তিনি বলছেন, এসব দেশ যে পরিমাণ আমদানি করে, তার অন্তত ৫ শতাংশের বাজার ধরতে পারলে বাংলাদেশের রপ্তানির আকার শত বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানো ‘কোনো সমস্যা নয়’।
Published : 14 May 2024, 09:17 PM
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের পরবর্তী গন্তব্য ইউরোপ নয়, বরং বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী এশিয়ার দেশগুলোই হবে বলে মনে করছেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু।
তিনি বলেছেন, এসব দেশ যে পরিমাণ আমদানি করে, তার অন্তত ৫ শতাংশের বাজার ধরতে পারলে বাংলাদেশের রপ্তানির আকার শত বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানো ‘কোনো সমস্যা নয়’।
ঢাকার মতিঝিলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই-এর কার্যালয়ে মঙ্গলবার ‘ব্যবসা-বাণিজ্যে বাধা ও সম্ভাব্য সমাধান’ বিষয়ে এক সেমিনারে তিনি বিষয়টির অবতারণা করেন। তার এ মন্তব্যে রপ্তানি নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলছে।
জাপান, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের মত দেশ বঙ্গোপসাগরের উপকূলে রয়েছে।
এসব দেশ যে প্রতিবছর হাজার হাজার বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে, সে কথা তুলে ধরে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “আমাদের দেখতে হবে, তারা কোন পণ্য আমদানি করছে। সেসব পণ্যের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে কোন কোনটি রপ্তানি করা যায়।”
রপ্তানির এ গন্তব্যে প্রবেশের জন্য ব্যবসায়ীরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সহায়তা পাবেন বলে আশ্বাস দেন তিনি।
ব্যবসায় প্রাতিষ্ঠানিক বাধার ‘ধরন ও প্রকৃতি’ বিষয়ে গবেষণার তথ্য
সেমিনারে উপস্থাপন করা গবেষণার বিষয় ছিল ‘বিজনেস রিলেটেড ব্যারিয়ারস অ্যান্ড পসিবল ওয়ে আউট’। ঢাকায় জার্মান দূতবাসের সহায়তায় গবেষণাটি পরিচালনা করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)।
সেখানে বলা হয়, দেশে ব্যবসা পরিচালনায় নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ ও সংস্থাগুলোর কাছ থেকে যেসব প্রাতিষ্ঠানিক বাধার মুখে পড়তে হয় ব্যবসায়ীদের, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল লাইসেন্স বা হালনাগাদের কাগজপত্র ঝুলিয়ে রাখা, ঘুষ ও ব্যাংক ঋণের সুদরহার।
সেমিনারে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, তৈরি পোশাক, ওষুধ খাত, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ট্যানারি শিল্পের উদ্যোক্তাদের কমপক্ষে ১৯ ধরনের লাইসেন্স ও অনুমোদন প্রয়োজন হয়। এক বছরের জন্য দেওয়া লাইসেন্স পরের বছর হালনাগাদ করতে কোনো কোনো সংস্থাকে ৩০০ পৃষ্ঠার কাগজপত্র জমা দিতে হয়। প্রতিবারই লাইসেন্স হালনাগাদ করতে সাত থেকে আটটি ধাপ পার করতে হয়।
শুধু ঢাকা সিটি করপোরেশন ২৯৬ ধরনের লাইসেন্স দিয়ে থাকে, যার মাশুল প্রতি বছরে কমপক্ষে ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা হয়।
বিভিন্ন ধরনের লাইসেন্স হালনাগাদ প্রক্রিয়া জটিল হওয়ায় ব্যবসায় ক্ষতি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন গোলাম মোয়াজ্জেম। তার মতে, এতে সময় ও অর্থ দুটোরই খরচ বাড়ে। উদ্যোক্তাদের গুনতে হয় মোটা অঙ্কের অর্থ, যা সরকারের কোষাগারের বদলে ‘ব্যক্তির পকেটে’ যায় বলে অভিযোগ তার।
তিনি বলেন, “গবেষণা জরিপে অংশ নেওয়া বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সবাই বলেছেন, সরকার নির্ধারিত মাশুলের বাইরেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মোটা অঙ্কের অর্থ দিতে হয়। এখানে উচ্চমাত্রার দুর্নীতি হয়, যার খরচ বর্তায় ব্যবসার ওপর।”
সিপিডির সমীক্ষায় ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ মাঝারি মানের উদ্যোক্তা বলেছেন, যে কোনো কাজে সরকারি প্রতিষ্ঠানে গেলে কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে হয়। ৬১ দশমিক ৯ শতাংশ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বলছেন, ব্যবসা পরিচালনায় ঘুষ একটি ‘বদ প্রকৃতির সমস্যা’ হয়ে উঠেছে।
সার্বিকভাবে ৫৮ দশমিক ৬ শতাংশ উদ্যোক্তা জানিয়েছেন, যে কোনো লাইসেন্স হালনাগাদ করতে গেলে ঘুষ দেওয়া একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর থেকে একটি নতুন লাইসেন্স ইস্যু করতে সরকারি মাশুলের বাইরে বিভিন্ন পর্যায়ে ন্যূনতম ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয় বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। লাইসেন্স নবায়ন করতেও ঘুষ দিতে হয় ৫০০ থেকে কয়েক হাজার টাকা পর্যন্ত।
কয়েকটি খাতে লাইসেন্স হালনাগাদ করতে সরকারি মাশুলের চেয়ে ঘুষের অঙ্কই বেশি হয় বলে অভিযোগ করেন গোলাম মোয়াজ্জেম। গবেষণায় উঠে আসা তথ্যের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, তৈরি পোশাক খাতের ট্রেড লাইসেন্সে সরকারি মাশুল ছাড়াও অতিরিক্ত ১৬ শতাংশ ঘুষ দিতে হয়।
অর্থাৎ ট্রেড লাইসেন্স হালনাগাদ করতে যদি সরকারি মাশুল ১০০ টাকা হয়, তবে উদ্যোক্তাকে ১৬ টাকা ঘুষ দিতে হয় কর্মকর্তাদের। এভাবে ১০০ টাকার খরচ গিয়ে দাঁড়ায় ১১৬ টাকায়।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অগ্নিনিরাপত্তা লাইসেন্সে পেতে কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে ১১৪ শতাংশ বাড়তি টাকা দিতে হয়। অর্থাৎ ১০০ টাকা মাশুল হলে ১১৪ টাকা দিতে হয় ঘুষ। এভাবে কারখানা স্থাপনে অতিরিক্ত ৩৬ শতাংশ, বন্ড লাইসেন্স পেতে ২৬১ শতাংশ ও বয়লার লাইসেন্স পেতে ৬৪৪ শতাংশ ঘুষ দিতে হয়।
সাত দিনের মধ্যে যে লাইসেন্স তৈরি হওয়ার কথা, তাতে সময় লাগে ১৫ থেকে ২০ দিন। এ জন্য ট্যানারি খাতের ২২০ জন উদ্যোক্তার লাইসেন্স হালনাগাদ করে দিতে তৃতীয় পক্ষ নিয়োগ করেছে কর্তৃপক্ষ।
সুদহারও একটি বাধা
সেমিনারে উপস্থাপন করা গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যবসায় খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে ব্যাংক ঋণের সুদহারও। প্রতিযোগী দেশ ভারতে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ, ভিয়েতনামে ৬ শতাংশ, চীনে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ ও কম্বোডিয়ায় তা মাত্র ১ শতাংশ।
বাংলাদেশে সুদহারের পাশাপাশি ঋণ অনুমোদনের সময় শুধু ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে ঋণ প্রসেসিং (কাগজপত্র তৈরি) বাবদ ২০ হাজার টাকা বাড়তি নেয় ব্যাংক। ঋণের অঙ্ক ভেদে তা ওঠানামা করে।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “অর্থায়নের উৎস খুবই সীমিত হওয়ায় উদ্যোক্তারা তহবিল সংকটে ভোগেন। প্রাতিষ্ঠানিক বাধা-বিপত্তি দূর করতে পুরো প্রক্রিয়াটি অনলাইনে সম্পন্ন করতে হবে। শুল্ক ও ভ্যাট ব্যবস্থায় জটিলতা দূর করে কর প্রশাসনে আমূল সংস্কার আনতে পারলে খরচ কমে ব্যবসা সহায়ক পরিবেশ তৈরি হবে।
বাজারের আকার বাড়ছে
এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, “বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার আর আমাদের ১৭ কোটি মানুষকে নিয়ে নয়। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্য ও মিয়ানমারকে ধরলে আমাদের ২০ কোটি মানুষের বাজার। তাদের জন্য আমাদের রপ্তানি পণ্য বাড়াতে হবে। সেই বাজারের জন্য পণ্য বানাতে হবে।
“ব্যবসা করতে গিয়ে উদ্যোক্তরা আইনি জটিলতায় ভুগছেন। কর ও শুল্কে নানা ধরনের জটিলতা যেমন আছে, তার সঙ্গে হয়রানিও রয়েছে। এসব দূর করতে হবে।”
জার্মানির ‘প্লাস ওয়ান নীতি’ বাংলাদেশের জন্য ‘সুযোগ’
দেশীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে জার্মানি কারিগরি সহাতা দিতে পারে বলে সেমিনারে পরামর্শ দেন জার্মান দূতাবাসের উপপ্রধান জায়ান জানোভস্কি।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের দ্বিতীয় বড় গন্তব্য জার্মানি। আমরা চীন ও ভারত নীতির সঙ্গে ‘প্লাস ওয়ান নীতি’ শুরু করেছি। বাংলাদেশ এ নীতির সুবিধা নিতে পারে।”
ভূ-রাজনীতিতে সক্রিয় হতে, আঞ্চলিক যোগাযোগ বাড়াতে এবং একক দেশের ওপর নির্ভরতা কমাতে ‘ওয়ান প্লাস নীতি’ নিয়েছে জার্মানি। চীন ও ভারতে থাকা বিনিয়োগ ও পণ্য আমদানিতে দেশ দুটির ওপর নির্ভরতা কমাতে আরও একটি দেশকে যোগ করবে জার্মানি, যাকে তারা ‘প্লাস ওয়ান’ নীতি বলছে।
জায়ান জানোভস্কি বলেন, প্লাস ওয়ান নীতিতে অংশ নিলে বাংলাদেশকে তার জন্য বিনিয়োগ ও সুযোগ-সুবিধা দিতে চায় জার্মানি। এ নীতি চালু হওয়ার পর ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামে ঝুঁকবেন জার্মান ব্যবাসায়ীরা।
অন্যদের মধ্যে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী, বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া সেমিনারে বক্তব্য দেন।