“যদি মূল্য বৃদ্ধি করতেই হয়, তাহলে বিইআরসির বিধান অনুযায়ী স্টেক হোল্ডারস কনসালটেশনের মাধ্যমে মূল্য সমন্বয় করা হবে।”
Published : 18 Aug 2024, 10:05 PM
মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে কয়েক মাস পর পর বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির যে পদ্ধতি চালু হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে, তা অনুসরণ করবে না অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান রোববার দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিন তার দপ্তরগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন।
এদিন সকালে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সঙ্গে বৈঠক শেষে দুপুর ২টার পর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রায় তিন ঘণ্টা বৈঠক করেন উপদেষ্টা। পরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন তিনি।
বৈঠকে প্রাথমিকভাবে তিনটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যার অন্যতম হল তিন মাস পর পর বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সরকারি সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা।
বিদ্যুতের ভর্তুকি কমাতে চলতি বছর তিন মাস পর পর একটু একটু করে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন বিগত সরকারের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এখন নতুন উপদেষ্টা এসে সেই সিদ্ধান্তটি বাতিলের খবর জানালেন।
উপদেষ্টা বলেন, “ঘন ঘন বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির যে ব্যাপারটা। সরকার একটা ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছিল যে বিইআরসি লাগবে না, নিজেরা প্রয়োজন মনে করলে মূল্য বৃদ্ধি করতে পারবে। এটা একটা আইনের পরিবর্তনের বিষয়, আমার একার বিষয় না, উপদেষ্টা পরিষদের বিষয়।
“কিন্তু জন প্রত্যাশার দিকে লক্ষ্য রেখে আমরা বলছি, আপাতত এই সুযোগ ব্যবহার করে মূল্য বৃদ্ধি হবে না। যদি মূল্য বৃদ্ধি করতেই হয়, তাহলে বিইআরসির বিধান অনুযায়ী স্টেক হোল্ডারস কনসালটেশনের মাধ্যমে মূল্য সমন্বয় করা হবে। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা বাধ্য না হলে মূল্যবৃদ্ধি করব না।”
বিশেষ ক্ষমতা আইনের আওতায় এই মন্ত্রণালয়ে যেসব প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, সেগুলো স্থগিত রাখার সিদ্ধান্তও হয় বৈঠকে।
উপদেষ্টা বলেন, “বিদ্যুৎ বিভাগের দুর্নীতি বিষয়ে পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে। বিশেষ করে ২০১০ সালের বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন সেটার বিষয়ে অনেকে লেখালেখি করছে। আজকে আমি সিদ্ধান্ত দিয়েছি ২০১০ সালের এই আইনের অধীনে বর্তমানে যেসব প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন, সেগুলো মুলতবি থাকবে। আগে যেসব চুক্তি হয়ে গেছে সেগুলো আপাতত চলবে। এই আইনটা আমরা রিভিউ করব; রিভিউ করে যেটা সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার সেটা নেব। কারণ এটা আমার একার ব্যাপার না, এটা উপদেষ্টা পরিষদসহ অন্যান্য আইনের ব্যাপার।”
খাতা কলমের হিসাবে নয়, বাস্তব ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে এই মন্ত্রণালয়ের সাফল্য ও ব্যর্থতা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয় বৈঠকে।
উপদেষ্টা বলেন, “এখন থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে রিয়েল ইন্ডিকেটর দিয়ে মূল্যায়ন করা হবে। যদি বিদ্যুতের দাম না বাড়ে, যদি বিদ্যুতের দাম কমতে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে আমরা ভালো কাজ করছি, আর যদি বিদ্যুতের দাম বাড়ে, তাহলে আমরা কি ভালো কাজটা করলাম? এখন স্ট্যাটিসটিক্স দিয়ে আর মূল্যায়ন করা হবে না। প্রতিটি মূল্যায়ন করা হবে সাধারণ মানুষ কী ভাবছে তার ওপর। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ অংশগ্রহণ করল, এটাই ইন্ডিকেট করে যে আমরা ব্যর্থ। মানুষ উন্নয়নের এসব গালগল্প বিশ্বাস করে নাই, সেজন্য রাস্তায় নেমে এসেছে।”
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে একটি ব্যয়সাশ্রয়ী পরিকল্পনা নেওয়ার বিষয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়।
উপদেষ্টা বলেন, “যেহেতু একটা আর্থিক সংকট রয়েছে, তাই যত রকম বাহুল্য ব্যয় আছে, সেখানে সাশ্রয় করতে হবে।”
বৈঠকে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়েও আলোচনা হয়। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র রাখা হবে কি হবে না সে বিষয়ে পর্যালোচনা হবে।
‘জনস্বার্থ ও জন প্রত্যাশা পূরণের জন্য’ আইনের ভেতরে থেকে যা কিছু করা প্রয়োজন, সবই করা হবে বলে মন্তব্য করেন উপদেষ্টা।
‘স্তুতির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে’
সরকারি কর্মকর্তা ও গণমাধ্যমকর্মীদেরকে সরকারের উপদেষ্টাদের অতিরিক্ত প্রশংসা বা স্তুতিবাক্য আওড়ানোর সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার অনুরোধ করেন নতুন উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান।
সাংবাদিকদের সঙ্গে মত বিনিময়ের শুরুতেই তিনি বলেন, “গণঅভ্যুত্থানে অসংখ্য মানুষ অত্মদান করেছে এবং এর মধ্য দিয়ে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে। সেজন্য অনেক কিছুতেই আপনারা পরিবর্তন দেখবেন। সাংবাদিক হিসাবে আপনাদের ফুল একসেস থাকবে, তবে সেটা সরকারি নিয়ম নীতির মধ্যে।
“জ্বালানি ও বিদ্যুতের সচিবদের কাছে আপনারা তথ্য চাইবেন, তারা তথ্য দেবে। কিন্তু আপনাদের একটা দায়িত্ব আছে। সেটা হচ্ছে আপনাদের কিন্তু পেশাদারত্বের মধ্যে থাকতে হবে।”
গণমাধ্যমের মৃদু সমালোচনা করে উপদেষ্টা বলেন, “আপনারা এতদিন ব্যক্তিগতভাবে দুর্বৃত্তদের মহামানব বানাইছেন। আর মহামানব লোকদেরকে দুর্বৃত্ত বানাইছেন। এটা কিন্তু করবেন না। আপনারাও জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করবেন, আমরাও জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করব।”
নতুন দায়িত্ব গ্রহণ উপলক্ষ্যে এক সাংবাদিক ধন্যবাদ জানিয়ে কথা বলতে শুরু করলে তাকে থামিয়ে দিয়ে উপদেষ্টা বলেন, “আমাদেরকে স্তুতির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আপনারা তো দেখেছেন বিপদে পড়েছে কীভাবে।
“কথার আগে একবার স্যার পরে একবার স্যার, এক বাক্যের মধ্যে চার-পাঁচবার স্যার এসব আর চলবে না। এটা আমি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদেরও বলে দিয়েছি।”