গ্রাহক অসন্তোষের মুখে তরঙ্গ কিনতে চাইছে গ্রামীণফোন

কলড্রপসহ নানা বিষয়ে গ্রাহকদের অভিযোগের মুখে সেবার মান বাড়াতে তরঙ্গ কিনতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে গ্রামীণফোন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Jan 2019, 04:00 PM
Updated : 15 Jan 2019, 02:49 AM

বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের সর্বাধিক গ্রাহক গ্রামীণফোনের হলেও তারা সেই অনুপাতে তরঙ্গ না কেনায় দিন দিনই সেবার মান পড়ছে বলে অভিযোগ আসছে।

তুলনা করলে দেখা যায়, টেলিটকের চেয়ে গ্রামীণফোনের গ্রাহক সংখ্যা ২১ গুণ বেশি হলেও তাদের তরঙ্গ টেলিটকের দ্বিগুণও নয়।

গ্রাহক অনুপাতে তরঙ্গ কম হলে কলড্রপসহ ইন্টারনেট সেবায় সমস্যা হওয়া স্বাভাবিক বলে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কর্মকর্তাদের ভাষ্য।

ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সবচেয়ে খারাপ সার্ভিস গ্রামীণফোনের, তার প্রধান কারণ হচ্ছে তাদের তরঙ্গ নেই। তার যে পরিমাণ গ্রাহক আছে, সে পরিমাণ তরঙ্গ নেই।”

অব্যবহৃত তরঙ্গ নিজেদের কাছে থাকার কথা বিটিআরসি বরাবরই বলে আসছিল। কিন্তু দাম বেশি হওয়ার কারণ দেখিয়ে তরঙ্গ কিনতে অনাগ্রহ দেখিয়ে আসছে অপারেটরগুলো।

এখন সেবা নিয়ে গ্রাহকদের অসন্তোষের মুখে গ্রামীণফোন তরঙ্গ কেনায় আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিটিআরসির সঙ্গে আলোচনায়ও বসতে যাচ্ছে তারা।

মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার

সেবার মান নিয়ে গ্রাহকদের অসন্তোষ এড়াতে তরঙ্গ কেনার উপর জোর দিচ্ছেন মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারও।

তিনি আরও বলেছেন, বেশি পরিমাণ তরঙ্গ কিনলে অপারেটরদের মূল্যছাড় দিতেও রাজি বিটিআরসি।  

বাংলাদেশের বৃহত্তম মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোনের কলড্রপ নিয়ে ব্যাপক অসন্তোষ গ্রাহকদের; বিষয়টি গত সংসদে আলোচনায় তুলেছিলেন দুই মন্ত্রীও।

গত বছর সংসদে তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, “ইদানিং লক্ষ্য করলে দেখা যাবে আমরা যারা গ্রামীণফোন ব্যবহার করি, প্রত্যেকটি কলে কলড্রপ হয়। একেকটি কলে ৩, ৪, ৫ বার ড্রপ হয়। এজন্য বার বার কল করতে হয়।

“রবি আছে, অন্যান্য ফোন আছে, গ্রামীণফোনের মতো এরকম অন্যায় করে ব্যবসা করে লাভ করা … এটা কিন্তু সঠিক হয় না।”

তার আগে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমও কলড্রপ নিয়ে অসন্তোষ জানিয়েছিলেন।

গত বছর অক্টোবরে মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর এক বছরের কলড্রপের একটি পরিসংখ্যান দিয়েছিল বিটিআরসি, তাতে শীর্ষে ছিল গ্রামীণফোন; যদিও গ্রাহক সংখ্যার দিক থেকেও তারা অন্যদের চেয়ে অনেক এগিয়ে।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গ্রামীণফোনের কলড্রপের সংখ্যা ১০৩ কোটি। দ্বিতীয় স্থানে থাকা রবির কলড্রপ ৭৬ কোটি, বাংলালিংকের কলড্রপ ৩৬ কোটি এবং টেলিটকের কলড্রপ ৬ কোটি।

কলড্রপের ক্ষেত্রে গ্রাহক অনুপাতে পর্যাপ্ত তরঙ্গ না থাকাকে দায়ী করছেন টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা।

তথ্য প্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ সাবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মোবাইল নেটওয়ার্ক কোনো একটি বিটিএসএ (টাওয়ার) এ গ্রাহক সংখ্যার অনুপাতে তরঙ্গ বরাদ্দ থাকে। সেই তরঙ্গ গ্রাহক সংখ্যার চেয়ে বেশি হয় তাহলে সমস্যা হওয়া স্বাভাবিক। কারণ ওই তরঙ্গ তখন অতিরিক্ত গ্রাহকের সাথে ভাগাভাগি করতে হয়। এর ফলে কলড্রপসহ ডেটা সেবায়ও গ্রাহক ভোগান্তিতে পড়বেন।”

প্রতিবেশীসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের মোবাইল ফোন অপারেটরদের গ্রাহক অনুপাতে তরঙ্গ ব্যবহার কম দেখা যায়।

বিটিআরসি কর্মকর্তাদের দেওয়া একটি তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে ১৭ লাখ গ্রাহকের জন্য ব্যয় করা হয় ১ মেগা হার্টজ তরঙ্গ।

প্রতি মেগা হার্টজ  তরঙ্গ ব্যবহারের ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কায় সর্বোচ্চ গ্রাহক সংখ্যা ২ লাখ ৭০ হাজার, পাকিস্তানে ১ লাখ ৪০ হাজার, আফগানিস্তানে ২ লাখ ৯০ হাজার, নেপালে ৫ লাখ ২২ হাজার, থাইল্যান্ডে ১০ লাখ।

মালয়েশিয়ায় সর্বোচ্চ ২ লাখ সংযোগের জন্য ১ মেগা হার্টজ তরঙ্গ ব্যবহার হয়। অস্ট্রেলিয়ায় এই সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজার, জার্মানিতে ৩ লাখ ৯৯ হাজার, ভিয়েতনামে ১০ লাখ।

৭ কোটি গ্রাহকের মাইলফলক উদযাপনে গ্রামীণফোন। ছবি: গ্রামীণফোনের ফেসইবুক পেইজ থেকে

বাংলাদেশে গ্রামীণফোনের হাতে এখন মোট তরঙ্গের (স্পেকট্রাম) পরিমাণ ৩৭ মেগা হার্টজ। তাদের গ্রাহক সংখ্যা ৭ কোটি ২৩ লাখ। এই সংখ্যা বাংলাদেশের মোট মোবাইল ফোন সংযোগের প্রায় অর্ধেক।

অন্য অপারেটরগুলোর মধ্যে রবির ৪ কোটি ৭০ লাখ, বাংলালিংকের ৩ কোটি ৩৭ লাখ এবং রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিটকের গ্রাহক রয়েছে ৩৮ লাখ ৮৩ হাজার।

গ্রাহক সংখ্যার দিক থেকে গ্রামীণফোনের চেয়ে রবির আকার প্রায় অর্ধেক হলেও তাদের তরঙ্গের পরিমাণ গ্রামীণফোনের কাছাকাছি, ৩৬ দশমিক ৪ মেগাহার্টজ।

বাংলালিংকের হাতে রয়েছে ৩০ দশমিক ৬ মেগাহার্টজ তরঙ্গ। টেলিটকের রয়েছে ২৫ দশমিক ২০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ।

বিটিআরসি কলড্রপের হিসাব দেওয়ার পর গ্রামীণফোন ও রবি দাবি করেছিল, রেডিও প্রযুক্তিনির্ভর মোবাইল সেবায় কলড্রপ একটি স্বাভাবিক উপসর্গ। নেটওয়ার্কে কলড্রপের পরিমাণ সবসময়ই বিটিআরসি ও আন্তর্জাতিক নির্ধারিত মানদণ্ডের অনেক নিচে রয়েছে।

অপারেটররা বলছে, কলড্রপ শুধু তরঙ্গের স্বল্পতার কারণেই হয় না, ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কের দুর্বলতা, ইন্টারকানেকশন, গ্রাহকের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনের মানের মতো অনেকগুলো বিষয় এতে জড়িত।

তবে সার্বিক বিষয় বিবেচনায় এখন হাতে তরঙ্গ বাড়াতে চায় গ্রামীণফোন।

বিটিআরসির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সম্প্রতি গ্রামীণফোন তরঙ্গ কেনায় আগ্রহ প্রকাশ করে চিঠি দিয়েছে। তারা আলোচনায় বসতে চায়। খুব শিগগিরই এ বিষয়ে আলোচনা শুরু হবে।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে গ্রামীণফোনের পরিচালক ও কমিউনিকেশন্স বিভাগের প্রধান সৈয়দ তালাত কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্পেক্ট্রাম বিষয়ে আলোচনা করার জন্য আমরা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। কোনো প্রকার  আলোচনার আগে এ বিষয়ে বিস্তারিত মন্তব্য করা ঠিক হবে না।”

বিটিআরসির এক কর্মকর্তা জানান, টু জির ৯০০ মেগা হার্টজ ব্যান্ডে ৮ দশমিক ৪ মেগা হার্টজ ও ১৮০০ মেগা হার্টজ ব্যান্ড ১২ দশমিক ৪ মেগা হার্টজ এবং থ্রি জির ২১০০ মেগা হার্টজ ব্যান্ডে ২০ মেগা হার্টজ ব্যবহারযোগ্য রয়েছে। এ তিন ব্যান্ডে মোট ৪০ দশমিক ৮ মেগা হার্টজ তরঙ্গ রয়েছে যেখান থেকে অপারেটররা কিনতে পারেন।

অপারেটররা বলে আসছে, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে তরঙ্গের দাম অনেক বেশি হওয়ায় আগ্রহ থাকলেও তারা কিনতে পারছে না।

এর পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, “হোলসেলে যদি কিনতে চায়, তাহলে দাম কমানো হবে। প্রযুক্তি নিরপেক্ষতা থাকায় যে তরঙ্গ নেবে সেটাই তারা ইচ্ছামতো সেবা দিতে পারবে।”

“আমরা বলে দিয়েছি প্রাইস রিডাকশন করব বাই ল, বেশি তরঙ্গ কিনলে মূল্যে ছাড় পাবে। এটি সব অপারেটরদের জন্য প্রযোজ্য হবে। এই মুহুর্তে বড় টার্গেট জিপি।”