জ্বালানি খাতে দুর্নীতি ও অপচয় রোধ করা গেলে প্রচলিত দাম বহাল রেখেই আমদানি করা এলএনজির দাম সমন্বয় সম্ভব বলে মত দিয়েছেন ভোক্তা অধিকারকর্মী এম শামসুল আলম।
Published : 04 May 2018, 12:50 AM
এলএনজির আমদানি ব্যয় সমন্বয়ে গণশুনানি ছাড়াই জ্বালানি বিভাগ গ্যাসের দাম বাড়িয়ে প্রতি ঘনফুট ১৩ টাকায় উন্নীত করার চেষ্টা করছে অভিযোগ তুলে নিজের উদ্বেগের কথাও বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে জানান তিনি।
বর্তমানে পেট্রোবাংলার প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের গড় মূল্য সাত টাকা ৩৫ পয়সা।
গত ২৪ এপ্রিল দেশে প্রথমবারের মতো তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজিবাহী ভাসমান বন্দর বাংলাদেশের মহেশখালী দ্বীপাঞ্চলে এসে পৌঁছেছে। চলতি মাসের শেষ দিকে এই গ্যাস জাতীয় সঞ্চালন লাইনে যুক্ত হলে আমদানি মূল্য সমন্বয় করতে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে বলে সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে।
আমদানি করা এলএনজির সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে বৃহস্পতিবার ঢাকা ক্লাবে আলোচনা সভার আয়োজন করে জ্বালানি বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ফোরাম ফর এনার্জি রিপোর্টার্স বাংলাদেশ (এফইআরবি)।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম, পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান মুক্তাদির আলী, গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানির সাবেক পরিচালক খন্দকার সালেক সুফি, অধ্যাপক শামসুল আলম অনুষ্ঠানে আলোচনা রাখেন।
ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম বলেন, “গ্যাসের দাম বাড়াতে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে গণশুনানি হওয়ার কথা থাকলেও তা না করে সরাসরি জ্বালানি বিভাগে নতুন সমন্বিত দরপ্রস্তাব নিয়ে জ্বালানি বিভাগে গেছে পেট্রোবাংলা। সেখানে নতুন দাম প্রতি ঘনফুট ১৩ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। ইতোমধ্যেই পিডিবি ও বিসিআইসিকে নতুন দামের বিষয়ে চিঠিও পাঠানো হয়েছে। এটা নিয়ে আমরা ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন।”
জ্বালানি খাতের ‘সীমাহীন চুরি ও দুর্নীতি’ চলছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, “এই দুর্নীতি থামানো না গেলে এই খাত তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত হবে। মন্ত্রণালয়কে এখনি এবিষয়টি ভাবতে হবে।”
উদাহরণ দেখিয়ে তিনি অধ্যাপক শামসুল বলেন, শিল্প কারখানায় অনেককে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস দেওয়া হচ্ছে না। আবার অনেককে চাহিদার তুলনায় ২/৩ গুণ বেশি দেওয়া হচ্ছে। গণমাধ্যমে এসব খবর এসেছে।
“তিতাসের এমডির বিরুদ্ধে ওজনে মেপে ঘুষ খাওয়ার অভিযোগ এসেছে। তিনি বহাল তবিয়তে আছেন। নিরপেক্ষ তদন্ত হয়নি। তিতাসের চেয়ারম্যান হচ্ছেন জ্বালানি সচিব। তাহলে তাকে কি চুরির দায়ে দায়ী করতে পারি না?
“বাসাবাড়িতে ১৬ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ দেখানো হচ্ছে। অথচ সেখানে ৫ শতাংশের বেশি গ্যাস ব্যবহার হয়না। একইভাবে এই শিল্প-কারখানা, সিএনজি স্টেশনে গ্যাস চুরি হচ্ছে। এই চুরিগুলো ঠেকানো গেলে যে অর্থ সাশ্রয় হবে তা দিয়ে ৫০০ এমএমসিএফডি এলএনজি জাতীয় সঞ্চালন লাইনে যুক্ত করা সম্ভব।”
সালেক সুফি বলেন, “গোয়েন্দা প্রতিবেদনে দেখেছি তিতাসে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস চুরি হয়, যা দিয়ে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। এই চুরি যদি বন্ধ করা যায়, তাহলে গ্যাসের দাম খুব একা বাড়ানো প্রয়োজন হবে না। চুরির সাথে কারা জড়িত বের করতে হবে।”
জ্বালানি খাতের অদক্ষতার উদাহরণ দিতে গিয়ে এলএনজি আমদানির দীর্ঘসূত্রতার বিষয়টিও তুলে ধরেন তিনি।
“২০১০ সালে সিদ্ধান্ত হয়েছিল এলএনজি আনার, যা ২০১৩ সালে আসবে বলে ধরা হয়েছিল। তখন যদি চুক্তি করা যেত তাহলে অনেক কম দামে এলএনজি আনা যেত। সেই এলএনজি আসলো ২০১৮ সালে!”
পেট্রোবাংলাসহ এই খাতে দক্ষ ও কর্মনিষ্ঠ কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার পরামর্শ দেন সালেক সুফি।
গ্যাস চুরির দাবির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, “২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট, ঘাটতি ছিল ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এখন উৎপাদন ২৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট হলেও ঘাটতি থাকছে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। তাহলে এতো গ্যাস যাচ্ছে কোথায়? নতুন করে বড় কোনো সংযোগ তো দেওয়ার তথ্য নেই।”
অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিদ্যুৎ বিভাগের দক্ষতার প্রশংসা করলেও জ্বালানি খাতে ‘সমস্যা’র কথা স্বীকার করেন।
“তাদের মাঝে পেশাদারিত্বের ঘাটতি আছে। এখানেই সমস্যা। বিগত দিনে আমি বিষয়টা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।”
রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাপেক্সকে কার্যকর ও দক্ষ করতে মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার কথাও স্বীকার করেন নসরুল হামিদ।
“বাপেক্সকে কার্যকর করতে সেখানে বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তারা নেয়নি। নতুন জনশক্তিও নিয়োগ দিচ্ছে না। বাপেক্স নিজেরাই শক্তিশালী হতে চাচ্ছে না।”
অনুষ্ঠানের সভাপতি অরুন কর্মকার বলেন, “জ্বালানি খাতে চুরি ও অপচয়ের বিষয়টা বারবার আলোচনায় আসছে। চুরি ও দুর্নীতি এই খাতের বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। চড়া দামে কেনা এলএনজি যাতে চুরি ও অপচয়ে শেষ না হয়ে যায়, এখনই সেদিকে নজর দিতে হবে।”
এলএনজি প্রকল্পের সাবেক পরিচালক মোক্তাদির আলী বলেন, জ্বালানি খাতের শৃঙ্খলা আনতে পাইপলাইনগুলো নিয়ে এখনই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণের প্রয়োজন।
পাশাপাশি দেশীয় জ্বালানি সম্পদকে কাজে লাগাতে বাপেক্সকে আরও শক্তিশালী করায় জোর দেন তিনি।