অটোরিকশা সেবাও অ্যাপে

অ্যাপনির্ভর পরিবহন সেবা চালু হওয়ার পর বিপাকে পড়া অটোরিকশা চালকদেরও ডিজিটাল নেটওয়ার্কে আনার পথ তৈরি হচ্ছে।   

ওবায়দুর মাসুম নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Nov 2017, 09:44 AM
Updated : 21 Nov 2017, 11:28 AM

হ্যালো সিএনজি রাইড শেয়ারিং নামে একটি প্রতিষ্ঠান নতুন একটি অ্যাপ তৈরি করছে, যার মাধ্যমে যাত্রীরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অটোরিকশা ডাকতে পারবেন।

স্যাম নামে আরেকটি রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানও তাদের অ্যাপে অটোরিকশা ভাড়া করার সুযোগ রেখেছে।

যাত্রীদের চাহিদা মত গন্তব্যে না যাওয়া এবং বাড়তি ভাড়া নেওয়ায় সমালোচিত অটোরিকশা চালকরা সম্প্রতি পুরনো অটোরিকশার বদলে নতুন বাহন বরাদ্দসহ আট দফা দাবিতে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ওই আট দফায় অ্যাপনির্ভর পরিবহন সেবা বন্ধের দাবিও ছিল।

কিন্তু অটোরিকশা অ্যাপের আওতায় আসার সম্ভাবনা নিয়ে সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ঢাকা জেলা কমিটির সদস্য সচিব সাখাওয়াত হোসেন দুলাল এখন আগ্রহের কথা বলছেন। 

অটোরিকশার জন্য অ্যাপ তৈরির কাজ প্রায় শেষ জানিয়ে হ্যালো সিএনজির প্রতিনিধি এএসএম জামাল সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,“চালক ও যাত্রীদের জন্য যে অ্যাপ, সেটি চলে এসেছে। কিছুদিনের মধ্যেই আমরা গুগল প্লে স্টোরে দিয়ে দেব। এটা ডিসেম্বরের শেষের দিকেই চলে আসবে।”

জামাল জানান, এই অ্যাপ চালুর বিষয়ে তারা পর্যায়ক্রমে সবার সঙ্গে আলোচনায় বসছেন।

“ইতোমধ্যে অটোরিকশা শ্রমিক ঐক্যপরিষদের নেতাদের সঙ্গে মোটামুটি কথা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে চালকদের ওপরও আমরা জরিপ করছি।”

রাইড শেয়ারিং সেবার স্রোতে অটোরিকশা যেন হারিয়ে না যায়, সেজন্যই এ অ্যাপ তৈরি করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন এএসএম জামাল।

তিনি বলেন, “অটোরিকশায় যাত্রী অনেক কমে গেছে। একটি অটোরিকশা এক থেকে দেড় ঘণ্টা বসে থাকছে। সারাদিন গাড়ি চালানোর পর যে পারিশ্রমিক পাওয়ার কথা তা তারা ঠিকমত পাচ্ছে না। ফলে ঠিকমত জমাও দিতে পারছে না। সব মিলিয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছে তারা। সিএনজি অটোরিকশার সিস্টেমটাকে টিকিয়ে রাখতেই আমাদের এ উদ্যোগ।”

জামাল বলেন, হ্যালো সিএনজি অ্যাপ ব্যবহার করে সেবা নিলে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে খরচ কিছুটা বাড়বে। প্রথম দুই কিলোমিটারের ভাড়া ৪০ টাকাই থাকবে। তবে পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারে ১২ টাকার পরিবর্তে ১৩ টাকা করে গুণতে হবে যাত্রীদের। ফলে প্রতিটি রাইডে যাত্রীদের ২০ থেকে ৩০ টাকা বেশি দিতে হবে।

“আমরা যে সুবিধাটা দেব এটার জন্য কিছুটা চার্জ তো করতেই হবে। কারণ ঘরে বসেই এখন অটোরিকশা ডাকতে পারছে। অটোরিকশা ঠিক করার জন্য রাস্তায় যেতে হচ্ছে না, অতিরিক্ত সময় লাগছে না।”

হ্যালো সিএনজি অ্যাপটি ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হলেও অটোরিকশা চালকদের অনেকেই স্মার্টফোন ব্যবহারে দক্ষ না হওয়ায় কিছুট সমস্যা রয়েছে বলে জানান জামাল।

তিনি বলেন, “অনেকের কাছেই স্মার্টফোন নেই। যাদের আছে, তারাও এর ফাংশন ঠিকমতো বোঝে না। এ জন্য চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছি। ইতোমধ্যে আমরা দেড়শ জন চালককে যুক্ত করেছি।”

আরেকটি অ্যাপভিত্তিক মোটরসাইকেল শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান ‘শেয়ার আ মোটরসাইকেল’ বা স্যামও তাদের অ্যাপে অটোরিকশায় রাইড নেওয়ার সুযোগ রেখেছে বলে জানিয়েছেন ডাটাভক্সসেল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমতিয়াজ কাসেম।

সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “অটোরিকশার অপশন আমাদের অ্যাপে আগেই রেখেছিলাম। আমরা চালকদের সঙ্গে মতবিনিময়ও করেছিলাম। তবে নীতিমালায় অটোরিকশাকে না রাখায় আর এটা নিয়ে কাজ করিনি। এছাড়া তখন একেকজন মালিককে খুঁজে বের করে তাদের এ বিষয়ে জানানোও কঠিন ছিল।”

চালকরা স্যামের আগ্রহী হলে দ্রুত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে স্যামের অ্যাপে অটোরিকশার অপশন চালু করে দেওয়া সম্ভব বলে জানান ইমতিয়াজ।

“আমাদের অলরেডি একটা কাস্টমার বেইজ আছে, সেটার সঙ্গে নতুন কাস্টমার জয়েন করতে পারবে। এ ব্যাপারে শ্রমিকদের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আমাদের বৈঠক আছে সামনেই।”

সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ঢাকা জেলা কমিটির সদস্য সচিব সাখাওয়াত হোসেন দুলাল বলেন, তারাও অ্যাপভিত্তিক সেবায় যেতে চান।

“যেভাবে অবৈধ অ্যাপ চালু হয়ে গেছে তাতে আগামী ছয় মাস পরে ঢাকায় সিএনজি বন্ধ হয়ে যাবে। চালক মালিক সবাই মাঠে মারা যাবে। তবে অটোরিকশার জন্য যদি অ্যাপ আসে, আমাদের চালকরা আগ্রহী। তারা অটোরিকশা চালাতে চায়। এরা অবৈধ কিছু করতে চায় না, ডাকাতি করতে চায় না। তারা গাড়ি চালাতে চায়, কাজ করে দু-বেলা দুমুঠো খেতে চায়।”

তবে অ্যাপভিত্তিক সেবায় গেলে মালিক কত টাকা পাবে, কত টাকা চালকরা পাবে সে বিষয়ে নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে বলে মন্তব্য করেন সাখাওয়াত হোসেন দুলাল।

কাঁঠালবাগানের বাসিন্দা হাবিবা আক্তার মনে করছেন, অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবায় অটোরিকশা যুক্ত হলে যাত্রীদের জন্যও ভালো হবে।

“তখন ঘরে বসেই এটা পাওয়া যাবে। আর এখন উবারে প্রাইভেটকার পাওয়া গেলেও তাতে ভাড়া বেশি। অটোরিকশার ভাড়াটা কম বলে মধ্যবিত্তের জন্য সাশ্রয়ী হবে।”

ভোগান্তি কমানোর জন্যই অটোরিকশাগুলোকে  অ্যাপের আওতায় নিয়ে আসা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন শান্তিনগর এলাকার বাসিন্দা ব্যাংক কর্মকর্তা জাকারিয়া হোসেন খান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “অটোরিকশার জন্য বাসা থেকে বের হয়ে বড় রাস্তা পর্যন্ত যেতে হয়। তারা ছোটগলিতে আসতে চায় না। স্টেশনে গিয়ে অটো ধরতে সময় নষ্ট হয়। এখন তো সবাই স্মার্টফোন ব্যবহার করে। অ্যাপ থাকলে চালকদের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে সুবিধা হবে, ভোগান্তি কমবে।”

তবে অটোরিকশা মালিকরা এখনই অ্যাপভিত্তিক সেবায় যেতে রাজি নন। ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিকশা মালিক সমিতির সভাপতি বরকত উল্লাহ বুলু বলছেন, সরকারের ঠিক করে দেওয়া বর্তমান নীতিমালাতেই তারা সেবা দিতে চান।

“আমাদের তো নিজস্ব নীতিমালা আছে। অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবার সঙ্গে তো আমাদের নীতিমালা মিলবে না। আমাদের তো নির্ধারিত ভাড়া আছে। ওই ভাড়া আর আমাদের ভাড়া তো এক হবে না। আমরা আপাতত সেটা নিয়ে ভাবছি না। তবে ভবিষ্যতে সে রকম পরিস্থিতি তৈরি হলে আমরা বিষয়টি ভেবে দেখব।”

কোনো অটোরিকশা মোবাইল অ্যাপে চললেও বর্তমান নিয়মে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া তারা নিতে পারবে না বলে জানান বিআরটিএর চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে সরকারি নীতিমালা মেনে চলতে হবে।

“অ্যাপওয়ালারা কোনোভাবেই বর্তমানে যে ভাড়া আছে তার চেয়ে বেশি নিতে পারবে না। একইভাবে ট্যাক্সিক্যাবে যে ভাড়া নির্ধারণ করা আছে তার থেকেও বেশি ভাড়া নেওয়ার সুযোগ নেই।”

প্রস্তাবিত রাইড শেয়ারিং নীতিমালায় অটোরিকশার বিষয়টি রাখা হয়নি। তবে কোনো প্রতিষ্ঠান আবেদন করলে তা ভেবে দেখার সুযোগ আছে বলে জানান মশিয়ার রহমান।

“আমরা তো কিছু করতে পারব না। আমাদের নির্দেশনা দিলে আমরা সেটা নিয়ে কাজ করতে পারি। সেক্ষেত্রে সচিব বরাবর দরখাস্ত দিলে আমাদেরকে যদি বলে বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে, আমরা করতে পারব।”

সড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাইড শেয়ারিং নীতিমালা আমরা কেবিনেটে পাঠিয়ে দেব। সেখানে তিন চাকার বাহনের বিষয়ে কোনোকিছু বলা হয়নি। আর যদি সরকার মনে করে যে সেটা দেওয়া দরকার, তাহলে আবার দিয়ে দেব, অসুবিধা কি?”