের লাইসেন্স নেয়।

বড় বিনিয়োগ পরিকল্পনা নিয়ে দেশ ফোন সংযোজন ও তৈরির কাজ শুরু করে এসব কোম্পানি। দেশি উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি বড় ব্র্যান্ডগুলোও স্থানীয় অংশীদারদের নিয়ে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় এ খাতে বিনিয়োগে নামে।

মূলত সরকারি এমন নীতি সুবিধা কাজে লাগাতে এর পর থেকেই আগে থেকে দেশে ফোন প্রস্তুতকারক হিসেবে নাম লেখানো ওয়ালটন ও সিম্ফোনি যেমন বিনিয়োগ বাড়ায়, তেমনি স্যামস্যাং, নকিয়া, শাওমি, অপো, ভিভোসহ অন্যান্য ব্র্যান্ড দেশে কারখানা স্থাপন করতে শুরু করে। পর্যায়ক্রমে এসব কারখানায় হ্যান্ডসেট সংযোজন ও উৎপাদন শুরু হয়।

মোবাইল হ্যান্ডসেট আমদানি বিষয়ক জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সবশেষ এসআরও-তে দেখা যায়, মোবাইল হ্যান্ডসেট আমদানি করতে গেলে ২৫ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ এটিভি, ৩ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি ও ২ শতাংশসহ সার্বিক ৫৮ দশমিক ৬ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা আছে।

অপরদিকে দেশে মোবাইল উৎপাদনের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি, ৫ শতাংশ ভ্যাট ও ২ শতাংশ এআইটিসহ মোট ১৮ শতাংশ করভার রয়েছে।

শুল্কের পার্থক্যের এ সুবিধাই এগিয়ে দিচ্ছে দেশে স্থাপিত কারখানায় স্মার্টফোন ও ডিভাইস উৎপাদনকে।

কতটা মূল্য সংযোজন?

তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ মর্যাদা পেয়ে যেসব হ্যান্ডসেট বাজারে আসছে সেগুলোতে দেশি মূল্য সংযোজন খুব একটা বেশি নয়। বিদেশ থেকে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশগুলো নিয়ে এসে দেশের কারখানাতে সেগুলো সংযোজন করে তৈরি হচ্ছে ফোন। তবে অনেক যন্ত্রাংশ তৈরির কাজ শুরু হয়েছে কিছু কারখানায়।

ফেয়ার ইলেক্ট্রনিক্সের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মেসবাহ বলেন, হ্যান্ডসেট ও ব্র্যান্ডভেদে ভিন্ন ভিন্ন মূল্য সংযোজন হয়। বর্তমানে অধিকাংশ উৎপাদনকারী যেটা করেন সেটাকে শিল্পের ভাষায় অ্যাসেম্বলিং ও পিসিবিএ বলা হয়। এ প্র্যাকটিস বিশ্বব্যাপী সিকেডি হিসেবেও পরিচিত। বাংলাদেশে অনেকেই চার্জার, কেসিংসহ আরও কিছু অংশ উৎপাদন শুরু করেছে। তবে এখন পর্যন্ত একটি মোবাইল হ্যান্ডসেটে আমদানি করা যন্ত্রাংশের অংশীদারিত্বই বেশি।

দেশি ইলেক্ট্রনিক্স ব্র্যান্ড ওয়ালটন ডিজিটেকের বিজনেস ইন্টিলিজেন্স বিভাগের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর মোহাম্মদ রেজাউল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সরকারের নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশের কারখানায় ৩০ শতাংশ মূল্য সংযোজন করতে পারলেই মেইড ইন বাংলাদেশের মর্যাদা পাওয়া যাচ্ছে। স্থানীয় ব্র্যান্ড ও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো এখনও সিকেডি ও পিসিবিএর মাধ্যমে ৩০ শতাংশ মূল্য সংযোজনের শর্ত পূরণ করতে পারছে।

ওয়ালটন এগুলো ছাড়াও হেড ফোন, চার্জার, ব্যাটারিসহ আরও কিছু যন্ত্রাংশ উৎপাদন করছে বলে জানান তিনি।

উদ্যোগ কাদের

স্যামস্যাং ব্র্যান্ডের জন্য ফেয়ার ইলেক্ট্রনিক্স এবং ওয়ালটন ব্র্যান্ডের জন্য ওয়ালটন ডিজি টেক ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিটিআরসির সনদ নেয়। পরের বছর ভিভো ব্র্যান্ডের জন্য বেস্টটাইকুন, সিম্ফোনির জন্য এডিসন ইন্ডাস্ট্রিজ, উইনস্টার ও টাইটানিকের জন্য আনিরা ইন্টারন্যাশনাল এবং আইটেল, টেকনো ও ইনফিনিক্স ব্র্যান্ডের জন্য কার্লকেয়ার টেকনোলজি বিটিআরসির সনদ নেয়।

পরের বছর অপো ও রিয়েলমি ব্র্যান্ডের জন্য বেনলি ইলেক্ট্রনিক্স, লাভা ও মেক্সিমাসের জন্য গ্রামীণ ডিস্ট্রিবিউশন বিটিআরসির সনদ গ্রহণ করে।

এরপর ২০২০-২০২১ অর্থবছরে নোকিয়া ফোন উৎপাদনের জন্য ভাইব্রেন্ট সফটওয়্যার লাইসেন্স নেয়। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে মাইসেল ব্র্যান্ডের মোবাইল তৈরির জন্য মাইসেল টেকনোলজি, শাওমি এর জন্য ডিবিজি টেকনোলজি, লিনেক্স, বেঙ্গল ও মারলাক্স ব্র্যান্ডের জন্য লিনেক্স টেকনোলজি লাইসেন্স গ্রহণ করে।

লাইসেন্স নেওয়ার পর এরমধ্যে অনেকগুলো ঢাকার আশেপাশে কারখানা নির্মাণ করে হ্যান্ডসেট উৎপাদন শুরু করে। তবে কারিগরি ও উৎপাদন সংশ্লিষ্ট সক্ষমতা কম থাকায় বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর তুলনায় প্রতিযোগিতায় কিছুটা পিছিয়ে আছে দেশি কোম্পানিগুলো।

ওয়ালটন কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাউল বলেন, বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো যতটা কম খরচে দেশে মোবাইল উৎপাদন করতে পারে দেশি ব্র্যান্ডগুলো সেই তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে। বিভিন্ন কারণে তাদের উৎপাদন সক্ষমতা কম।

এডিসন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকারিয়া শহিদ সম্প্রতি মোবাইল ফোন বিষয়ক এক অনুষ্ঠানে দাবি করেন, বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোকে একটা নির্দিষ্টি মূল্যের চেয়ে কম দামি ফোন বিপণন থেকে বিরত না রাখলে দেশি ব্র্যান্ডগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। পাশাপাশি অধিক সংখ্যক কোম্পানি এ ব্যবসায় নামলে বিদ্যমানগুলোসহ সবাই লোকসানে পড়বে। তাই এই দুই ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার ওই অনুষ্ঠানে এবিষয়ে বলেন, সরকার বিষয়টি আরও কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করবে। এরপর এ খাতের শৃঙ্খলা আনতে প্রয়োজনে নতুন নীতিমালা করবে।