“পটল কিনছি ৭০ টাকা কেজি দরে, এখন আমি নিজেই বিক্রি করছি ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজি। মানে লস দিয়েই বিক্রি করছি।”
Published : 24 Jul 2024, 10:50 PM
সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে আন্দোলনের মধ্যে সহিংসতা ও কারফিউয়ের কারণে ঢাকার কাঁচা বাজারে শুরু হওয়া সংকটে এবার বিক্রেতাদের লোকসানের তথ্য পাওয়া গেল।
গত বৃহস্পতিবার থেকে ঢাকার বাজারে পণ্যমূল্য লাফ দিতে শুরু করে। তবে বড় বাজারের বিক্রেতারা বলছেন, ক্রেতা আসছেন না। তাদের পণ্য পচে যাচ্ছে, বেশি লোকসানের আশায় কম দামে বিক্রি করে দিতে চাইছেন, কিন্তু ক্রেতা নেই সেভাবে।
কেনা দামের চেয়ে কমে বিক্রি করায় বড় লোকসানের দাবি করছেন তারা। সবজি, মাছ ও মুরগি- সব পণ্যের দোকানে একই চিত্র।
কারওয়ানবাজারে সবজির কেজি ১০০ টাকা থেকে ৪০ থেকে ৫০ টাকায় নেমেছে, তবে এলাকার বাজারে এতটা কমেনি দাম।
কারওয়ানবাজারের সবজি বিক্রেতা মো. আব্দুল আলী বলেন, “গত দুইদিন ধরে সবজির দাম কমতেছে। কেজিপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ টাকার মত কমেছে।
“দুই দিন আগে ১০০ টাকার নিচে বাজারে কোনো সবজি ছিল না। আমি পটল কিনছি ৭০ টাকা কেজি দরে, এখন আমি নিজেই বিক্রি করছি ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজি। মানে লস দিয়েই বিক্রি করছি।”
কারওয়ান বাজার ও বিজয় সরণিতে বনলতা বাজার ঘুরে দেখা যায়, চিচিঙ্গা ও পটল ৫০ টাকা, পেঁপে ও ঢ্যাঁড়স ৬০ টাকা, করলা, ধুন্দল ও বেগুন ৮০ টাকা, বরবটি ১০০ টাকা, লাউ মানভেদে ৭০ থেকে ৮০ টাকা এবং শসা বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ কেজি দরে।
বাজার ও মানভেদে মরিচের দাম নেমেছে ১৮০ থেকে ২৮০ টাকা পর্যন্ত। দুইদিন আগেও ক্রেতাদের কিনতে হয়েছে ৪০০ টাকা পর্যন্ত কেজি দরে।
পাইকারিতে আলু বিক্রি হচ্ছে ৫৬ টাকা কেজি দরে। যা খুচরাতে ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে ৬০ টাকা কেজি দরে। আর পাড়া – মহল্লায় বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকা পর্যন্ত।
বিক্রেতারা বলছেন, সহিংসতা ও কারফিউয়ের প্রভাবে বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার পর্যন্ত বাজার ক্রেতাশূন্য ছিল বললেই চলে। এতে তাদের অনেক সবজি পচে যায়। এই সময়ে পণ্য আসতে পারেনি সেভাবে, ফলে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে দাম।
কারওয়ান বাজারের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী লুৎফর রহমান বলেন, “কারফিউয়ের তিন-চারদিন এমন হইছে যে, আমরা বাজারে মাল নিয়ে বসে আছি কিন্তু কোনো ক্রেতা নাই। গতকাল সারাদিন বইসা রইছি মাত্র দুইজন ক্রেতা পাইছি।”
লুৎফর অন্যান্য দিনে ৪০ থেকে ৫০ জন ক্রেতা পান। অথচ মঙ্গলবার পেয়েছেন মাত্র দুইজন। তার মতে আন্দোলন ও কারফিউ নিয়ে মানুষ বেশ আতঙ্কে ছিল। তাই বাজারে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতেও আসে নাই।
পাশের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী মো. সেলিম বলেন, “বাজারে আমাদের সব মিলিয়ে দিনে পাঁচ হাজার টাকা খরচ আছে। সেই খরচটা পর্যন্ত আমরা উঠাইতে পারি নাই।”
কারফিউয়ের আগে দিনে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা বিক্রি করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “এখন ৩০ হাজার টাকাও বেচতে পারছি না।”
টমেটো বিক্রেতা আব্দুল আজিজ বলেন, “মানুষ বাজারে আসতে পারে নাই। ইমপোর্টাররা যে দাম বলে দেয় আমাদের সেই দামে বিক্রি করতে হয়। কিন্তু এই সংকটের সময়ে আমরা সেই দামে বিক্রি করতে পারি নাই। প্রতিদিন আমার লস ১০ হাজার টাকার মত।
“আজ (বুধবার) মাল বেশি নিছিলাম। ভাবছি যেহেতু কারফিউ দীর্ঘ সময় থাকবে না তাই বাজারে কাস্টমার আসবে। কিন্তু আমার প্রত্যাশানুযায়ী আসে নাই। তাই আজ লস ১৫ হাজারের মত।”
আলুর পাইকারি দোকান মেসার্স বিসমিল্লাহ বাণিজ্যালয়ে গিয়ে ঠাসা পণ্য দেখা গেছে। দোকানি মো. আলমগীর হোসেন জানান, “খুচরা বিক্রেতারা মাল নিতে আসছে কম, তাই বেচাকেনাও কম।”
মুরগি-মাছেও লোকসান
কোরবানির পর থেকে দাম কমে আসা মুরগি নিয়ে যেন নতুন করে বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। কোটা আন্দোলন ও কারফিউ মিলিয়ে বেচাকেনা কমে যাওয়ায় মুরগি মারা গেছে ও ওজন কমেছে বলে দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা।
কারওয়ান বাজারে ব্রয়লার বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকা কেজি আর সোনালি বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকা কেজি দরে।
এই বাজারে জনপ্রিয় পোল্ট্রি মুরগি আড়তের বিক্রেতা আমিনুল ইসলাম বলেন, “এই কয়টা দিন কাস্টমার ছিল না। তাই মুরগি মারা গেছে, নির্ধারিত দিনের চেয়ে বেশি সময় মুরগি দোকানে থাকায় ওজনও কমে গেছে। প্রতিদিন আমার ৫ হাজার টাকার মত লস গেছে।”
মাছ বিক্রেতা মো. শাহিন আলম গত এক সপ্তাহে ৩৫ হাজার টাকা লোকসানের হিসাব দিয়েছেন।
তিনি বলেন, “বাজারে কোনোভাবে মাছ আসলো। কিন্তু ক্রেতা তো নাই। তাই মাছ পচে গেছে কিছু। আবার পচে যাওয়ার ভয়ে কমে বিক্রিও করে দিয়েছি।”
বাজারে মাঝারি আকারের রুই মাছ বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকা কেজি দরে। কই মাছ ১৮০ টাকা, বড় আকারের পাঙাস ১৮০ টাকা ও মাগুর মাছ ৫০০ টাকা এবং টেংরা মাছ বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকা কেজি দরে।
বিজয় সরণির বনলতা কাঁচা বাজারের সবজি বিক্রেতা মো. ইয়াসিন বলেন, “শুক্র আর শনি-রোববার বেচাকেনা হয় নাই। দোকান খুলে বসে আছি কিন্তু ক্রেতার দেখা পাই নাই।
“আমি কারওয়ান বাজার থেকে মাল আনি। সেই বাজারে গিয়ে হঠাৎ দেখি সবকিছুর দাম বেশি। তাই অনেক পণ্য বেশি দামেই কিনে আনলাম। পরে সেগুলো বিক্রি করতে পারি নাই। অনেক নষ্ট হইছে। আবার নষ্ট হওয়ার ভয়ে কেনার চেয়েও কম দামে বিক্রি করে দিয়েছি।”
পণ্য পরিবহনে ভোগান্তি
কারওয়ানবাজারের মেসার্স বিসমিল্লাহ বাণিজ্যালয়ের বিক্রেতা মো. আলমগীর হোসেন জানালেন, ট্রাক চালকরা নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে ঢাকায় আসতে রাজি হচ্ছেন না। আর যারা আসছেন তারা ভাড়া নিচ্ছেন দ্বিগুণ।
তিনি বলেন, “জয়পুরহাট ও বগুড়া থেকে আসা আলুর গাড়ির ভাড়া আগে ছিল ১৩ হাজার টাকা। এখন ২০ হাজার, পরশুদিন তো ছিল ২৬ হাজার টাকা।”
ঢাকার ভেতরেও চালকরা ভাড়া বেশি নিচ্ছেন।
কারওয়ান বাজারে পাওয়া গেল পিকআপ চালক বিল্লাল হোসেনকে। তিনি গত তিনদিন গাড়ি চালাননি।
তিনি বলেন, “আমার পরিচিত অনেকেই বেশি ভাড়ার আশায় খ্যাপ মারছে। কিন্তু আমার পিকাপের মায়া বেশি। ভয়েই রাস্তায় নামি নাই।”
কেউ কেউ ঢাকায় সরবরাহও বন্ধও রেখেছেন।
মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকায় আলু সরবরাহকারী বাদল ব্যাপারী জানালেন, আন্দোলন-কারফিউয়ের মধ্যে সমস্যায় পড়তে চান না তিনি। গাড়িতে কখন হামলা হয়, তা নিয়েও শঙ্কিত তিনি।
বলেন, “দেশের অবস্থা স্বাভাবিক হইলে মাল পাঠামু।”
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ
কারফিউয়ের মধ্যে নিত্যপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
উৎপাদক, সরবরাহকারী বা গাড়িচালক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা ০১৭১৪৪৬১১৮২, ০১৭৬৫০০৫০০৬, ০১৭১১২৭৩৮০২ নম্বরে ফোন করে সহযোগিতা চাইতে পারবেন।
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বুধবার কারওয়ান বাজার ও মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট চালের বাজার পরিদর্শন করেন।
তিনি সাংবাদিকদের জানান, উত্তরবঙ্গ থেকে চালকরা ঢাকায় আসতে চাইছেন না।
পরে প্রতিমন্ত্রী নওগাঁ, বগুড়া ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ডিসিকে ফোন করে চালের গাড়ি ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেন।