Published : 06 Nov 2023, 12:09 PM
মোবাইল ইন্টারনেটের খরচ হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় জনমনে ক্ষোভের মধ্যে চার অপারেটরকে ডেকে দাম কমাতে বলেছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার।
সোমবার সকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা তাদের বলে দিয়েছি, দাম বাড়ানো যাবে না।”
সরকারি সিদ্ধান্তে মোবাইল অপারেটরগুলো তিনদিনের ইন্টারনেট বা ডেটা প্যাক বিলুপ্ত করে নতুন যে দর দিয়েছে, তাতে গ্রাহকের ইন্টারনেট খরচ বেড়েছে প্রায় এক তৃতীয়াংশ। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপে ক্ষোভ জানিয়েছেন গ্রাহকেরা।
এমন পরিস্থিতিতে রোববার দেশের চার মোবাইল অপারেটরের কর্মকর্তাদের ডেকে বৈঠক করে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী।
অপারেটরগুলো তাহলে আগের প্যাকেজগুলোতে ফিরে যেতে পারবে কি না জানতে চাইলে মন্ত্রী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পূর্বের ডেটাপ্যাক তো নেই। ডেটাপ্যাক ৪০টায় নামিয়ে নিয়েছি, মেয়াদ তিনটাতে নিয়েছি। কিন্তু ওদের দাম বাড়ানো চলবে না।”
মোবাইল অপারেটগুলো বলছে, তিন দিনের ‘স্যাশে প্যাক’গুলোর গ্রাহক মূলত শিক্ষার্থী, নিম্ন আয়ের মানুষ। এই প্যাকগুলো বাদ দেওয়ার ফলে দাম যে বাড়তে পারে, এটা সরকারকে আগেই জানানো হয়েছিল।
অনেকগুলো প্যাকেজ বিলুপ্তির ফলে গ্রাহকের বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয়েছে দাবি করে মোবাইল অপারেটররা আবার আগের প্যাকে ফেরত যেতে চায়।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর মোবাইল অপারেটরগুলোর ইন্টারনেট প্যাকেজে ডেটার সর্বনিম্ন মেয়াদ তিন দিন থেকে বাড়িয়ে সাত দিন করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। আগারগাঁওয়ে বিটিআরসির প্রধান সম্মেলন কক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে মোবাইল ডেটার নতুন প্যাকেজ নির্দেশিকা ঘোষণা করা হয়, যা ১৫ অক্টোবর থেকে কার্যকর হয়।
সেই ঘোষণায় বলা হয়, প্যাকেজ (রেগুলার প্যাকেজ), বিশেষ প্যাকেজ (সিসিএসপি), রিসার্চ ও ডেভেলমেন্ট ( আরঅ্যান্ডডি), সব ধরনের ব্র্যান্ড মিলিয়ে ( ফ্লেক্সিবল প্ল্যান অনুযায়ী) প্যাকেজের সংখ্যা হবে ৪০টি, যা আগে ছিল ৮৫টি। প্যাকেজের সময়সীমা হবে ৭ দিন, ৩০ দিন এবং আনলিমিটেড; যা আগে ছিল ৩ দিন, ৭ দিন, ১৫ দিন এবং ৩০ দিন।
ওই অনুষ্ঠানে মোস্তাফা জব্বার বলেছিলেন, তিন দিনের প্যাকেজে ১৫ জিবি ডেটা দিলে তা গ্রাহকের উপকারে আসে না। মোবাইল অপারেটরগুলো ব্যবসায়িক স্বার্থে ডেটার মেয়াদ সীমিত রাখতে চায়। আগে অসংখ্য প্যাকেজ থাকায় মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়েছে, নতুন নির্দেশিকায় ৪০টি প্যাকেজ গ্রাহকদের স্বাচ্ছন্দ্য দেবে। আগের ৩ দিনের প্যাকেজের যে মেয়াদ, সেটাই ৭ দিনের হবে।
১৫ অক্টোবরের আগে রবির তিন দিন মেয়াদের এক জিবি ডেটা প্যাকের দাম ছিল ৪৮ টাকা, এখন ৭ দিন মেয়াদে একই পরিমাণ ডেটা কিনতে খরচ হচ্ছে ৬৮ টাকা।
গ্রামীণফোনের তিন দিনের এক জিবির ডেটা প্যাকের দাম ছিল ৪৬ টাকা। এখন একই ডেটার সাত দিনের প্যাক কিনতে খরচ হচ্ছে ৬৯ টাকা।
বাংলালিংকের তিন দিনের ডেটা প্যাকের দাম ছিল ৪২ টাকা, এখন সাত দিনের জন্য দেড় জিবি ডেটা প্যাক ৬৯ টাকায় বিক্রি করছে বাংলালিংক।
এয়ারটেলে আগে তিন দিনের জন্য ৪২ টাকায় এক জিবি এবং ৪৯ টাকায় দেড় জিবি ডেটা পাওয়া যেত। এখন কোম্পানিটি ৬৮ টাকায় সাত দিনের দেড় জিবি ডেটা প্যাক অফার করছে।
মোবাইল অপারেটরগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের সিদ্ধান্তে ‘প্রাইস সেন্সিটিভ ব্রান্ড’ বাংলালিংক ও এয়ারটেল সবচেয়ে বেশি ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ হয়েছে। বাংলালিংকের ৬০ শতাংশ, রবি ও এয়ারটেলে ২২ থেকে ২৩ শতাংশ ও গ্রামীণফোনের ১২ থেকে ১৩ শতাংশ গ্রাহক তিন দিনের ডেটা প্যাকগুলো নিয়মিত ব্যবহার করতেন।
একটি মোবাইলফোন অপারেটরে সেলসে কর্মকরত একজন কর্মকর্তা বলেন, “যারা ডিজিটালি মোবাইল রিচার্জ করেন না, অর্থাৎ যারা দোকান থেকে ক্যাশকার্ড বা এমবি কার্ড কিনে ইন্টারনেট চালাতেন, তাদের বেশিরভাগই তিনদিনের এই ‘স্যাশে’ প্যাকগুলো কিনতেন। ওই প্যাকেজ বিলুপ্ত করার ফলে অপারেটরগুলো অনেক গ্রাহক হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে। গ্রাহক হারানোর এই ক্ষতি সমন্বয় করতে মোবাইল অপারেটরগুলো ডেটা প্যাকের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। যাতে গ্রাহক কমলেও লভ্যাংশ ঠিক থাকে।”
ওই কর্মকর্তার হিসেবে, তিন দিনের প্যাকেজগুলোর জায়গায় সাত দিনের যে প্যাকেজগুলো অপারেটরগুলো দিয়েছে, তাতে ডেটার দাম বেড়েছে অন্তত ৩০ শতাংশ।
গ্রাহকদের ক্ষোভ
ফেইসবুক গ্রুপ ডেসপারেটলি সিকিং ঢাকায় গত ২৩ অক্টোবর আবিদ হাসান নামে এক ব্যক্তি লেখেছেন, “হঠাৎ করে ইন্টারনেট প্যাকেজের দাম বেড়ে যাওয়ায় কে কী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছেন? ঘরের বাইরে প্রয়োজনীয় কাজের জন্যও ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারছি না। এসব অনাচারের কী কোন সমাধান হবে না?”
ওই পোস্টের নিচে শতাধিক মন্তব্য পড়ে। অনেকেই অপারেটর পরিবর্তন করে এয়ারটেল বা টেলিটক নিতে বলেছেন পোস্টদাতাকে।
সৈয়দ আবু সায়ীদ নামে একজন লিখেছেন, “আমি নেট কেনা বন্ধ করে দিয়েছি। ব্রডব্যান্ড কিছুটা সাহায্য করবে। কিন্তু ভালো মানের এক কেজি চালের দামে এক জিবি ইন্টারনেট কিনতে গেলে ধাক্কা খেতে হচ্ছে।”
ইসরাত মনি নামে একজন লিখেছেন, “ইন্টারনেট প্যাকেজের দাম বাড়ছে, এদিকে সার্ভিস বাজে। টাকা দিয়ে কিনেও নেট পাই না। আবার ফেইসবুক রিচও তলানিতে। অনলাইন বিজনেসে টিকে থাকাটাই কঠিন হয়ে গেছে।”
মো. শাকিল নামে এক গাড়ি চালক রোববার বলেন, তিনি একই ফোনে বাংলালিংক ও এয়ারটেলের সিম চালান। আগে গাড়ি ভাড়াসহ বিভিন্ন কাজে ইন্টারনেট প্যাক কিনতেন। গতমাসে দাম বেড়ে যাওয়ায় একই বাড়ির আরও দুইজন ভাড়াটের সঙ্গে তারা একটি ‘ওয়াইফাই’ নিয়েছেন। তাতে খরচ হবে মাসে দুইশ টাকা। অন্তত বাচ্চারা ইন্টারনেট দেখতে পাবে।
অপারেটরগুলো যা বলছে
মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশের (এমটব) কাছে গত সপ্তাহে জানতে চাওয়া হয়েছিল, নতুন দর চালু হওয়ার পর অপারেটরগুলো ডেটা প্যাকের গ্রাহক হারিয়েছে কী না। হারালে তার হার কত। নতুন বেধে দেওয়া ওই দরকে অপারেটরা কীভাবে দেখছে।
জবাবে এমটব মহাসচিব মোহাম্মদ জুলফিকার বলেন, "ডেটার মেয়াদ বাড়ার সাথে মূল্য বাড়ার বিষয়টি আমরা অনেক আগেই বিটিআরসি তথা সরকারকে জানিয়েছি। ছোট মেয়াদের প্যাক অবলুপ্ত করে নতুন নির্দেশনা চালু হওয়ার পরে বাজারে যে প্রভাব পড়েছে সেটা আমরা আগেই আশংকা করেছিলাম। ফলে আর্থিক কারণে যারা ছোট মেয়াদের প্যাক কিনতেন তারা সরাসরি নতুন মূল্য দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে।”
তবে ডেটা ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমেছে কি না, বা কতটা কমেছে, তা জানতে আরো সময় লাগবে বলে জানান জুলফিকার।
তিনি বলেন, “সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ধারণার সঙ্গে এই নতুন প্যাকেজ রেগুলেশন সংগতিপূর্ণ নয় বলে আমরা মনে করি। কারণ ইন্টারনেটের মত ইউটিলিটি সেবা সাশ্রয়ী মূল্যে যত বেশি মানুষের কাছে আমরা নিতে পারব তত দ্রুত আমরা লক্ষ্যে পৌছাতে পারব। আমরা আশা করি সরকার ও বিটিআরসি ডেটা রেগুলেশন পুনর্বিবেচনা করবে।"
জানতে চাইলে বাংলালিংকের চিফ কর্পোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান গত ২৪ অক্টোবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিয়ন্ত্রক সংস্থার সিদ্ধান্ত গ্রাহকদের নিজস্ব চাহিদা অনুযায়ী ডেটা প্যাক বেছে নেওয়ার সুবিধা অনেকটা কমিয়ে দিয়েছে বলে আমরা মনে করি। বাংলালিংক-এর হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ৬০% গ্রাহক ৩ দিনের ইন্টারনেট ডেটা প্যাক ব্যবহার করতেন, কারণ এটি তাদের জন্য সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক এবং অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী। মুদ্রাস্ফীতির চলমান পরিস্থিতিতে এই ধরনের প্যাক সীমিত আয়ের গ্রাহকদের জন্য আগের চেয়ে বেশি উপযোগী। তাই এমন অবস্থায় এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের ডিজিটাল অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।”
দাম বাড়ার কারণ ব্যাখ্য করতে গিয়ে তাইমুর বলেন, প্রত্যেক টেলিকম নেটওয়ার্কের ক্ষমতার একটি সীমা থাকে। এটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ডেটা কোনো অপারেটর দিতে পারে। সে কারণে ডেটার মেয়াদ বৃদ্ধি পেলে ডেটার দাম বাড়তে পারে।
“গ্রাহকদের সুবিধার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিষয়টি গুরুত্বের সাথে পুনর্বিবেচনা করলে বাংলালিংক গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী আবার আগের মত ৩ দিনের অফার বাজারে আনবে।”
রবি আজিয়াটা লিমিটেডের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম ২৩ অক্টোবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মোবাইল ইন্টারনেটের মূল্য নির্ধারণে মেয়াদ বা ভ্যালিডিটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
“ওয়্যারলেস প্রযুক্তিতে মেয়াদ পরিবর্তনের সাথে প্রয়োজনীয় ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ সরবরাহের ভিত্তিতে প্যাকজের খরচ ওঠা-নামা করে। স্বাভাবিকভাবেই একটি মোবাইল ইন্টারনেট প্যাকেজের মেয়াদ যদি ৩ দিন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৭ দিন করা হয়, তাহলে মেয়াদ বৃদ্ধির সাথে সাথে একইভাবে মূল্য সমন্বয় করার প্রয়োজন হয়।”
তার দাবি, ৩ দিন মেয়াদের ইন্টারনেট প্যাকেজ না থাকার কারণে গ্রাহকের খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে কি না, সেটি ‘এখনই বলা সম্ভব নয়’।
“তবে প্যাকেজ সংখ্যা ৪০-এ বেঁধে দেওয়ার কারণে গ্রাহকদের পছন্দ অনুযায়ী প্যাকেজ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। আমরা মনে করি, গ্রাহকের নিজস্ব চাহিদা ও ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে প্যাকেজ সংখ্যা নির্ধারণে কোনো সীমা থাকা উচিৎ নয়।”
গ্রামীণফোনের মুখপাত্র হোসেন সাদাত গত ২৭ অক্টোবর বলেন, “মাত্র কিছুদিন হয়েছে বিআরটিসির নির্দেশনা মেনে আমরা ৭ দিন এবং ৩০ দিন মেয়াদি ডাটা প্যাকেজগুলো চালু করেছি। বর্তমানে আমরা এইটা পর্যবেক্ষণ করছি। গ্রামীণফোন গ্রাহকদের সবসময় উন্নত সেবাদানে নিরলস প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে, তাই নতুন প্যাকেজগুলো গ্রাহকসুবিধার্থে আরো সিম্পল করা হয়েছে।”
সর্বশেষ রোববার ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ডেটা প্যাকের দাম নিয়ে চারটি অপারেটরের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন। আগারগাঁওয়ে বিটিআরসি ভবনে ওই বৈঠকে বিটিআরসির শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ইন্টারনেটের বাড়তি দাম নিয়ে ক্ষোভ জানান মন্ত্রী; তিনি ডেটা প্যাকের দাম কমাতে বলেন।
এখন অপারেটরগুলো কী করবে জানতে হাইলে একটি টেলিকম কোম্পানির বিপণন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, “তিন দিনের প্যাকেজ বাতিল করার পর যে নতুন দর, সেটা কিন্তু বিটিআরসির অনুমোদন নিয়েই কার্যকর করা হয়েছে। নিয়মটাই হচ্ছে প্রত্যেতকটা দর বিটিআরসির পূর্ব অনুমোদিত হতে হবে। তাদের অনুমোদন ছাড়া একটি পয়সাও কারও পক্ষে বাড়ানো সম্ভব না “