বাজার থেকে মিনিকেট চাল কি উঠে যাবে?

বাজার থেকে মিনিকেট চাল সরাতে একাধিক মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ পেয়ে গেছে ভোক্তা অধিদপ্তর।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Sept 2022, 07:35 PM
Updated : 13 Sept 2022, 07:35 PM

শহুরে মানুষের প্রিয় সরু চাল ‘মিনিকেট’কে ‘প্রতারণার ছক’ বলছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

 সরকারের সায় নিয়ে এই চাল বাজার থেকে তুলে নিতে মিলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে অধিদপ্তর। তা না হলে অভিযান শুরু করবেন বলে জানিয়েছেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান।

মঙ্গলবার সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে নিত্যপণ্যের উৎপাদনকারী, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও সুপার শপের প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্যাকেটজাত নিত্যপণ্যের মূল্যের বিষয়ক এক মতবিনিময় সভায় সব কিছু ছাপিয়ে মিনিকেট প্রসঙ্গটিই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

একই দিন সচিবালয়ে আলাদা অনুষ্ঠানে ‘মিনিকেট’ নামে বাজারে প্রচলিত চালের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার।

ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, বাজার থেকে মিনিকেট চাল সরাতে সরকারের একাধিক মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ তারা পেয়ে গেছেন।

“কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে যারা ধান গবেষণার সাথে যুক্ত আছেন, তারা জানিয়েছেন, মিনিকেট নামে চালের কোনো ভ্যারাইটি নেই। এটি একটি প্রতারণার ছক। এর ব্র্যান্ডিং করে মানুষের পকেট কাটা হচ্ছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে মিনিকেট চালের বাজারজাতকরণ বন্ধের জন্য ভোক্তা অধিকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।”

তিনি বলেন, “আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, মোটা চালকে ছাঁটাই করে চিকন করে পলিশ করা হয়, ব্রাইটনেস বাড়ানো হয়। তারপর সেগুলোকে মিনিকেট, সুপার মিনিকেট, প্রিমিয়াম বা বিভিন্ন নামে বিক্রি করা হয়।”

Also Read: মিনিকেট চাল: এক ফাঁকির নাম

শিগগিরই মিনিকেট চালের বাজারজাত বন্ধের জন্য চিঠি দেওয়া হবে জানিয়ে সফিকুজ্জামান বলেন, “এই চালের যেহেতু কোনো ভ্যারাইটি নেই, তাই আমরা সুপারশপ এবং রাইস মিলগুলোতে চিঠি দেব, যাতে এর বাজারজাত বন্ধ করা হয়। এটা বন্ধের জন্য সময় দেওয়া হবে। পরবর্তীতে আমরা অভিযান শুরু করবো।”

সভায় মিনিকেট চাল নিয়ে মীনা বাজারের হেড অব সাপ্লাই চেইন রায়হান আল বেরুনি বলেন, “সরকারি কৃষি বিপণন অধিদপ্তর থেকে চালের যে মূল্য তালিকা প্রকাশ করা হয় সেখানেও কিন্তু মিনিকেট নামটা উল্লেখ থাকে।

“আমাদের যেভাবে বলা হবে সেভাবেই চলব। কিন্তু একজন ডানে বলবে, একজন বামে বলবে; তাহলে আমরা কীভাবে চলব?”

তিনি বলেন, “মার্কেট যেভাবে চলছে, আমাদেরকে সেভাবেই চলবে হবে। মার্কেট যদি এটাকে মিনিকেট হিসাবে চেনে, আমাদেরকে মিনিকেট হিসাবেই বিক্রি করতে হবে। মিনিকেট নাম বন্ধ করে দিলে নতুন যে নামে আসবে, আমরা সেই নামেই বিক্রি করবো। সুতরাং সরকার যদি একটা বিজ্ঞপ্তিতে বলে দেয় যে এধরনের চালগুলো এই নামে চিনতে হবে, আমরাও সেই দিকে চলে যাব।”

প্রাণ আরএফএল গ্রুপের প্রতিনিধি খন্দকার কামরুল ইসলাম বলেন, “ভারতের শতাব্দি ধান কিংবা ফাস্ট সুপার নামের কিছু জাত যশোরে চাষাবাদ শুরু হয়। সেটাই মিনিকেট চাল নামে ব্র্যান্ড হয়ে গেছে। বাংলাদেশে বাসমতি বা বিআর ৫০, বিআর ৮১, বিআর ২৩ এই ধানের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলে যায়।”

ভোক্তা অধিকারের মহাপরিচালক বলেন, “চালের উৎপাদনের যে হিসাব করছি, সেখানেও বড় গ্যাপ হয়ে যাচ্ছে। মোটা চাল ছাঁটাইয়ের সময় সিস্টেম লস যদি ৫/১০ শতাংশ হয়ে যায়, তাহলে সেটাও একটা লস।

“আপনারা বলছেন, চাল কাটা যায় না। আমাদের কাছে তথ্য আছে, চাল কাটা হচ্ছে। সেজন্য আমাকে আবার কৃষি বিভাগের সঙ্গে বসে একটা সিদ্ধান্তে যেতে হবে। খাদ্য মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে এটা স্পষ্ট বলেছে যে, মিনিকেট নামে কোনো চাল নেই। বাজার থেকে এটা প্রত্যাহার করতে হবে।”

‘মোবাইল কোর্ট চলতে পারে’

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সচিবালয়ে সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরামের অনুষ্ঠানে বলেন, “মিনিকেটের উৎপত্তি সম্পর্কে মানুষ যদি জানত, তাহলে মিনিকেট চাল খুঁজতে যেতে না।

“এক সময় আমরা উচ্চ ফলনশীল চিকন জাতের চালের জন্য মিনি প্যাকেটে করে কিছু বীজ সংগ্রহ করি। সেই মিনি প্যাক থেকে এসেছে মিনিকেট। এই হল মিনিকেটের ইতিহাস। এটা অনেকবার বলা হয়েছে।”

তিনি বলেন, “ভোক্তা অধিকার মিনেকেট নামটা উচ্ছেদ করার জন্য মোবাইল কোর্ট চালাতে পারে। আমরা একটা আইন মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের জন্য দিয়েছি। খসড়া অনুমোদন পেয়েছে। এখন সেটা ভেটিংয়ের অপেক্ষায় আছে।

“ব্র্যান্ড যেটাই হোক, বস্তার গায়ে অবশ্যই ধানের জাতের কথা উল্লেখ করতে হবে। চাল চিকন করতে গিয়ে কতটা ছাঁটাই করা যাবে, সেটাও আমরা নির্দিষ্ট করে দেব। চাল চিকন করতে গিয়ে যে ক্ষয়টা হয়, সেটাও কিন্তু সারাদেশের মোট উৎপাদনের উপর প্রভাব ফেলে।”

সংসদে ওই আইন পাস করতে পারলে মিনিকেট নিয়ে প্রতারণা বন্ধ করা অনেক ‘সহজ’ হয়ে যাবে বলে মনে করেন মন্ত্রী।

“তখন প্যাকেটে করে মিহি চাল খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। সবাইকে খসখসে চালটাই খেতে হবে।… সবাই যদি ওইদিকে চলে যায়, তাহলে দামও কমে আসবে।”

বেশি মুনাফা করছে সুপার শপ?

 বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ভোক্তাদের সব ধরনের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে। চাল, চিনি, ডিম, সাবান, ডিটারজেন্ট পাউডার ও সুপার শপে বিক্রি হওয়া পণ্যগুলোর দাম অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় গত এক মাস ধরে এসব পণ্যের উপরই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে ভোক্তা অধিকার।

সুপার শপে খোলা বাজারে বিক্রি হওয়া বিভিন্ন পণ্য মোড়কিকরণ করে বিক্রি করতে গিয়ে দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বলেও ভোক্তা অধিকারের ভাষ্য। তবে মতবিনিময় সভায় অংশ নেওয়া সুপার শপ প্রতিনিধিরা এই অভিযোগ অস্বীকার করেন।

ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সফিকুজ্জামান বলেন, সুপার শপগুলোতে চিনিগুঁড়া চালের যেসব প্যাকেট ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি করা হয়, খোলা বাজারে সেগুলো ১০৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে চিনিগুঁড়া চালের কেজি ১২০ টাকা হলে সুপার শপে তা ১৫০ টাকা হয়ে যায়। দামের এত তারতম্য কীভাবে হয়?

“চিনিগুঁড়া চালে ২৯ শতাংশ লাভ করা হচ্ছে। এক ডজন ডিমে লাভ হয় ২৬ শতাংশ, লবণের ক্ষেত্রে ২৮ শতাংশ লাভ করা হচ্ছে।”

এসিআইয়ের চিফ অব লজিস্টিকস তমাল পাল বলেন, “এমআরপি নির্ধারণ করা হয় বাজারের উপর। সুপারশপের দোকানগুলোর ভাড়া প্রতি স্কয়ার ফিটে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। আমাদের খরচ ২০ শতাংশ বেশি। আমরা খোলা চালে আট শতাংশ আর উৎপাদকের সাথে বলে প্যাকেট চালে ২৫ শতাংশ লাভ করছি।”

এসিআই লজিস্টিকের বিপণন বিভাগের প্রধান মাহাদি ফয়সাল বলেন, “আমরা কত করে কিনছি এবং কত করে বিক্রি করছি, তার পার্চেজ ডকুমেন্ট আমাদের কাছে থাকে।”

মীনা বাজারের হেড অব সাপ্লাই চেইন রায়হান আল বেরুনি বলেন, “উৎপাদকরা যখন কোনো পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করেন, তারা ভ্যাট অথরিটির সাথে আলোচনা করেই ভ্যাট নির্ধারণ করেন। তারপর তারা আমাদের জানান, কত টাকায় কিনে কত টাকায় বিক্রি করতে হবে।”

পণ্য সরবরাহকারী সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, “নিত্যপণ্যের দাম উৎপাদকও নির্ধারণ করে না, সুপার শপও নির্ধারণ করে না। এটা নির্ধারণ করে দেয় ট্যারিফ কমিশন। সুপার শপগুলো আমাদের এমআরপি অনুযায়ী বিক্রি করে।”

মেঘনা গ্রুপ ও টিকে গ্রুপের প্রতিনিধিরাও একই বক্তব্য উপস্থাপন করেন।

স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজের হেড অব মার্কেটিং ইমতিয়াজ ফিরোজ বলেন, “আমরা যে প্যাকেট বাজারজাত করি, সেটি বস্তা হিসাবে করি না। আমরা এক কেজি, দুই কেজি ও পাঁচ কেজি প্যাকেটে চাষী ব্র্যান্ডের চাল বিক্রি করি। আজকে ধানের দাম হিসাব করলেও চালের দাম কেজি ১২০ টাকা হয়। আমরা যে এমআরপি নির্ধারণ করি এর মধ্যে ডিস্ট্রিবিউটর ও রেটেইলার এর মার্জিন থাকে।”

তার এই বক্তব্য নাকচ করে ভোক্তার মহাপরিচালক বলেন, “খোলা বাজারে যে চাল ১২০ টাকা বিক্রি হয়, সেটা কিন্তু তিন হাতের লভ্যাংশ দেওয়ার পরই বিক্রি হয়। আপনারা এর সঙ্গে হয়ত একটা প্যাকেট যোগ করেছেন। সেজন্য খরচ হয়ত ৫ টাকা বাড়তে পারে। কিন্তু সেজন্য আপনি ৩০ টাকা লাভ করে বসতে পারেন না।

“তাছাড়া আজকের বাজারের সঙ্গে মেলালে আপনার হবে না। কারণ আপনি ধানটা কবে কিনে রেখেছিলেন, সেটা স্মরণ করেন। দিনাজপুরে ধানের মজুদের একটা ঘটনা ঘটেছে। সেটা নিয়ে আমি বলতে চাই না। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো যদি এভাবে মজুদ করে, আর আজকের বাজারের সঙ্গে তুলনা দেয়, তাহলে তো হবে না।”