“আগে আমরা ৫-৬ রোজা থেকেই বাধ্য হয়ে শাটার বন্ধ করে দিতাম। আর এখন আমরা ডেকেও কাস্টমার আনতে পারছি না”, বললেন বসুন্ধরা শপিং মলের এক দর্জি দোকানের মালিক।
Published : 06 Apr 2023, 01:14 AM
রোজার অর্ধেক শেষ হতে চলল, অথচ ঢাকার নামিদামি মার্কেট এমনকি এলাকার দর্জির দোকানিরাও হতাশা নিয়ে অপেক্ষায়।
কাজ না থাকায় নিজেদের মধ্যে খোশ গল্প কিংবা ইউটিউবে ভিডিও দেখে সময় পার করছেন তারা। কেউ কাপড় নিয়ে এলে, ‘আপা আসেন’, বলে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন।
দর্জিদের ভাষ্য, অন্যান্য বছর রোজার এই সময়ে তারা ‘অর্ডার’-এর চাপ সামলাতে পারতেন না। কিন্তু এ বছর ডেকে ডেকেও ‘কাস্টমার’ পাচ্ছেন না।
ঢাকার নিউ মার্কেট, বাংলামোটর, বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স, ফার্মভিউ সুপার মার্কেট এবং আরও কিছু এলাকা ঘুরে দেখা গেল একই চিত্র। কারিগরদের বেশিরভাগই বলছেন, মানুষের হাতে ‘টাকা নাই’।
কেউ বলছেন, তার ১৭ বছরের কর্ম জীবনে এমন চিত্র দেখেননি। একজন বলেছেন, তিনি ৩০ বছর ধরে কাপড় সেলাইয়ের কাজে জড়িত, মহামারীর সময়টা বাদ দিলে এমন মন্দা কখনও দেখেননি।
কেউ কেউ আশায় আছেন, নতুন মাসের বেতন হলে হয়ত পরিস্থিতি পাল্টাবে। তবে অনেকেই আবার খুব বেশি আশাবাদী হতে পারছেন না।
‘হিসাব সোজা’
বসুন্ধরা সিটির কাপড় সেলাইয়ের দোকান কোয়ালিটি ফ্যাশনের মালিকদের একজন সুজন আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনার আগে আমরা ৫-৬ রোজা থেকেই বাধ্য হয়ে শাটার বন্ধ করে দিতাম। আর এখন আমরা ডেকেও কাস্টমার আনতে পারছি না।”
রমজানে তাদের হাতে যে পরিমাণ কাজ থাকে, এ বছর তার ৫০ শতাংশও নেই জানিয়ে তিনি বলেন, “হিসাব সোজা। পাবলিকের হাতে টাকা নাই। পাবলিক কাপড় না কিনলে আমরা অর্ডার পাব কীভাবে?
“আর আপনি নিজেই তো জানেন, এই মার্কেটে গরিব মানুষ আসে না। কিন্তু সেই তারাও এবার তেমন কেনাকাটা করছেন না।”
ঈদের আগে সেলাইয়ের মজুরি একটু বেশি নেওয়ার চেষ্টা করেন দর্জিরা। তবে এবার উল্টো কমানোর কথা জানালো কোয়ালিটি ফ্যাশন।
ঈদের সময় সালোয়ার কামিজ বানাতে এক হাজার টাকা নিলেও এবার ৫০০ নিচ্ছেন জানিয়ে সুজন বলেন, “মজুরি কম রাখতেছি যাতে কাস্টমার বাড়ে।”
‘আর ফ্যাশন লেডিস টেইলার্স’ এর মালিক রিপন চন্দ্র মিস্ত্রী ১৭ বছর ধরে বসুন্ধরা সিটিতে দর্জির কাজের সঙ্গে যুক্ত। বললেন, “এত বাজে অবস্থা এর আগে কখনও দেখিনি।”
“অন্য বছর এমন সময় অর্ডার নেওয়া হয় না। এবার আমরা সব ব্যবসায়ীরাই চিন্তিত। আমরা ভাবছি, এখানে যারা আসে তারা রিচ ফ্যামিলির ক্রেতা। কিন্তু তারা কি আদৌ কাপড়চোপড় বানাবে না?”
“আমাদের অনেক ক্লায়েন্ট আছে যারা সাভার, উত্তরা থেকে আসেন। এ বছর তারাও আসছেন না। আমার ধারণা আর্থিক সংকটের কারণেই এ রকম হচ্ছে”, বললেন রিপন।
এই মার্কেটের ‘মা জননী লেডিস টেইলার্স’ এর কারিগর মো. মানিক মঙ্গলবার বিকেলে বলেন, “সকাল থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র দুইজন আসছে।”
মানিকের জীবন কেবল নিচের দিকে নামছে। করোনাভাইরাস মহামারী শুরুর আগে বসুন্ধরায় তার নিজের দোকান ছিল। দুই বছর আগে মহামারী তাকে দোকান ছেড়ে অন্যের কর্মী হতে বাধ্য করেছে।
মার্চের বেতন হয়ে গেলে পরিস্থিতি পাল্টাবে, এই আশায় আছেন তিনি। বললেন, “দুই একদিন পর এবারের পুরা অবস্থাটা টের পাওয়া যাবে। মাত্র তো বেতন দেওয়া শুরু হইছে।”
ফার্মগেইটের ফার্মভিউ সুপার মার্কেটের মা টেইলার্সের চিত্রও আলাদা কিছু নয়। দোকানি সাইফুল ইসলাম বলেন, “রমজানে আমাদের অনেক বাড়তি খরচ থাকে। এবার সেটাও তুলতে পারছি না।”
এই এলাকাটায় খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বসবাস। তাদের উৎসব ইস্টার সানডে উপলক্ষে কিছু অর্ডার পাওয়ার আশায় ছিলেন সাইফুল। বলেন, “ভালো হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তা তো হচ্ছে না। তবে সবাই স্যালারি পেলে কাজ হতে পারে, এই আশা আছে।”
চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটের অজন্তা ইনেক্স দোকানের দর্জি বিমল সাহা বলেন, “এই লাইনে আমি ৩০ বছর। এবারের ব্যবসা বহুত খারাপ। আমরা আগে রোজার তিন মাস আগে থেকে ভালো ব্যবসা করতাম। কিন্তু এখন লোকজন আসতেছে না। পকেটে টাকা নাই।”
পুরুষদের পোশাকের চিত্র আরও খারাপ
চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটের কাপড় সেলাইয়ের দোকান বাঁধন টেইলার্স-এর মালিক মো. বাঁধন বলেন, “টেইলরিংয়ের বিজনেস ভালো না। মানুষের হাতে টাকা পয়সা নাই, বানাবে কী?”
ছেলেদের কাপড় সেলাই করে যারা, সেসব দোকানের অবস্থা আরও খারাপ বলে জানালেন তিনি। বললেন, “ছেলেদের না কিনলেও চলে, কিন্তু মেয়েদের চলে না। তাই লেডিসটা মোটামুটি ঠিক আছে, কিন্তু জেন্টসের অবস্থা একবারেই বাজে।”
রেমন্ডস নামে এক দোকানের কর্মী রাফি আহমেদ বললেন, “ঈদ ঘিরে এমনিতেও সেরকম অর্ডার থাকে না আমাদের। কাপড় বেশি বিক্রি হয় তুলনামূলকভাবে বেশি। কিন্তু এবার দেখা যাচ্ছে, মানুষ কাপড়ও কম কিনছে, বানাচ্ছে আরও কম।”
বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের দোকান ইউনিক এর কারিগর কাওসার হোসেন বলেন, “এবার রোজাটা পইড়া গেছে মাসের মাঝামাঝি। তাই সেলটা একটু কম হইব। আর দেখা যাবে যে এবছর অনেকে ঈদের আগে স্যালারি পাবে না। বোনাস হয়ত দিবে, স্যালারি দিতে চাইবে না।”
টপ ফিট অ্যান্ড টেইলর্সের বিক্রেতা সৈয়দ সুজন বলেন, “বিক্রি খুব-ই কম। বললে অবিশ্বাস্য লাগলেও সত্যটা হল, রোববার আমরা ইফতারের পরে এক টাকা সেলও দিতে পারিনি।”
“এবার যেহেতু ২২ বা ২৩ তারিখ ঈদ হবে, তাই অনেক অফিস বোনাসটা বা বেতনটা আটকে রাখবে। সবকিছু মিলে ঈদের সময় আগে যে ভিড় হত, তার কিচ্ছু নাই এ বছর,” বলছিলেন এ দোকানে ২০০৫ সাল থেকে কাজ করে আসা হাবিবুর রহমান।”
ক্রেতারা কী বলছেন?
সুজন ও হাবিবুরের সঙ্গে কথা বলার সময় ভগ্নিপতির জন্য শার্টের কাপড় কিনতে ইউনিকে আসেন এক দন্ত চিকিৎসক।
তিনি বলেন, “দোকানের চেহারার দিকে তাকালেই তো বোঝা যায় যে ব্যবসা কী রকম। মানুষের অনেক অসুবিধা আছে, দামের ঊর্ধ্বগতির জন্য। এই যে আমি কিনতে আসছি, আমিও আসতাম না। কিন্তু বাধ্য হয়ে আসা লাগল। কারণ, গিফট দিতেই হবে।”
নিজের ও মেয়ের জন্য থ্রি পিস সেলাইয়ের জন্য বাসাবো থেকে বসুন্ধরার জননী টেইলার্সে আসা রোকসানা বেগম বললেন, “এ বছর সবকিছুর দাম বাড়তি। একটা আমার, আরেকটা মেয়ের জন্য কিনেছি। গতবার বেশি কিনছিলাম।”
বাংলামোটরের মাহিম ড্রেস মেকার্সে সালোয়ার কামিজ বানাতে আসা ফারিয়া রহমানের কথায় উঠে এল কাপড় সেলাইয়ের উচ্চ মজুরির কথা। এ জন্য রেডিমেড কাপড়ে আগ্রহ বেড়েছে তার।
তিনি বলেন, “এবার আমি ইচ্ছে করেই আনস্টিচ কাপড় কিনি নাই। কারণ, মজুরি লাগে অনেক। মজুরির টাকা দিয়ে আমি স্টিচড কুর্তি পেয়ে যাব।”
নিউ মার্কেটে কেনাকাটা করতে আসা রাইতা জামান বললেন, “আমি আমার জামা নিজেই ডিজাইন করে বানাতে পছন্দ করি। তবে এবার এখনও কিনিনি। কিনব সামনে।
“শেষ সময়ে ভিড় থাকে, এটা সত্য। কিন্তু এখানে আমার পরিচিত টেইলর আছেন। তাই ভিড় থাকলেও আমার অর্ডার উনি নেবেনই।”