বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, “চলতি হিসাব ঋণাত্মক হলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ‘সাপোর্ট’ দেওয়া হয়, যা পরবর্তীতে সমন্বয় করে নেওয়া হয়- এটা চলমান প্রক্রিয়া।”
Published : 17 Dec 2023, 08:22 PM
শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলো আমানত, রেমিটেন্স, ঋণ প্রবাহসহ প্রায় সব সূচকে ভালো অবস্থায় থাকলেও চলতি হিসাবে নগদ টাকার স্থিতি ঋণাত্বক হওয়ায় পাঁচ ব্যাংককে ‘সতর্ক’ করে চিঠি দেওয়ার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
রোববার শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোর অবস্থা জানাতে সংবাদ সম্মেলনে এসে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলেন, “পাঁচ ব্যাংককে সতর্কতামূলক চিঠি দেওয়া হয়েছে। এটা সতর্কবাণী, কোনো সিদ্ধান্ত না।"
তারল্য সংকটে থাকা শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে পাঁচটির তারল্য পরিস্থিতি গত কয়েক মাস ধরেই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। চলতি হিসাবে ঘাটতি থাকায় ডিসেম্বরের প্রথম দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিস থেকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংককে চিঠি দেওয়া হয়।
চিঠি পাওয়ার ২০ কর্মদিবসের মধ্যে চলতি হিসাবের ঋণাত্মক স্থিতি সমন্বয়ের পরামর্শ দিয়ে বলা হয়, "আপনাদের চলতি হিসাবের স্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে যে, চলতি হিসাবের স্থিতি দীর্ঘদিন যাবৎ ঋণাত্মক যা স্বাভাবিক ব্যাংকিং প্রক্রিয়ার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিষয়টি বারংবার আপনাদের গোচরীভূত করা হলেও আপনাদের পক্ষ হতে এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।"
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সমন্বয়ে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম ডিপার্টমেন্ট এর সঙ্গে ‘ক্লিয়ারিং সেটেলমেন্ট এর জন্য নির্ধারিত হিসাবে পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ সংরক্ষণ চুক্তি’ অনুযায়ী সকল বা নির্দিষ্ট কোনো ক্লিয়ারিং সেটেলমেন্ট থেকে বাদ রাখা হবে হুঁশিয়ার করা হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্লিয়ারিং সেটেলমেন্ট হিসাবের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো এটিএম, পস মেশিন, এনপিএসবি, বিইফটিএন, চেক ক্লিয়ারিং (বিএসিএইচ), সরকারি সিকিউরিটিজ ক্রয় ও আরটিজিএস সেবা দিয়ে থাকে। অর্থাৎ এক ব্যাংকের সঙ্গে অন্য ব্যাংকের লেনদেন সম্পন্ন হয় এ পদ্ধতিতেই।
ওই পাঁচ ব্যাংক এ সেবা থেকে বাদ যেতে পারে এমন সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর সবকটি ব্যাংকই প্রেস বিজ্ঞপ্তি ও পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে দাবি করে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ সংক্রান্ত কোনো চিঠি তারা পায়নি।
বিষয়টি আলোচনার জন্ম দেওয়ার পর রোববার এই সংবাদ সম্মেলনে আসেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক। নাম উল্লেখ না করে পাঁচটি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঘাটতির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, চলতি হিসাব ঋণাত্মক হলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ‘সাপোর্ট’ দেওয়া হয়, যা পরবর্তীতে সমন্বয় করে নেওয়া হয়- এটা চলমান প্রক্রিয়া।
তবে ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয় চিঠি দিতে পারে, কিন্তু এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগ।
এর আগেও আইসিবি ইসলামি ব্যাংককে ৭০০ কোটি টাকার ‘সাপোর্ট’ দেওয়া হয়েছিল জানিয়ে মেজবাউল হক বলেন, "২০ কর্ম দিবসের মধ্যে ঘাটতি সমন্বয় না করলে অন্যান্য ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন বন্ধ হবে কি না– পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগ সে সিদ্ধান্ত নেবে।”
এক সময় তারল্য উদ্বৃত্ত থাকলেও ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনার পর থেকে এসব ব্যাংক তারল্য সংকটে ভুগছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, আমানতকারীদের সুরক্ষায় ব্যাংকগুলোর সংগ্রহ করা আমানতের একটি অংশ নগদ জমা অনুপাত-সিআরআর এবং বিধিবদ্ধ তরল অনুপাত-এসএলআর হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয়। ব্যাংকগুলো তাৎক্ষণিক নগদ টাকার প্রয়োজন মেটাতে এই অর্থ ব্যবহার করতে পারে, যা পরবর্তীতে সমন্বয় করে নিতে হয়।
প্রচলিত ও শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকের জন্য মোট আমানতের ৪ শতাংশ সিআরআর হিসেবে রাখতে হয়। আর প্রচলিত ব্যাংকের জন্য এসএলআর হচ্ছে ১৩ শতাংশ ও শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকের জন্য তা সাড়ে পাঁচ শতাংশ।
এই অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চলতি হিসাবে নগদ আকারে বা সরকারি সিকিউরিটিজ ও বন্ড আকারে রাখতে পারে।
ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো সিআরআর ও এসএলআর এর বেশিরভাগ অংশ নগদ আকারেই রাখতে হয়। প্রচলিত ব্যাংক যেখানে পুরোটাই সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করে রাখতে পারে, সেখানে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো শুধু সুকুক বন্ডে রাখতে পারে।
সেজন্য চলতি হিসাবে ঘাটতি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোর একটি ‘কাঠামোগত সমস্যা’ বলে মন্তব্য করেন মেজবাউল হক।
ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ‘বড় ইস্যু’ মন্তব্য করে মেজবাউল হক বলেন, “মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনাই এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নম্বর কাজ এখন। আর্থিক খাতও বর্হিচাপে রয়েছে। এ থেকে বেরিয়ে এলে সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোর সুশাসন নিয়ে কাজ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।”
ব্যাংকগুলো প্রয়োজনীয় সিআরআর ও এসএলআর রাখতে না পারলে জরিমানার মুখে পড়ে। শরিয়াভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংক তা রাখতে না পারায় গত জুন মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার মুদ্রানীতি সংক্রান্ত সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোকে সময় দেওয়া হয়েছে তারল্য ঘাটতি পূরণ করতে। কিন্তু তাপরও ব্যাংকগুলো প্রয়োজনীয় তারল্য সংরক্ষণ করতে পারেনি।
সংবাদ সম্মেলনে শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোর আর্থিক তথ্য তুলে ধরে মেজবাউল হক বলেন, গত সেপ্টম্বর শেষে মোট ব্যাংকিং খাতের আমানতের ২৬ শতাংশই শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকের।
রেমিটেন্স প্রবাহের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ এ ধারার ব্যাংকের। সার্বিকভাবে এ খাতের অতিরিক্ত তারল্য আছে সাত হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা, যা মোট ব্যাংকিং খাতে থাকা অতিরিক্ত তারল্যর ৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ।